পৃথিবীতে এমনকিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, যাদের জন্মটা পৃথিবীর জন্য অত্যান্ত আর্শিবাদ। এদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ যারা নির্লসভাবে সারাজীবন কাজ করে যান। জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পরও প্রচার প্রচারণার অভাবে বিশ্¦ব্যাপী বা দেশব্যাপী পরিচয় পান না। নিজেরাও কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পরিচিত হন না। উনারা কাজ করে যান নিরবে, নিবৃত্তিতে। পরিচয় পাক আর না পাক এ নিয়ে উনারা কখনো মাথা ঘামান না। উনাদের কথা হচ্ছে কাজ করবেন, মানবসেবায় নিয়োজিত থাকবেন। এমন একজন মানুষ হচ্ছেন আমাদের আলহাজ্ব মোহাম্মদ নুরুল হক। পৃথিবীর আর্শিবাদ নিয়ে ১ লা অক্টোবর ১৯৩৬ সালে ব্রাক্ষণবাড়ীয়া জেলার, কসবা থানার খেওড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উনার পিতার নাম মৃত: মিরাজ আলী, মাতা মৃত: আয়েশা খাতুন। উনার শিক্ষাজীবন থেকেই উনার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি
শিক্ষাজীবন:
১৯৪৬ সালে জমশেরপুর মাদ্রাসা থেকে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় ( ৪র্থ শ্রেণী) ১ম গ্রেডে বৃত্তি প্রাপ্ত হন। তখন উনার বয়স ছিল দশ বছরের ও কম। তারপর ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা জেলা জুনিয়র মাদ্রাসা বোর্ডের ১ম গ্রেডে বৃত্তি প্রাপ্ত হন। ১৯৫৩ সালে জমশেরপুর মাদ্রাসা হতে এসএসসি/সমমান ( ঢাকা বোর্ড) ১ম বিভাগ মেধানুসারে ৪র্থ স্থান লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা মহাবিদ্যালয় হতে এইস এস সি ( ঢাকা বোর্ড) ১ম বিভাগ মেধানুসারে ৫ম স্থান লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বি এ ( অর্নাস) ২য় শ্রেণী মেধানুসারে ৪র্থ স্থান লাভ করেন ( ঐ বৎসর ১ম বিভাগ ছিল না)। ১৯৬২ সালে কুমিল্লা শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় ( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে) হতে বিএড ( ১ম শ্রেণী) মেধানুসারে ৩য় স্থান লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিরাগত পরীক্ষার্থী ( প্রাইভেট) হিসাবে ২য় শ্রেণী এমএ অর্জন করেন।
ব্যক্তিজীবন:
১৯৫৬ সালে নিজ গ্রামে অর্থাৎ খেওড়া গ্রামের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব মরহুম জনাব চাঁন মিয়া আমীনের ২য় মেয়েকে বিবাহ করেন। ১৯৯৮ সালে স্বস্ত্রীক পবিত্র হজ্জ পালন করেন।
কর্মজীবন:
১৯৫৮ হতে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক হিসেবে জমশেরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৭-১৯৮৬ সাল পর্যন্ত একই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬-১৯৯৩ ইং পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে সরাইল অন্নদা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৩-১৯৯৫ ইং পর্যন্ত কুটি মিয়া আব্দুল্লাহ্ ওয়াজেদ মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কালসার নাঈমা আলম কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ( প্রতিষ্ঠালগ্নে) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সমাজসেবা:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে ইউনিয়ন পরিষদ অত্যাদেশ ১৯৭২ এর অধ্যাদেশ ১১ নং মেহারী ইউনিয়নের ১ম (কনভেনার) চেয়ার হিসাবে ( ১৯৭২-১৯৭৫) দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে মধব্দ ব্র: মানিক মহারাজের সাহচর্য্যে খেওড়া আনন্দময়ী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৮-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সরাইল উপজেলা স্কাউট কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবন:
১৯৬৮ সালে মেহারী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯৫ সালে কসবা উপজেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন এবং ২০০৮ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে ছিলেন। ২০০৯ হতে মৃত্যুর পৃর্বপর্যন্ত কসবা উপজেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
সম্মাননা:
২০১০ সালে ঢাকাস্থ কসবা সমিতি কর্তৃক গুণীজন হিসেবে উনাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে খেওড়া আনন্দময়ী উচ্চ বিদ্যালয় হতে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধনায় ভূষিত হন।
প্রকাশনা:
১৯৬৭-১৯৬৮ সালে লিখেন, ঝযড়ৎঃ ঊধংংুং ঋড়ৎ ঈষধংং ভরাব ধহফ ঝরসঢ়ষব ঊধংংুং ভড়ৎ ঈষধংং ভড়ঁৎ. ১৯৭৮-১৯৮৯ সালে ৬৫ প্যারীদাস লেন থেকে আনোয়ারুল হক কতৃক প্রকাশিত ঝঃববঢ়ং ঃড় ঊহমষরংয মৎধসসধৎ ভড়ৎ ঈষধংং ভড়ঁৎ, ভরাব ধহফ ংরী. ঝপযড়ষবৎংযরঢ় ঊধংংুং ধহফ খবঃঃবৎ ভড়ৎ ঈষধংং ংবাবহ. আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ ৬ষ্ঠ শ্রেণী।
মহানমুক্তিযুদ্ধে অবদান:
১৯৭১ সালে মেহারী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি হিসেবে ছিলেন এবং যাহারা মুক্তিযুদ্ধ করতে ইচ্ছুক তাদের দলীয় পরিচয় পত্র প্রদান করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন। উনার সহায়তায় ভারতে গিয়ে অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে উনার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ১৪ ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকায় উনার নাম ছিল। পাকিস্তানি আর্মিও সেদিন এসেছিল। উনি আগেই খবর পেয়ে যান। যার কারণে উনাকে হত্যা করতে পারেনি।
মৃৃত্যুঃ
২০১৪ সালের ৩১ শে মে রোজ শনিবার বিকাল ৩ ঘটিকায় ইহকাল ত্যাগ করেন। উনার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক উনার মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং উনার পিএস এর মাধ্যমে উনার মৃতদেহে পুষ্পস্তবক অর্পন করেন। উনার জানাজায় এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তি, উনার ছাত্রছাত্রী এবং সর্বসাধারণ উপস্থিত থেকে উনার মাগফিরাতের জন্য দোয়া কামনা করেন।
পরিশেষে বলতে পারি, যখন এলাকায় শিক্ষার আলো ছিল না, এস এস সি পাস করলে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ছোটে আসত এক নজর দেখার জন্য, অজ্ঞতা, কুসংস্কার ছিল যে এলাকার মানুষদের মনের খোরাক এমন একটা সময়ে আলহাজ্জ মোহাম্মদ নুরুল হক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হন। পরিবেশ প্রতিকূলতার মধ্য থেকেও বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠ থেকে নিয়েছেন সর্বোচ্চ ডিগ্রি। উন্নত জীবনের হাতছানি, শহরের আরাম আয়েশ ছেড়ে চলে যান আজপাড়া গাঁয়ে। শিক্ষাবিস্তারে নিজেকে নিয়োজিত করেন মহান সেবক হিসেবে। আলো ছড়াতে থাকেন শিক্ষার। এই জন্যই উনাকে নুরুল হক মাষ্টার নামেই সবাই চিনে। মহান মুক্তিযুদ্ধেও সফলতার সাথে সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সার্টিফিকেটের প্রতি বিন্দুমাত্র কোন আগ্রহ ছিল না। তাই মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্তও সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য কোন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। নিবেদিন প্রাণ, মহাপুরুষ আজীবন অপ্রচারেই রয়ে গেছেন। তবে এলাকার মানুষ জন উনাকে মেধাবী, বুদ্ধিজীবী হিসেবে জানে। উনাকে সবাই চিনে। কথা বলে অবাক হয়। এরকম বড় মাপের মানুষ গ্রাম্যপল্লীতে পরে আছে। মৃত্যুর আগে, উনার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আপনার যে যোগ্যতা সে অনুযায়ী আপনি অনেক বড় উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা বড় পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন। আপনি তা করেন কি কেন? উনার ভাষ্য, সবাই যদি বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হয় তাহলে সমাজসেবা কে করবে? প্রশ্ন করেছিলাম, বড় পদে অধিষ্ঠিত থেকে কি সমাজ সেবা করা যায় না। উনার উওর, করা যায়। তবে তা পূর্ণাঙ্গ হয় না। সমাজসেবা করতে হলে মানুষের সাথে মিশতে হয়, মানুষের অনুভূতি জানতে হয়। বড় পদে অধিষ্ঠিত থেকে তা করা কঠিন হয়ে যায়। এরকম একজন বড় মাপের মানুষ হারিয়ে এলাকার মানুষজন সত্যিই মর্মাহত। যিনি এলাকার একজন অভিভাবক ছিলেন। বিচার আচার থেকে শুরু করে সবকিছুতেই উনাকে এলাকার সবাই মান্য করত। উনার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসার কথাই।
কামরুল হাছান মাসুক
কসবা, বি-বাড়ীয়া।