এইতো কিছুক্ষণ পরেই আমার জন্মদিনের ঘন্টা বাজবে। এমন না যে আমার সব জন্মদিন খুব সুখের কেটেছে। তবে যত দুঃখের পাহাড়ই আমার মাথায় ভেঙ্গে পড়ুক না কেন, নিজের জন্মদিনের উপর আমি কখনো সেই দুঃখের ছায়াও পড়তে দেইনি।
প্রথম জন্মদিন পালনের কথা যেটা মনে পড়ে, তখন আমার বয়স ছয় বছর। মফস্বলে থাকতাম, কেক-এর তেমন প্রচলণ ছিল না সেখানে; অর্ডার না দিলে কেক পাওয়াও যেত না হুটহাট। তিন টাকা দিয়ে পেস্ট্রী পাওয়া যেত তখন। এরকম বারোটা পেস্ট্রী এনে জোড়া লাগিয়ে কেক বানিয়েছিল আপু-ভাইয়ারা, মা ভালো ভালো খাবার রান্না করে আশেপাশের বাচ্চাদের ডেকে এনেছিল সন্ধ্যাবেলায় কেক কাটার জন্য। সাত অথবা চৌদ্দ টাকা দিয়ে কমিক বই পাওয়া যেত তিনটা। ছোট ভাইয়া সেটাও কিনে এনে রেখেছিল স্কুল থেকে ফেরার সময়। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সন্ধ্যায় কারেন্ট চলে গিয়েছিল, পরে মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কেটেছিলাম আমি, কেকের উপর গোলাপী আর সবুজ রঙের ফুলও ছিল অনেকগুলি। এরপরের সবগুলো জন্মদিনই মনে আছে আমার।
সবচেয়ে বেশি যেটা মনে আছে সেটা ২০০৬ সালের। সেবার আমার বৃত্তি পরীক্ষা ছিল ক্লাস এইটের, কোচিং করতাম স্কুলে; খুব পড়াশোনার চাপ, তাই গল্পের বই পড়ার উপর আব্বা আর আপু কড়া নজরদারি করতেন। আমি গলা তুলে ঝগড়াও করতাম তাদের সাথে এটা নিয়ে! কেন আমাকে বই পড়তে দেয় না! ওই বছরেরই প্রথমদিকে লুকিয়ে লুকিয়ে সমরেশ মজুমদারের কালবেলা আর কালপুরুষ পড়েছিলাম (বয়সের কারণে ওই বই দুটি পড়া বারণ ছিল আমার)। পড়ার পরে ধরাও খেয়েছিলাম আপু আর ছোট ভাইয়ার কাছে। কিন্তু ছোট বলে যে ধরণের প্রভাব আমার উপরে পরবে বলে তারা আশংকা করছিলেন তেমন প্রভাব পরেনি আমার উপর এবং আসলেই বই দু’টির সারকথা ধরতে পেরেছিলাম বলে বেঁচে গিয়েছিলাম সেবার। যাই হোক! সে অন্য এক কথা! অন্যান্যবার আগেরদিন থেকেই আমি জানি যে কাল কি কি রান্না হবে, কি কি হবে বাসায়। কিন্তু সেবার আমার জন্মদিন পালন করার কোন সুযোগ ছিল না বাসায়, অন্তত আগের রাত পর্যন্ত আমি তা-ই জানতাম! সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বালিশের পাশে শক্ত কি যেন! হাতে নিয়ে দেখি, ওমা! বই! সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিনী! চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
এই বই এইখানে কে আনসে রে! কার বই!
আপু মিটিমিটি হেসে বললেন, খুলেই দ্যাখ কার বই! সেবার বিকালে আমার খুশি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল যখন দেখলাম আপু এক হাড়ি নুডলস রান্না করে, বাইরে থেকে বিরাট এক চকলেট কেক আনিয়ে আমার স্কুলের বান্ধবীদের ডেকে নিয়ে এসেছেন!
বয়ঃসন্ধিকালে পরিবার থেকে একটু দূরে সরে গিয়েছিলাম। তখন মনে আছে মা একবার বলেছিলেন,
“তোমার জন্মদিনে আমি সবসময় কোন না কোন স্পেশাল কিছু রান্না করি কেন জানো? কেন আমরা সবাই এত মজা করি জানো? কারণ, এইদিনে তোমাকে আমি প্রথম কোলে নিয়েছিলাম। নয় মাস প্রচন্ড কষ্ট করার পর তোমার মুখ দেখে সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম। অনেকদিন আমাদের ঘরে আনন্দের কোন উৎস ছিল না, তুমি আসার পর সবাই খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। কার কাছে কি জানি না! কিন্তু আমাদের কাছে তুমি স্পেশাল! আর এটাই বড় কথা!”
এর আগে চাচা-মামা’রা খুব খেপাত, “তোর জন্মদিন পালনের এত কী আছে! তোকে এত উপহার দেয়ার কী আছে! তোকে তো ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে এনেছি!” কিন্তু মা ওই কথা বলার পর থেকে আমি জানতাম যে, নাহ! আমি স্পেশাল! আমার জন্মদিনের অনেক দাম! মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলাম আমি! বাবার কাছে তো আমিই সেরা! ভাইদের কাছে আমিই সেই হাবাগোবা ছোট বোন! আর আপুর তো আমার কাছে পেটের সব গোপন কথা না বললে চলেই না!
এরপর থেকে আমি আমার প্রতি জন্মদিনেই রাত বারোটা বাজার অপেক্ষা করি। বারোটা বাজলেই সবার আগে নিজেই নিজেকে বলি- শুভ জন্মদিন প্রিন্সেস! আজকে কোন দুঃখ নয়! কোন ঝগড়া নয়! কোন মন খারাপ করা নয়! তুমি স্পেশাল! আজকের দিনটা স্পেশাল! কারণ তুমি এদিনে পৃথিবীতে এসেছো। জীবনের এত ভালো কিছু দেখতে পেরেছো শুধুমাত্র আজকের দিনটির কারণে। সবাই তোমাকে ভালোবাসে কারণ পৃথিবীতে তাদের সামনে তুমি আজকে হাসছো, নাচছো, আনন্দ করছো, দুঃখ পেলে জড়িয়ে ধরছো! সব আজকের দিনের জন্যই! তাই আজকে সকল কিছু মাফ! আজকে শুধু হাসি-মুখ আর খুশি! আজকে শুধুই তোমার দিন! সারাদিন আড্ডা, আপুর হাতের রান্না, মায়ের কাছে আবদার, আব্বু-ভাইয়া-ভাবী সবাইকে ধরে ধরে বলা- কি উপহার দেবেন আমাকে! এসব “ছেলেমানুষী” গতবছর পর্যন্ত করেছি। এমনকী বন্ধুদের কাছ থেকেও চেয়ে চেয়ে উপহার নিয়েছি গতবছর পর্যন্ত! কী দিবি আমাকে! এহহ! দিবি না কেন! জন্মদিনে দিবি না কেন!
এমন না যে আমি নিজের জন্মদিনেই শুধু এমন করি। আমার আশেপাশের প্রত্যেকের জন্মদিন মনে রাখার বাতিক আছে আমার। এবং প্রত্যেককে উইশ করা, সাধ্যমত এবং তার পছন্দমতো উপহার দেয়ারও বাতিক আছে আমার। আমি মনে করি, জন্মদিনে অন্যকে খুশি করার চেয়ে সুখের কাজ আর হতেই পারে না! এমনকী তাদের জন্মদিনে তাদের সকল অত্যাচার-আবদার সহ্যও করি! এই বছরই এক বন্ধুর জন্য তিন ঘন্টা প্রচন্ড রোদের মধ্যে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করার অভিজ্ঞতাও হয়েছে আমার, শুধুমাত্র তার জন্মদিনকে বিশেষ বানানোর জন্য। অনলাইনে যত স্বল্প পরিচিতই হোক, ব্যক্তিগতভাবে শুভকামনা জানাতে ভুলি না আমি খুব একটা।
এতকিছু বলার পেছনে উদ্দেশ্য মোটেও নিজেকে জাহির করা নয়। এবছর এমন কিছু ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখতে হয়েছে যে এসব আমি না বলে পারছি না। এমন কিছু ঘটনা আমি ঘটতে দেখেছি যে একটা সময়ে আমার মনে হয়েছে, উহু! সবাই স্পেশাল নয়! সব মানুষ ইউনিক নয়! আমি সবার ভালোবাসা পাবার যোগ্য নই, আমি অত গুরুত্বপূর্ণ নই! আমাকে কষ্ট দিতে কারো গায়ে বাঁধে না! নিজের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, আমাকে কষ্ট দেয়াটাকেই বেছে নেয় মানুষ! আমার হাসির কোন দামই নেই! আমার খুশির কোন দরকারই নেই যেন! (প্লিজ ভাববেন না যে আমার ব্রেক-আপ হয়েছে বা পরিবারে কিছু হয়েছে! তবে অন্যকিছু কারণে সাময়িকভাবে বিরাট একটা পরিবর্তন চলে এসেছে আমার মানসিক গঠনে)।
আসলেই বোধহয় আমি গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য নই, আমি স্পেশাল নই - এই ধারণা মনে গেঁথে যাওয়ার পরে আমি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া শুরু করেছি সবকিছু থেকে; যেটা প্রচন্ড মানসিক চাপও তৈরি করেছে মনে। এরপরও একটা আশা ছিল যে এক্সপার্টদের সাথে কথা বলছি, সময় যাচ্ছে, সামনে আমার জন্মদিন আসছে, এই হীন্যম্মন্যতা থেকে ঠিকই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবো আমি! কিন্তু আজ এসে মনে হচ্ছে, বারোটা বাজলে কি বলতে পারবো! হ্যাপি বার্থডে প্রিন্সেস! গলার কোথায় যেন আটকে যাবে! অথচ একটা সময়ে আমি ভাবতাম জন্মদিন মানেই ভুবন ডাঙ্গার হাসি! নিজেও হাসতাম, অন্যদের মাঝেও অন্তত তাদের এই দিনটাতে হাসি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতাম!
আজকে এই অবস্থায় এসে কেন যেন, নিজের জন্মদিনের গুরুত্বটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি! একটুখানি হাসির গুরুত্ব যে কত! এইদিনটা যে আমার আত্মবিশ্বাসের কত বড় উৎস, সেটা আমি আজ টের পাচ্ছি!
আমি জানি আমার মনে যা গেঁথে গিয়েছে তা প্রচন্ড রকমের ভুল ধারণা, মানুষের জীবনে এমন এক-আধটা ঘটনা চলেই আসে তাও আমি জানি। সময়ের সাথে আমিও কাটিয়ে উঠবো এটা- সেই বিশ্বাসও আমার আছে। কিন্তু এই একটা জন্মদিনের দুঃখের কথা হয়তো আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না! যখন হাসতে গিয়েও গলায় আটকে যাচ্ছিলো আমার!
না, আমার এই বিষন্নতার জন্য অন্য কাউকে দোষ দেই না আমি। আমি জানি প্রতিটি মানুষ আলাদা, তারা অন্যরকম আচরণ করবেই আমার থেকে! এটাই নিয়ম! আচরণগুলো সামলে নেয়ার মত মানসিক শক্তি ফিরে আসবেই একটা সময়ে- এটাও জানি আমি।
তাই বলছি, নিজের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে ওই হাসির কোন বিকল্প নেই, বাস্তববাদীতারও কোন বিকল্প নেই। আর এই আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে নিজের জন্মদিনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এইদিনে “আপনি” এসেছিলেন, আপনি এসে কিছুটা হলেও পার্থক্য তৈরি করেছিলেন পৃথিবীতে, আপনার মা প্রচন্ড কষ্টের পরও ভুবনভোলনো হাসি হেসেছিলেন আপনার কান্না শুনে। আপনার বাবা প্রচন্ড গর্বের সাথে ভেবেছেন, বাহ! আমার একটা অংশ! আপনার ভাই-বোন আপনাকে পুতুল ভেবে খেলেছে। আপনি আপনার ছোট ছোট হাসি আর ভালোবাসার মুহুর্ত দিয়ে প্রিয়জন আর বন্ধুদের জীবনেও কিছু না কিছু পরিবর্তন এনেছেন। জীবনে যাই ঘটে থাকুক না কেন, এই দিনটিতে হাসতে কখনো ভুলে যাবেন না যেন! নিজেকে বলতে ভুলবেন না, “তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙ্গার হাসি! তোমায় আমি ভালোবাসি!”
ভুলে যাবেন না আপনার প্রিয়জনদের জন্মদিনকেও।
আমি নিজেও আশায় আছি, কে জানে! হয়তো আমি নিজেও কালকে বলতে পারবো, সোনার মেয়ে তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙ্গার হাসি! তবে এতটুকু জানি- বলতে পারি আর না পারি, চেষ্টা আমি করবোই। যতই গলায় আটকে যাক, আমি হাসবোই! আপনিও চেষ্টা করতে ভুলবেন না যেন!
!ধন্যবাদ!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:৩৫