ছুটি থাকার কারণে দিনের অনেকটা অংশ আমার কাটছে ল্যাপটপের স্ক্রীনে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কে কেমন পোস্ট দিচ্ছে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি ক'দিন ধরে। পোস্টগুলোর সারমর্মের কথা যদি বলিঃ
ঈদের আর মাত্র দেড়-দিন বাকী। প্রত্যেকের ওয়ালে সাজ সাজ রব। গত বৃহস্পতিবার থেকেই ঢাকায় বসবসারত মানুষের বিরাট এক অংশ গ্রামে যাওয়া শুরু করেছেন পরিবারের সাথে ঈদ করবেন বলে। প্রত্যকের অভিযোগ হাইওয়েতে প্রচন্ড জ্যাম আর ঢাকাবাসীর শান্তির নিঃশ্বাস যে অনেকদিন পর ফাঁকা ঢাকা পেয়েছেন তারা। (আমি নিজেও এই সুযোগে ঢাকার রাজপথের জ্যামহীন ছবি তুলেছি ) কে কেমন পোষাক পড়বেন, কার জন্য কি গিফট নিয়ে বাড়ী যাচ্ছেন, কার কাছ থেকে কোন গিফটটা পেলেন এসব শেয়ার করাতেও পিছিয়ে নেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। কেউ আবার পোস্ট দিচ্ছেন গরু কিনে বাড়ী ফিরলাম, এবার গরুর দাম একদম আকাশ ছোঁয়া, তারপরও কিনেই ফেললাম বাজেটের মধ্যে। সব মিলিয়ে প্রায় প্রত্যেকের ওয়ালেই রঙ আর রঙ, ঈদের রং। সবাই আপনজন-কাছের মানুষ-প্রতিবেশী-বন্ধুদের সাথে একদম ছুটি শুরুর সাথে সাথেই আনন্দ ভাগাভাগিতে মেতে আছেন।
এই রঙের বাইরেও একধরনের আদিখ্যেতা কেমন যেন চোখে লাগছে কট করে। কুরবানীর পশুর সাথে সেলফী, ছবির উপরে দামের ক্যাপশন, কেউ দাম জানতে চাইলে একদম কমেন্টেই জনসম্মুখে দাম প্রকাশ, কার কেনা পশু কত বড় সেটা নিয়ে আলোচনা, কে দামে ঠকলো, কে দামে জিতলো সেটা নিয়ে অতি-চর্চা, কার কেনা পশুর রঙ কত ভালো, মাংস কত কেজি হবে এটা নিয়ে চায়ের কাপের ঝড় ইত্যাদি ইত্যাদি কেন যেন ঠিক হজম হতে চাইছে না! কুরবানীর পশুর ছবি যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়াটাকে আমি সমর্থন না করলেও আবার অসমর্থনও করতে পারি না। কিন্তু এই ছবি ঘিরে উদ্ভট আলোচনাগুলোকে একদমই সমর্থন করতে পারি না। কেন যেন মনে হচ্ছে এরপরে দেখবো কেউ একজন প্রিজমা আকারেও তার কুরবানীর পশুর ছবি আপলোড করছে, সাথে বাড়িয়ে চড়িয়ে, ইনিয়ে বিনিয়ে দামটা বলছে আরো নানান রকম হলুদ কাজ করছে।
অন্যকে ছোট করার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ধর্ম হচ্ছে একজন মানুষের বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশি আমরা আমাদের ধর্মের প্রতিনিধিও। আমরা কীভাবে কথা বলছি, কতটুকু মানবিকতা ধারণ করছি এগুলো আমাদের ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে ধর্মবোধকেও প্রকাশ করে। ধর্ম সম্পর্কে খুব বেশি থিওরী জানার সুযোগ আমার হয়নি। আমার ধর্মশিক্ষার পুরোটাই হয়েছে আমার মায়ের কাছে। স্কুলে সরাসরি ক্লাস থ্রী-তে ভর্তি হলেও ধর্ম সম্পর্কে একটু একটু জ্ঞান আম্মা দেয়া শুরু করেছিলেন সেই তিনবছর বয়স থেকে। মনে আছে আমার সকালে ঘুম থেকে উঠে বড় তিনভাই-বোন এবং আরো ছয়জন কাজিনের সাথে আরবী পড়তে বসতে হতো আমার। অনেক ছোট হওয়ায় আধো আধো বলে সুরা পড়লে সবাই খুব মজা পেত। রাতে ঘুমানোর সময় আম্মা সুর করে গজল গাইতেন আর আমি সকালে শেখা সুরার এক/দু' আয়াত আম্মাকে শোনাতাম। এভাবে অক্ষরজ্ঞান হওয়ার আগেই দশটি সুরা আএবং প্রয়োজনীয় দোয়া আম্মা মুখে মুখেই পড়িয়ে ফেলেছিলেন। এখানেই থেমে থাকেননি অবশ্য। আরেকটু বড় হওয়ার পরে গল্পচ্ছলে হাদীস, সুরার শানে নুযুল শোনাতেন তিনি। ধর্ম আমি কীভাবে পালন করবো এটা আম্মা এখন আমার উপরে ছেড়ে দিলেও ছোটবেলায় ঠিকই নিশ্চিত করেছিলেন আমি যেন যুক্তি এবং অযুক্তির পার্থক্য বুঝি, ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ যেন আমাকে অধর্মের পথে, অমানবিকতার পথে নিতে না পারে। যুক্তি! যুক্তি! সকল ঘটনার পেছনেই কারণ এবং ব্যাখ্যা আছে এই ব্যপারটা তিনি একদম রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন সমাজ নামক বিশাল ময়দানে। আমি জানি প্রত্যকের বাবা-মা নিজের সাধ্যমত সর্বোচ্চ শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছেন তার সন্তানকে। আমরা সবাই শিখেছিও সেভাবে।
আমার প্রশ্ন, আমরা কি আমাদের সেই শিক্ষার কোন অংশ ভুলে গিয়েছি?? আমারা কি ভেসে যাচ্ছি? নাহলে কেন এই আদিখ্যেতা??
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদেরকে একদম সবার দরজায় পৌঁছে দিচ্ছে। পাড়া-এলাকা-দেশ-বিদেশের বন্ধুদের সাথে কথা বলছি আমরা এখানে। একসাথে হয়ে ভালো কাজ করছি। যেমনঃ কয়েকজন সিনিয়র আছেন আমার যারা ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে পথশিশু-ছিন্নমূল শিশু এবং যারা আমাদের সমান সমান আনন্দ নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারছে্ন না তাদের জন্য চ্যারিটি করছেন, স্পন্সর জোগাড় করছেন, মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন, নিজেরদের আনন্দ ওদের সাথে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন আবার ওদের কষ্টে সামিল হচ্ছেন। হ্যাঁ, আমাদের বেশিরভাগই যে আমাদের পরিচয় ভুলে যাইনি, মানবিকতা ভুলে যাইনি তাও আমি জানতে পারছি ওই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেই। অল্প সংখ্যক আছেন যারা এখনো আদিখ্যেতার পুকুরে সাঁতার কাটছেন। (খেয়াল করবেন আমি সাগর বলিনি। কারণ ব্যক্তিগতভাবে মনে করি মানবিকতার সাগর হয়, আদিখ্যেতা ওই ছোট পুকুরেই আটকে থাকে)
"মহেশ" ছোটগল্পটি পড়ার পরে বড়বোনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা আপু! ঈব্রাহীম (আঃ) তো নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি আল্লাহ'র নামে কুরবানী দিতে চেয়েছিলেন। আমরা তো এখন পশু কুরবানী দেই! পশুকে যদি মহেশের মত ভালো না বাসি তাহলে কি কুরবানী কবুল হবে??? আপু উত্তরে বলেছিলেন, কুরবানী কবুল হবে কিনা সেটা একমাত্র আল্লাহ বলতে পারেন। তবে কুরবানী মানে কিন্তু শুধু পশু কুরবানী নয়, নিজের মনের পশুত্বকেও কুরবানী করা হয় তখন। জীবনকে উদযাপন করা হয় তখন। তুমি যদি প্রতি ঈদে নিজের একটি খারাপ কাজ খুঁজে বের করে আর সেটি না করার প্রতিজ্ঞা করো এবং তাহলে কিন্তু ভালো জীবনের পথে তুমি আরেকধাপ এগিয়ে গেলে, জীবনকে আরেকটু ভালো করে উদযাপন করলে!
পাশের বাড়ীর এক আঙ্কেল ছিলেন যিনি ঈদের অন্তত তিনদিন আগে গরু কিনে আনতেন। এই তিনদিন উনি সারাদিন ওই গরুর সাথে কাটাতেন। শুনেছিলাম এতে কুরবানীর সময়ে যে কষ্টটা হয় সেটা উনি অনুভব করতে চাইতেন, ত্যাগের মহিমা অনুভব করতে চাইতেন। আশেপাশের বাচ্চারা ওই তিনদিনে গরুর সাথে খেলতে আসতো, অনেকে ওই গরুর জন্য খর নিয়ে আসতো খাওয়াবে বলে। একদল বাচ্চা ছিল যারা এলাকায় ঘুরে ঘুরে এই কাজই করতো একদম ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত। এরপরে কুরবানী হয়ে গেলে এদের মন খারাপ হতো একদম দেখার মতো কারণ ঘুরতে ঘুরতে প্রত্যেকেই কোন না কোন বাড়ীর কুরবানীর পশুর সাথে বন্ধুত্ব করে আসতো। সেই ছোট বয়সে মফস্বল এলাকায় ইন্টারনেট ছিল না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি জিনিস তা ওরা জানতোই না কিন্তু মানবিকতা জানতো, মায়া বুঝতো, কুরবানীর মানে বুঝতো।
এখনকী আমরা এই সময়ে এসে সেটা বুঝি? মনে রেখেছি??
এখনকী আমরা রাতে গেটের পাশে রাখা গরুটির কান্নাভরা হাঁক শুনে বলে উঠি, আহারে! নাকি সেই শব্দ রেকর্ড করে আপলোড দিয়ে বলি, গলায় জোড় আছে! এখনকী আমরা পশুটির গায়ের রঙ দেখে ভাবি, আহা! কী সুন্দর! একটু পরেই ওকে নিয়ে যাবে! আর দেখবো না! নাকি অন্য ফ্রেন্ডের ওয়ালে কালো তাগড়া গরুর ছবি দেখে নিজে এগিয়ে থাকার জন্য নিজের লাল গরুটার ছবি আপলোড দিয়ে বলি, ড্যাম কিউট! মায়া থাকে ওই কিউট বলার মধ্যে? নাকি শুধুই আদিখ্যেতা? প্রতযোগিতায় ঢুকে যাচ্ছি নাতো আমরা! কার গরু কত বড়, কারটার দাম বেশি এসব দিয়ে যে কুরবানীর আসল অর্থ নির্ধারিত হয়না সেটা কি আস্তে আস্তে আমাদের মস্তিষ্কের তলানীতে চলে যাচ্ছে?
নাহলে আমরা পশু জবাইয়ের ভিডিও কেন আপলোড দেবো??? কেন রক্তাক্ত ছুড়ি সহ নিজের ছবি আপলোড দিয়ে বলবো , আহা! কেটে আসলাম! অনেক কাজ করলাম! সৃষ্টিকর্তার নামে কুরবানী করছি- এই ধারণা থেকে যেন ঈদের দিনে অত বেশি টাকার পশু জবাই দিচ্ছি - এই ধারণায় ঢুকে না যাই আমরা।
কুরবানীর পশুটির প্রতি মমত্ববোধও কিন্তু কুরবানীর একটি অংশ। সকল জীবের প্রতি সম্মান প্রদর্শনও আমাদের মূল্যবোধের অংশ। এবং পাশে বসে থাকা শিশুটি আমার মূল্যবোধ থেকে কি শিখছে সেটি নিশ্চিত করাও আমাদেরই দায়িত্ব। তাহলে কেন আমরা মূল্যবোধ ভুলে কাটাতারে ঝোলানো মাংস প্রসেসিং এর দৃশ্য সবাইকে দেখাবো! কেন এই আদিখ্যেতা করবো!
আমার একান্তই ব্যক্তিগত কিছু মতামত শুধু প্রকাশ করলাম এখানে। আবারো বলছি, কেউকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। যা মনে রাখুন বা না রাখুন শুধু এতটুকু অনুরোধ মনে রাখুন, আজকে আপনি যে বোকামীটুকু করছেন যে আদিখ্যেতা দেখাচ্ছেন তার ফলাফল এখন টের না পেলেও ১০বছর পরে ঠিকই টের পাবেন যখন আপনার সন্তান এরচেয়ে বড় কোন আদিখ্যেতা দেখিয়ে ফেলবে যেটা সরাসরি আপনাকে এসেই আঘাত করবে অথবা আপনার সন্তানকে। এটা ভুলে যাবেন না আমাদের ভালো ব্যাপারগুলো যেমন আমাদের সন্তানেরা আরো ভালোর দিকে নিয়ে যাবে, আমরা যদি তাদের সামনে সঠিক উদাহরণ রাখতে না পারি তারা আমাদের ওই ভুল উদাহরণগুলোকে আরো বড় ভুল করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতেও পারে!
ঈদের শুভেচ্ছা সবাইকে! ঈদের সাজ সাজ রব থাকুক, সবার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি চলতে থাকুক। কিন্তু রঙের জায়গায় যেন রক্ত স্থান না নেয় সেই আশাই করি। (প্লিজ এমন ভিডিও এবং ছবিগুলো শেয়ার করবেন না!)
!ধন্যবাদ!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:০৩