(আপাতত লেখালেখি, পড়াশোনা, ছবি তোলা সব ধরনের ব্লকেই ভুগছি। পড়তেও পারছি না, লিখতেও পারছি না, ছবিও তুলতে পারছি না। তাই একদম শুরু থেকে শুরু করা। একান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতি। একটু অগোছালো। বেশি বড় মনে হলে কিংবা বিরক্ত হলে, এড়িয়ে যাওয়ার অনুরোধ করছি।)
প্রথম শ্রেণীতে পড়ার বয়সে আব্বা কিছুতেই আমাকে স্কুলে দিতে অথবা স্কুলের বই কিনে দিতে রাজি ছিলেন না। বাচ্চার ওজনের চেয়ে বাচ্চার স্কুল ব্যাগের ওজন বেশি হবে এটা আব্বা কিছুতেই হতে দেবেন না। আর অন্যদিকে মা মাথা কুঁটে মরতেন আমার মতো ফাঁকিবাজ মেয়েকে নিয়ে, যার পড়াশোনার প্রতি একটুও আগ্রহ নেই।
আমার পড়ার বই ছিল শুধুমাত্র আদর্শলিপি আর লেখার জন্য ছিল কালো রঙের স্লেট। আমি পুরো আদর্শলিপি উচ্চারণও করতে পারতাম না, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আদর্শলি বই পড়ি।
যে বয়সে আমার বন্ধুরা স্কুলে যাওয়া শুরু করে, আমি সে বয়সে বাচ্চাদের উচ্চারণের বই পড়তাম বাসায় বসে বসে আর হাতের লেখার চর্চা করতাম। এরমধ্যে আপু লুকিয়ে আমার দুই চাচাতো বোনের স্কুলের বই (ওরা একজন প্রথম শ্রেণীতে আর আরেকজন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়তো) এনে আমাকে পড়ানো শুরু করলো। বৃহস্পতিবার বিকালে ওদের বই এনে, শনিবার সকালে আবার ফেরত দিয়ে আসা হতো। এমন করে একবছরেই প্রথম শ্রেণীতে পড়ার বয়সে বাসায় বসে প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণীর বই পড়ে ফেললাম; পাশাপাশি আব্বার কাছে চলতে থাকলো ওই বাংলা এবং ইংরেজি উচ্চারণের বই পড়া।
এরপরের বছর অনেকটা বিদ্রোহ করেই আম্মা আমাকে প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে ক্লাস থ্রী-তে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন। এরপর দেখা গেল গণিতে আমি দৌঁড়ালে, ইংরেজিতে আমি হাঁটি আর বাংলায় আমি হামাগুড়ি দেই। ভাষাটা আমার প্রচণ্ড কাঁচা, লম্বা বাক্য লিখতেই চাই না আর লিখলেই সেটা এতই ধীরগতিতে যে পরীক্ষার সময় চলে যায় কিন্তু আমার লেখা শেষ হয় না।
গতানুগতিক পড়াশোনা আমি একদমই ধরতে পারছিলাম না। কীভাবে প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে হয়, কীভাবে খাতায় লিখতে হয় এমনকী কীভাবে দ্রুত লিখতে হয় সেটাও আমার আয়ত্ত্বে ছিল না। সেবারই প্রথম আমাদের ঘরের কারো জন্য বাজারের লেখা গাইড বই কেনা হয়েছিলো বোঝানোর জন্য যে প্রশ্ন কীভাবে তৈরি করতে হয়। এখনো মনে আছে আমার, ১৪টাকা দিয়ে বাংলা গাইড বই কিনেছিলাম একটা (গাইড বই্টি গোলাপি রঙের ছোট্ট পেপারব্যাকে ছিল বলে আমার খুব ভালো লাগতো, পুরো স্কুলজীবন আমার সংগ্রহে ছিল বইটি)। সেবার কোনমতে টেনেটুনে পাশ করে ইজ্জত বাঁচিয়েছিলাম। নিজেকে খুব অসহায় লাগতো যখন দেখতাম অন্যরা ঝকঝকে অক্ষরে এত দ্রুত লিখে চলে যাচ্ছে, আর আমার খাতায় কাটাকাটি আর কাটাকাটি কারণ আমি সিদ্ধান্তই নিতে পারতাম না কীভাবে লিখবো। এই অসহায় অনুভূতি থেকে একটা অভ্যাস খুব ভালো হয়ে গিয়েছিল আমার, স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগের ফাঁকিবাজ আমি পড়াশোনায় নিয়মিত না হলেও মনযোগী হয়ে উঠেছিলাম। যেটা ধরতাম, একবসায় শেষ করে উঠতাম।
ভাষা নিয়ে আমার এমন কাহিল অবস্থা দেখে আপু একটা খাতা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, প্রতিদিন ডায়েরি লিখবি। একবার বাংলায় লিখবি, সেটাই আবার ইংরেজিতে লিখবি। প্রতিদিন না হলেও এক-দুইদিন পর পরই লিখতাম। আর বড় ভাইয়ের হাত ধরে ছোট ছোট গল্পের বই পড়া শুরু হওয়ার পর বাক্য নিয়ে তেমন একটা সমস্যা হতো না। আরেকটু বড় হওয়ার পর যখন এনি ফ্র্যাংকের ডায়েরি পড়লাম, তখন থেকে একদম পুরোদমে ডায়েরি লেখা শুরু আমার। ছোট্ট এনি'র কল্পনার জগত যেমন বিশাল ছিল, মফস্বলের ওই ছোট্ট ঘরে বসে আমার কল্পনার জগতও অনেক বিশাল হয়ে উঠলো।
সকাল সাতটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত স্কুল করে এসে বাসায় ভাইয়ের সাথে খেলতাম বলে নিজের প্রতিদিনের গল্প লেখার তেমন কিছু ছিলো না। কি লিখবো, কি লিখবো ভাবতাম; আবার না লিখেও ঘুমানো যাবে না! এনি লিখেছে, আমাকেও লিখতে হবে! ওই সময়টাই কাজী আনোয়ার হোসেনের কিশোর উপন্যাস সিরিজ, রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা আর ইসমাইল আরমানের অয়ন-জিমি/ হরর কাহিনি খুব পড়া হতো। দেখা যেত লিখতে লিখতে ওই কল্পনার জগতেই ঢুকে যেতাম। কোনদিন ছোট রাজকুমারের খেলার সাথী তো কোনদিন আমি নিজেই ইতি, আবার কোনদিন ফারিহার মতো দু'বেণী করে ঘুরতাম তো কোনদিন জিনার মতো একগুঁয়ে হয়ে যেতাম, মাঝে মাঝে ঝামেলা র্যাম্পারকট হতেও মজা লাগতো আবার রবিনের মতো পড়ুয়া হতেও চাইতাম। মনে হতো অয়ন-জিমির মতো আমারো একটা শুশুক আছে আবার জ্যোতির মত সাহসীও আমি।
এমন ভাবতে ভাবতে প্রতিদিনের ডায়েরির পাতায় প্রচণ্ড নাটুকে আর স্বপ্নপ্রবণ ছিলাম আমি। তবে এসব অন্যদের দেখানো একদম নিষেধ ছিল, লজ্জা পেতাম খুব। তাই শব্দের ভাণ্ডার ওই অল্পকিছু শব্দতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কি পড়ছি সেটার ওপর ভাইয়ার খুব নজরদারি ছিল, কিন্তু ওর আর আমার বয়সের পার্থক্য খুব বেশি নয় বলে ঠিক বড়মানুষি খবরদারি ও করতে পারতো না, আমার কাছে অত ক্লাসিকও এসে পৌঁছাতো না (তবে বই পড়ায় কোন ঘাটতি ছিল না আমার, ভাইয়ার বিশাল লাইব্রেরির গল্প আরেকদিন করবো)। আমার ভাষা ওই নবিশ ভাষা-ই রয়ে গেল, প্রকাশভঙ্গিও অত সুন্দর-সাহিত্যিক হলো না।
২০১১-এর শেষের দিকে এসে ভর্তি পরীক্ষার চাপ, এরপরের বছর দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে এসে ওই স্বপ্নগুলো একদন শিকেয় উঠলো। ডায়েরি লেখাও একদম বন্ধ হয়ে গেল। ২০১২-এর শেষের দিকে এসে নিজের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। হাতে ল্যাপটপ পেলাম, তখন আমার কলমে লেখার দিন শেষ। চেষ্টা করলাম ডায়েরি নিয়ে বসে লিখতে কিন্তু লিখতেই পারলাম না! এই দু'বছরের বিচ্ছেদে কোথায় যেন সুর কেটে গিয়েছিলো। আগে ডায়েরি লেখা মানে ছিল নিজেকে প্রকাশ করা, স্বপ্নের রাজ্যে হেঁটে বেড়ানো। মনে হলো, তবে কি আমি সব চেপে যাচ্ছি? স্বপ্ন দেখার এই কি তবে শেষ? ভাবলাম, নতুন কিছু শুরু করি, তাহলে বোধহয় লিখতে পারবো। অত ভালো টাইপ করতে পারতাম না, তাও ল্যাপটপে রাত জেগে বসে টাইপ করা শুরু করলাম। আস্তে আস্তে নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যম খুঁজে পেলাম। ফেসবুকে টুকটাক লিখতে শুরু করলাম (এর অন্তত ২বছর আগে থেকেই আমার ফেসবুক আইডি ছিলো, কিন্তু লিখিনি একটা বর্ণও, কারণ নিজের অনুভূতি সবার সামনে নিয়ে আসার জন্য লজ্জাটা কাটাতে পারিনি একটুও)। আস্তে আস্তে লজ্জা কাটতে শুরু করলো, আমার লেখার দৈর্ঘ্যও বাড়তে শুরু করলো। এরপর টের পেলাম, কেউ আসলে আমার বিশেষত্বহীন বড় লেখা ফেসবুকে পড়ছে না (কোন এক বিষয়ে আমি কখনোই আটকে রাখতে পারিনি, যেদিন যা অনুভব করতাম, তা-ই লিখে ফেলতাম কোন এডিট করা ছাড়াই)। এরপর থেকে চলে এলাম এই ব্লগে। জীবনের শুরু হলো বলতে পারেন। কেউ পড়ুক আর না পড়ুক, আমার যা মনে হয় আমি লিখবো। অন্ততপক্ষে নিজেকে প্রকাশ করবোই। অন্য বন্ধুদের দেখতাম, আগে ওয়ার্ড ফাইলে নিজের লেখাটা লিখে এরপর ব্লগে আপলোড দিতো। কিন্তু আমি সেটাও পারলাম না। লিখি তো সরাসরি ব্লগেই লিখি, এখানেই ড্রাফট করি। ওয়ার্ড ফাইলের সেই লুকানো টাইপ করা এক পাতা-দু পাতার দৈর্ঘ্য কমতে থাকলো, আর ব্লগের দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকলো।
লেখক হয়ে উঠতে পারিনি মোটেও, হওয়ার সাহসও রাখি না। ভাষাজ্ঞানে খুবই কাঁচা আমি এবং এটা নিয়ে আমার লজ্জার শেষ নেই। পারিপার্শ্বিক জ্ঞানও আমার একটু কমই অন্যদের তুলনায়। কিন্তু সেই ছোটবেলার ডায়েরি আমার জীবনে অন্য একটা অধ্যায় নিয়ে এসেছে যেটা হয়তো আমার বয়সী আর দশটা মেয়ের জীবনে আসেনি। নিজের মুখে নিজেকে প্রকাশ করতে ভয় লাগতো আমার (এখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে কথা বলি না আমি) কিন্তু লিখতে আমার এতটুকু ভয় লাগেনি কোনদিন। কখনো হয়তো থেমে গিয়েছি, নতুন পথ বেছে নিয়েছি কিন্তু সেই পথ আমাকে অনুভূতি প্রকাশের দিকেই নিয়ে এসেছে। রুপক ব্যবহার করে প্রতিদিনের দেখা ঘটনাগুলো নিয়ে লেখা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, অনেকটা মনের খোরাক যোগায়। এখন এসে যখন কোন রুপক খুঁজে পাচ্ছি না, তখন একদম দিশেহারা অবস্থা। অন্যে কি ভাবলো তা নিয়ে ভাবিনি, তবে কিছু লিখতে পারলে নিজেরই ভালো লাগতো, তৃপ্তি পেতাম। হুট করে একটা ছবি তুলে, নিচে দু'লাইন লিখে ইন্সটাগ্রামে আপলোড দিলেও তৃপ্তি পেতাম। এমন না যে এখন ছবি তুলি না, তুলি; লিখি না, লিখি। কিন্তু ভাষা খুঁজে পাই না, খেই হারিয়ে যায় কোথাও না কোথাও। মাথায় ঘোরা অনুভূতিগুলোর সাথে বস্তুগত ব্যাপারগুলো প্রতিনিয়ত যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে এতই ক্লান্ত হয়ে যায় যে কীবোর্ডের বোতাম পর্যন্ত আর পৌঁছাতে পারে না।
গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যই ক্ষুদ্র স্মৃতির তাই এত বড় চারণ। চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যখন অনুভূতির দরজায় কড়া নাড়তে পারছে না তখন স্মৃতির বাক্স-প্যাটরা থেকে একটুখানি স্মৃতি বের করে নিয়ে রোদে শুকাতে দিলাম। আগামী বেশকয়েকদিনই হয়তো রোজ রোদে শুকাতে দেবো!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:০১