সেদিন এক বন্ধু বলছিলো - এখন তুই কাশি দে, তোকে ২ঘন্টা পরই ডাক্তার-এর কাছে পাঠাবে। কালকে কেউ তোর পার্স ছিনতাই করুক, তুই সাথে সাথে থানায় গিয়ে মামলা করে আসবি। কিন্তু আজকে তুই ডিপ্রেশনে ভোগ, তুই কাউকে সেটা বলবি না! নিজের মধ্যে চেপে রাখবি, বেশি হলে গুগল মামাকে জিজ্ঞেস করে এরপর চুপ করে ঘরে বসে থাকবি। একটা সময় ভয়াবহ ডিপ্রেশনের শিকার হলে হয়ত পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পারবে কিন্তু সবাই চেপে যাবে। ভাববে, হায় হায়! আমার মেয়ে পাগল! চুপ চুপ! এই কথা কেউকে বলা যাবে না! আর নাহলে, নিজেরাই তোকে ইচ্ছামত ব্রেইনওয়াশের চেষ্টা করবে, কিছু না পারলে ধরে মারবে। তাও কোন কাউন্সেলর এর কাছে নিয়ে যাবে না। যতই বলিস যে সুস্থতার জন্য শারীরিক, মানসিক আর সামাজিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে সেটায় কাজ হয় না রে বোন! তোর শারীরিক আর সামাজিক সুস্থতা নিয়ে সবারই মাথা ব্যাথা আছে কিন্তু তোর মানসিক সুস্থতাকে কেউ ঘন্টাও দাম দেয় না।
আমিও চিন্তা করে দেখলাম, কাহিনী তো সত্যি! আসলেই তো আমরা মানসিক সুস্থতাকে ঘন্টাও দাম দেই না! আমি নিজেই দেখেছি, অভিভাবক সন্তানের ঘাড়ে তুলে দিচ্ছে তার চেয়েও বেশি ওজনের ব্যাগ আর ঠেলে দিচ্ছে টিউশনের গোলক ধাধায়। সবারই ইচ্ছা, আমার বাচ্চা রেসে ফার্স্ট হবে, সামাজিকভাবে সুস্থ থাকবে। কিন্তু এই সামাজিক সুস্থতা আনতে গিয়ে বাচ্চাটাকে যে কি পরিমাণ মানসিক বলি দিতে হয় তা কেউ একবার ভেবেও দেখে না।
টিনএজ বয়সে এসে এই রেসে দৌড়াতে দৌড়াতে বাচ্চাটা বাবা-মা কে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় অনেক সামনে। একা পথে দৌড়াতে ভয় পায় তারপরও একবার কারো সাহায্যের জন্য মুখফুটে বলে না, শারীরিক আর সামাজিকভাবে দুর্বল প্রমাণিত হবে যে! এটা হতে দেয়া যাবে না! যা হয় হোক! নিজের মনে কষ্ট থাকুক, একা হাটার ভয় থাকুক কিন্তু আমি বাইরে দৌড়াতে থাকি।
আরেকটু বড় হলে হয়ত প্রেমে পড়ে অথবা প্রেম ভেংগে যায়। তখনও মুখ ফুটে বলে না কিছু। যত্ন করে আড়াল করে রাখে ওই মনটাকে।
আরেকটু বড় হলে, ভালো ক্যারিয়ার আর উচ্চ শিক্ষার জন্য দৌড়াদৌড়ি। এখানেও সামাজিক এবং শারীরিক সুস্থতার লড়াই আর মানসিক সুস্থতা লুকিয়ে থাকে একদম খাটের তলানীতে।
এরপর বিয়ে করো লাখ লাখ টাকা খরচ করে, বাচ্চা সামলাও, বাবা-মায়ের দায়িত্ব নাও। সুতরাং আবার দৌড়াও। দৌড়াতে দৌড়াতে সবার সামাজিক আর শারীরিক সু-স্বাস্থ্য নিশ্চিত করো কিন্তু নিজের মনটা লুকিয়ে থাকুক খাটের তলাতেই!
এই খাটের তলায় লুকিয়ে থাকা মানসিক স্বাস্থ্যকে যে আর লুকিয়ে রাখতে পারে না তার মধ্যেই দেখা দেয় হাইপার একটিভ ডিজঅর্ডার, হিংস্রতা আর না হলে নির্বাক আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা (আরো আমার অজানা নানান ব্যাপার)। নিজের মনকে লুকিয়ে রেখে নিজের ক্ষতি তো হয়ই সেটা জানা কথা কিন্তু একটা সময়ে যদি মানুষ অন্যের ক্ষতিও শুরু করে তখন কিন্তু ওই সামাজিক আর শারীরিক স্বাস্থ্যও আসমানে ওঠে!
বাচ্চার সাথে আধা ঘন্টা খেললে তার পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে যদি তাকে রেসের ঘোড়ায় চড়িয়ে দেন, পাশের মানুষটিকে কাউন্সেলরের কাছে পাঠালে সমাজ তাকে পাগল চিহ্নিত করবে এই ভয়ে যদি ঘরে বসে থাকেন, আর নিজেও রেসে দৌড়াতে গিয়ে কাছের মানুষের সাথে কথা বলতে ভুলে যান তাহলে একদিন দেখবেন আজ যে শারীরিক আর সামাজিক সুস্থতার পেছনে দৌড়াচ্ছেন তার আর নাগাল পাচ্ছেন না। কতদিন আর অমুকে কি ভাবলো, তমুকে কতবার কাদলো ভেবে নিজেকে আড়াল করবেন! কতদিন আর মুখে সাময়িক হাসি ফোটাতে গিয়ে নিজের সারাজীবনের হাসির বলি দেবেন! কতদিন আর জীবন সিড়ি উপরে ওঠাতে গিয়ে মাথার চুল সাদা করবেন! একটা সময়ে যখন থামবেন তখন দেখবেন আর কেউ হাসছে না! আপনিও পারছেন না হাসতে! পাশে হাত ধরে হাটার জন্য যাকে চেয়েছিলেন সে হয়ত মানসিকভাবে এতই মরে গিয়েছে যে আপনি আর তার হাতটা ধরেও কিছু অনুভব করছেন না। আদরের বাচ্চাটাও হয়ত আবার আপনার মত একই রেসে দৌড়াচ্ছে। আপনি যা করেছেন, সেও হয়ত তা করছে।
জীবন একটা চক্রের মত। সুস্থ চক্র চাইলে আপনাকে শারীরিক, সামাজিক আর মানসিক- সকল সুস্থতার দিকেই সমান মনযোগ দিতে হবে। আর তার জন্য মরীচীকার পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করতে হবে। স্বপ্নের সাথে হাটুন, সাথে দৌড়ান, সাথে নাচুন, সাথে হাসুন! পেছনে দৌড়াবেন না আর তাকে পেছনে ফেলে চলেও যাবেন না।
শেষ হাসিটা আসবে তাহলে! আহা! জীবন কত সুন্দর!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৩:৫১