সত্যি ঘটনার ছায়া অবলম্বনে:
আমার ডায়েরির পাতা থেকে.............০২/১০/২০১৪
১৯৯৫ সাল, রাত এগারটা। মা তার চার ছেলে-মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে গর্ব নিয়ে তাকিয়ে আছেন। তার ছেলে-মেয়েগুলো কত লক্ষী! বলামাত্রই রাজি হয়ে গেল এই বছরের ঈদী দিয়ে একটা দেয়াল ঘড়ি কিনতে। ছেলে-মেয়ের টাকায় দেয়াল ঘড়িটা কেনার পিছে মা'র একটা উদ্দেশ্য আছে, ছেলে-মেয়েদের এটা বোঝানো যে নিজের টাকায় দরকারি জিনিস কেনা কতটা আনন্দের! মা ভাবলেন, কাল সকালে ওদের বাবাকে পাঠাবো ঘড়িটা কিনে আনতে, আমার বাচ্চাগুলো অনেক খুশি হবে!!!
পরদিন বিকাল, ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো বাবাকে ঘিরে বসে আছে, ছোটো মেয়েটা অবশ্য কোলেই বসে আছে; ও এতই ছোটো যে এতকিছু বোঝার মত বুদ্ধি হয়ে ওঠেনি, ও শুধু অবাক হয়ে দেখছে ভাইবোন কি একটা প্যাকেট এর চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে!! বড় মেয়েটা বলল, উফফ আব্বু খোলো না প্যাকেটটা! আমরা খুললে যদি ছিড়ে যায়! খোলো, খোলো! দেখবো! বড় ছেলেটা বলল, ঘড়ি আবার ছিড়ে নাকিরে গাধা! সর আমাকে খুলতে দে! বাবা হাসিমুখে ছেলে মেয়ের ঝগড়া দেখতে থাকলেন, ততক্ষণে বড় ভাই-বোনের ঝগড়ার সুযোগে ছোটো ভাই প্যাকেটটা খুলেই ফেলল!!
ঝট করে বেরিয়ে পড়ল ঘড়িটা, কালো ফ্রেম আর সাদা ব্যাকগ্রাউন্ড এর ভিতর তিনটি ছোটো বড় কাটা এক জায়গায় স্থবির হয়ে বসে আছে। এটা দেখে তো ছেলেদের চক্ষু চড়কগাছ!! আব্বা!! তুমি নষ্ট ঘড়ি নিয়া আসছ! ঘড়িতো চলে না! এবার বড় বোনের পালা ছোটোগুলির কান টানার, নতুন ঘড়ি চলে নাকি গাধা! ব্যাটারি দেয়ার আগে!
যাই হোক কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘড়িটাতে ব্যাটারি লাগিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়ার ঘরে টানিয়ে দেয়া হল, আজ তিন ছেলে-মেয়েই প্রতিযোগিতা নিয়ে পড়া শুরু করল। একটু পর পর ঘড়ির দিকে তাকায় আর বলে এই আমি দশ মিনিট পড়লাম, এই আমি আট মিনিট লিখলাম।একটু পর মা ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে সবাই রাত আটটার মধ্যে পড়া শেষ করে রাতের খাবার খাবে, আর রাত দশটার মধ্যে ঘুম, যত পড়াই থাকুক রাত দশটার পর লাইট জ্বলবে না!!
রাত দশটার পর, ঘড়িটা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল, যাক ছেলে-মেয়েরা ঘুমালো, বাড়িটা এত ভালো! বাচ্চাগুলোও লক্ষী, মনে হচ্ছে এই বাড়িতে আমার অনেকদিনই থাকতে হবে!!! তারপর দেখতে দেখতে১৯ বছর কেটে গেল।
আজ ১লা অক্টোবর, ২০১৪, বিকাল ৪টা ৩০ মিনিট।।
ঘড়িটার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে!!
কি হচ্ছে আমার! হাত-পা অবশ হয়ে আসছে কেন!! আজ কেন যেন থেকে থেকেই পুরোনো কথা মনে হচ্ছে আমার, আহহ! কত কিছু দেখলাম এ বাড়িতে! বড় মেয়েটা ইউনিভার্সিটি পাস করল; চাকরি পেল,ওর বিয়েও হয়ে গেল! কি আনন্দেরই না ছিল দিনটা! ওরা আমাকে স্যাভলন দিয়ে মুছে একদম চকচকে করে দিল। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর আমার একটু কষ্টই হয়েছিল অবশ্য, এই মেয়েটাই প্রতি সপ্তাহে আমার যত্ন নিত, ওর সাথে কত ঘটনা আছে আমার!! একবার তো উপর থেকে ধপ্পাস করে পড়লাম আমি, মেয়েটা না ধরলে আর বাঁচতে হতো না!! অবশ্য পরে মেয়েটা ফিরে এসেছিল! ছোটো একটা বাবু নিয়ে, বাবুটাও এখন বড় হয়ে গেছে, দারুন দুষ্ট ওর বাবুটা!! :-) :-) আহহ, খারাপ লাগাটা একটু বোধহয় কমলো, শরীরটা এখন ভাল লাগছে।
একি! আবার খারাপ লাগছে কেন আমার! বড় ছেলেটার কথা মনে হচ্ছে আবার। কতদিন দেখি না ওকে! শুনেছি ও নাকি এখন ডাক্তার হয়ে, বরিশালে থাকে। এই ছেলেটা আরো লক্ষী!!আমার সাজগোজ এর দিকে ওর অনেক নজর ছিল, এই যে আমার গায়ের সূর্যমুখী স্টিকার, এটা ওরই লাগানো। ছোটো মেয়েটা ওকে স্টিকারটা জন্মদিনে উপহার দিল, ওর বইয়ে লাগাতে। ছেলেটা এত ভালো! বইয়ে না লাগিয়ে, আমাকে সাজিয়ে দিল।। :-) এখন আবার একটু ভালো লাগছে, বড় ছেলেটা কি ভালো!!
উফফ! আবারো শ্বাসকষ্ট!! এবার কেন যেন ছোটো ছেলেটার কথা মনে পড়ছে। এই ছেলেটার সাথে আমার সবচেয়ে ভাল সম্পর্ক ছিল। ও ই সবচেয়ে বেশি সময় মানত, পরীক্ষায় লিখতেও পারত ভাল এই কারণে!! ওর রেজাল্ট যখন দিত, আমার এত গর্ব লাগত! আমার কারণে ছেলেটা এত কম সময়ে এত ভাল লিখতে পারে, এটা ভাবলেই আমি খুশিতে একান-ওকান হয়ে যেতাম। ব্যাপারটা ভেবে ভালোই লাগছে এখন, মনে হচ্ছে শ্বাসকষ্টটা একটু বুঝি কমল।
৪টা পঞ্চাশ বেজে গেছে। ছোটো মেয়েটা বুঝি ঘুম থেকে উঠলো!! এসেই একবার আমার দিকে তাকাবে এখন। ওর স্বভাব এটা, এ ঘরে আসলেই আমাকে একবার দেখে যায়। কত ছোটো দেখেছি মেয়েটাকে!! একদম বাবু ছিল একটা!! কিন্তু বড় হয়েই বদ হয়ে গেল, না আছে কোনো সময় জ্ঞান, না আছে কোনো হিসাব! প্রতিবার বাসায় এসে ঘ্যান ঘ্যান করে, আম্মা!! আমি লিখতে পারি নাই সব!! টাইম ই ছিল না!! এই জন্যই আমি মেয়েটাকে সবসময় বলতাম, মেয়ে আমাকে দেখে শেখ! সময় মেনে চল!! কিন্তু এই মেয়েকে শেখায়!! কার সাধ্যি!! দস্যি একটা!! ঐ তো মেয়েটা এল!! তাকাবে এখনই আমার দিকে তাকাবে!! আরেহ তাকালো নাতো!! এই মেয়ে, এই! তাকাও আমার দিকে! শোনো আমি কি বলি!! আরেহ, চলে গেলতো!! এই মেয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে!! হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে!! শোনো যেতে যেতে বলে যাই, তুমি দস্যি মেয়ে, সময় মান না, আমি চলে গেলে আরো দস্যি হয়ে যাবে জানি, তোমাকে বোঝানোর কেউ থাকবে না। সময় দেখ মেয়ে, সব কিছুর সময়, আগে পরে কিচ্ছু হয় না মেয়ে!! সব সময় মেনে হয়!! ৫টা ৪বেজে গেছে, এই দেখ আমার যাওয়াটাও সময় মেনে হচ্ছে!! আর এক মিনিট আছি আমি!! তাকাও আমার দিকে মেয়ে!!
সেই ছোটো মেয়েটি ঠিক ৫টা ৫ এই ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিল দম বন্ধ হয়ে গেছে!! চোখের কোণে কি পানি জমল মেয়েটির!! একটা ঘড়ির জন্য!!
(ঘড়িটা আমার আব্বু কিনেছিল ১৯৯৫ সালে। কোন উপলক্ষ হলেই মা ঘড়ি-কাহিনি শুনিয়ে দিত, কেমন একটা মায়া জমে গিয়েছিল। প্রায় ১৯ বছর পর কাল বিকালে হঠাত করে বন্ধ হয়ে গেল!! নতুন ব্যাটারিতেও কাজ হল না!)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৫৪