আমি মহাবেকুব জাতক ভেবে মরি, রাষ্ট্র আর সরকার যদি কৃষি বান্ধবই হয় তবে কৃষকের পাতে ভাত নেই কেন ? পুঁজি যোগাড়ে ঋণ নিতে তাকে তার ভিটে-মাটি, গরু-ছাগল সব বন্ধক রাখতে হয় কেন ?
খাদ্য সংরক্ষন আর বিপণন নিয়ে অর্থনীতির গালভরা ব্যবস্থাপনার যতোই কথা থাকুক না কেন, কৃষকের স্বার্থরক্ষা কিম্বা কৃষিপণ্যের সঠিক মূল্য যাতে কৃষকেরা পান তা নিয়ে যতো হাযারো গবেষনা, যতো হাযারো মতামত, যতো পরিকল্পনা নেয়াই হোক না কেন, যতো আহাজারিই হোকনা কেন আমার মতো মহাবেকুব ভেবেই পায়না এতো কিছু থাকার পরেও কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য কখনই পায় না কেন !
কেন কৃষককে তার ধানে আগুন লাগিয়ে বুক ভরা জ্বালা নিয়ে ঘরে ফিরতে হয় ? কেন সব্জী চাষীকে রাস্তায় তার উৎপাদিত সব্জী ফেলে মাড়িয়ে দিতে হয় প্রতিবাদ হিসেবে ? দুধ উৎপদনকারীকে কেন তার অবিক্রিত দুধ পানিতে ভাসিয়ে দিতে বা রাস্তায় ঢেলে দিতে হয় মনের কষ্টে ?
আমি মহাবেকুব জাতক কোনও অর্থনীতিবিদ নই, কৃষিবিদ নই, নই পরিকল্পনাকারীও। এই মহাবেকুব জাতক আগাগোড়া একজন আমজনতা। শুধু ভেবেই মরি, রাষ্ট্র আর সরকার যদি কৃষি বান্ধবই হয় তবে কৃষকের পাতে ভাত নেই কেন ? পুঁজি যোগাড়ে ঋণ নিতে তাকে তার ভিটে-মাটি, গরু-ছাগল সব বন্ধক রাখতে হয় কেন ?
সবাই বলেন, দেশের খাদ্য সমস্যা মেটাতে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে, কৃষিতে ভর্তুকি দিতে হবে, সেচ-সার সহজলভ্য করতে হবে। পরিকল্পনা করা হয় ভুরি ভুরি। বাস্তবায়নও হয়তো হয় অনেক কিছুই। কিন্তু কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি ঘটেনা।
প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন যে , এক ইঞ্চি জায়গাও খালি ফেলে রাখা যাবেনা। সবাই গলা মিলিয়ে চেচিয়ে, ফাঁটিয়ে দিয়েছেন চারদিক। কিন্তু কৃষককে তার “পণ্যের ন্যায্যমূল্যের একপয়সাও কম দেয়া চলবেনা” এমন হুঙ্কার শুনিনি। আপনারা শুনেছেন কিনা জানিনে! সবাই খাদ্য সংরক্ষনের জন্যে চেঁচাচ্ছেন, করোনা আক্রমনের পর সে চেঁচানো আকাশ বাতাস তোলপাড় করে দিচ্ছে।
মহাবেকুব বলেই এই জাতকের বেকুবের মতো প্রশ্ন - “আরে মিয়া! খাদ্য সংরক্ষন করে আমার মতো অকৃষক-অচাষী বেকুবদের সারা বছর পেট ভরানোর ব্যবস্থা করবেন আর কৃষক অভুক্ত থাকবে ? উৎপাদিত পণ্য জলের দরে ফরিয়া, সিন্ডিকেট দলের হাতে তুলে দিয়ে খাদ্য সংরক্ষন করছেন ভালো কিন্তু কৃষকদের প্রান সংরক্ষন হচ্ছে কি তাতে ? “
কৃষির সাথে জড়িয়ে আছে নাকি আমাদের কৃষকের প্রাণ। কৃষির উন্নতি না হলে কৃষকেরও নাকি উন্নতি হবে না। কৃষির উন্নতি যদি বাধাগ্রস্ত হয় তবে নাকি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে - এই ডায়লগ এই মহাবেকুব জাতক শুনে আসছে ছোট কাল থেকেই । কিন্তু এই কয়েক যুগেও ছনের তৈরী কৃষকের ভাঙা বাড়ীটি অনেকটা তেমনিই আছে , ছিঁটেফোটা জৌলুস বাড়লেও এখনও মনে হয় টিনের চাল ওঠেনি প্রায় সব কৃষকের ছন, গোলপাতার ঘরে। কৃষকের চেহারা সেই হাড় জিরজিরেই আছে এখনও ।
কৃষি প্রধান দেশে কৃষকের এই হাল কেন ? কৃষকের দুঃখে চোখের জলে আমরা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ভাসিয়ে দেই কিন্তু তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কোন টেকসই পরিকল্পনাই নিতে পারিনি এ পর্যন্ত। কেন?
আমাদের সব চেষ্টাই যে “খাদ্য সংরক্ষন” নামের লাল ফিতেয় বন্দী। আর খেয়াল করলে দেখবেন, খাদ্য সংরক্ষন শুধু আমাদের চাল-গম-আলু সংরক্ষনের মাঝেই সীমাবদ্ধ। সব নজর আর পরিকল্পনা সেদিকেই। তাও সংরক্ষন ব্যবস্থা নাকি চাহিদার তুলনায় নেহাৎ-ই অপ্রতুল। কিন্তু কৃষককে বাঁচাতে এই সংরক্ষন করেই বা লাভ কি যদি কৃষক ন্যায্যমূল্য নাই-ই পান?
খাদ্য সংরক্ষনে সরকার প্রধানত ধান, চাল ও গম কেনেন। কিন্তু সেই কেনা নিয়ে কতো যে সরকারী, বেসরকারী সিন্ডিকেট, কতো যে টালবাহানা তা নতুন করে বলার দরকার আছে কি ? সরকার ধান-চাল-গমের যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, সারাদেশের খাদ্য কর্মকর্তাদের সেই দামেই কৃষকের কাছ থেকে কেনার কথা ৷ তা কি কেনা হয়? আর চাল সরকার কৃষকের কাছ থেকে কেনে না,কেনে মিল মালিকদের কাছ থেকে ৷আর এসব সরকার কিনলেও উৎপাদিত এসব পণ্যের কতো ভাগ কেনা হয়? মনে হয় তা ৫ থেকে ১০% এর বেশী হবেনা। আবার এতোটুকু থেকেও তো প্রান্তিক কৃষকরা বঞ্চিত। বাকী সিংহভাগ কৃষিপণ্যের ভাগ্যে জোটেটা কি ?
আসলে আমাদের বিদ্যমান খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতিমালা গরিব প্রান্তিক কৃষকবান্ধব নয়। উপজেলা পর্যায়ে আমাদের কৃষকদের একটি তালিকা থাকার কথা। যদি থাকে তবে সেটি কতো আগে করা হয়েছে ? এই তালিকায় কি আমাদের গরিব প্রান্তিক চাষিদের নাম আছে? পত্রিকা ঘাটাঘাটি করলেই জানতে পারবেন - নেই । থাকার কথা নয়। পত্রিকান্তরে যে তালিকার আভাস পাওয়া যায় সেই তালিকাতেও আছে জোচ্চুরির খবর। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের লোক বা স্থানীয় সরকারি দলের লোকজনই আছেন এই তালিকার সিংহভাগ জুড়ে। এই সব কৃষিকার্ডধারী যারা থাকেন তারা সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও তাদের আত্মীয়-স্বজন,সরকারী দলের লোকজন, ব্যবসায়ী, কন্ট্রাকটর, দোকানদার, ফড়িয়া, আড়ৎদার এসব পেশার লোক। তারা কেউই কিন্তু প্রান্তিক কৃষক নন। অথচ এইসব লোকজনই আসলে সরকারি গুদামে ধান সরবরাহের সুযোগ পান।
তার উপরে রয়েছে সরকারী ফ্যাকড়া । ফ্যাকড়াগুলো এরকম -ধানের আর্দ্রতা হতে হবে সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ। এছাড়াও ধানে বিজাতীয় পদার্থ থাকতে পারবে দশমিক পাঁচ ভাগ, ভিন্ন জাতের ধানের মিশ্রণ সর্বোচ্চ ৮ ভাগ,অপুষ্ট ও বিনষ্ট দানা ২ ভাগ ও চিটা ধান দশমিক ৫ ভাগ।
অথচ আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষীরা ধান শুকান বাড়ীর সামনের মাটির উঠোনে। তাদের উঠোন তো আর কংক্রীট বা ইটের বাঁধানো নয়। সেখানে আদ্রতা তো থাকবেই কিছু না কিছু। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের সময় আর্দ্রতার পরিমাপ করা হয় না। গুদামজাত করার আগে সরকার নিজ দায়িত্বে ধান শুকিয়ে নেয়।
এইসব যতো ফ্যাকড়ার যাতাকলে পড়ে ক্ষুদ্র চাষীরা দৌঁড়ের মাঠের “হিটস”য়েই বাদ পড়ে যান। অর্থাৎ এমন সব অজুহাত দেখিয়ে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়, যাতে সরকারী, বেসরকারী কায়েমী সুবিধাভোগীদের ভাগটা ষোলআনা বজায় থাকে। ফলে একজন গরিব কৃষক তার ধান কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন আর সেই ধান কৃষিকার্ডধারী অকৃষক ফড়িয়া , আড়ৎদারেরা কিনে বেশি দামে সরকারি গুদামে সরবরাহ করে থাকেন।
কিন্তু সব চাষীরাইতো কেবল ধান,গম, আলু ফলান না, ফলান সব্জীর মতো অন্যান্য কৃষিপণ্যও।
তাদের এই পচনশীল কৃষিপন্য সংরক্ষনের কোনও ব্যবস্থা আছে কি ?
অথচ গত ৪৮ বছরে দেশে সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ । আর বার্ষিক উৎপাদন বৃদ্ধির হার বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেড় কোটি মেট্রিকটন সবজি উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদনে বিল্পব ঘটলেও বিপ্লব ঘটেনি খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্য নিরাপত্তা বা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকান্ডের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে দেশে ৯০ রকমের সবজির বাণিজ্যিক চাষ হয়, যার ৩০ থেকে ৩৫টি প্রধান।
সবচেয়ে বেশী যে সমস্ত সবজি বাংলাদেশে চাষ হয় তাদের মধ্যে টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, চাল কুমড়া,বেগুন, পটল, ঝিঙা, করলা, লাউ, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, কাঁচা মরিচ, ধুন্দুল, মিষ্টি কুমড়া, ঢেরস, শশা, ক্ষীরা, মুলা, শিম, গাঁজর, পুইশাক, লালসাক, বরবটি, সজনা, ধনে পাতা, মটরশুঁটি, কাঁচা পেঁপে ইত্যাদি।
দেশে সবজির ক্রমবর্ধমান বাজার টাকার অংকে কত বড় তার হিসেব নেই কোথাও। তবে মহাবেকুব হলেও বিভিন্ন জায়গা ঘেঁটে জেনেছি - প্রতি বছর বিশ্বের পঞ্চাশটি দেশে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার সবজি রপ্তানি হয়।
দেশে সবজির ঘাটতি যেমন আছে তেমনি খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও সংশয়মুক্ত নয়। দেশে সেই অর্থে পচনশীল সব্জির মধ্যে আলু ছাড়া আর কোনও পণ্যের জন্যে কোনও হিমাগার সম্ভবত নেই। পঁচে যাবার ভয়ে কৃষককে তড়িঘড়ি করে তাদের পন্য পানির দামে ছেড়ে দিয়ে বিনিয়োগকৃত পুঁজির যতোখানি সম্ভব ঘরে তুলে আনতে হয়। কৃষক মার খেয়ে যায় অথচ ঢাকার অদূরে গ্রামীণ হাটে চাষিদের তাজা সবজির যে দাম, ঢাকায় এসেই তার দাম হচ্ছে কমপক্ষে চার -পাঁচ গুণ বেশি। কারওয়ান বাজার, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে গিয়ে আমাদের দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের পাইকারি মূল্য দেখলে মনে হয়, আমরা এখনো শায়েস্তা খাঁর আমলে বসবাস করছি! কিন্তু বিভিন্ন হাত বদল হয়ে যখন ভোক্তার কাছ থেকে ওই কৃষিপণ্যের মূল্য আদায় করা হয়, তখন দৈবক্রমে উপস্থিত সংশ্লিষ্ট পণ্য উৎপাদনকারী কৃষকের তা দেখে ও তাঁর উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্যের অঙ্ক শুনে অক্কা পাওয়ার জোগাড় হয়......অক্কা পাবার মতো অবস্থা হয় আমার মতো মহাবেকুব মানুষেরও!
মোদ্দা কথা হলো- লাভের বড় অংশ পাচ্ছেন না চাষি,অথচ ভোক্তারা সব্জী কিনছেন উচ্চমূল্যে। তাই উৎপাদিত সব্জীর ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ফসল নষ্ট করার মতো ঘটনাও দেখা যায় এই খাতে। লাভের মূল অংশ নিয়ে যায় যে মধ্যস্বত্বভোগীরা,তাদের আছে নানা ব্যাখ্যা যা এককথায় উছিলারই নামান্তর।
সব্জী চাষিদের জন্য ব্যাংক ঋণের পৃথক সুযোগ না থাকায় আছে কৃষকদের আক্ষেপও।
অথচ এসব পচনশীল পন্যের জন্যে যদি কোনও সংরক্ষনাগার গড়ে তোলা যেতো তবে কৃষকেরা কিছুটা হলেও নিজ পণ্য পানির দরে না বেচে জ্বালানী তেলের দামে বিক্রি করার জোরটা দেখাতে পারতেন।
আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার প্রকল্পের আওতায় দেশে এই প্রথম চাল রাখার ৬টি সাইলোসহ মোট ৮টি সাইলো নির্মাণ করার কথা শোনা যাচ্ছে । এ যাবতকাল দেশে কোনো চালের সাইলো ছিল না। যে কয়টি সাইলো ছিল তাতে নাকি গম সংরক্ষণ করা হতো। স্বাধীনতার পর চালু হওয়া চট্টগ্রামের সাইলোসহ দেশের মোট ৪টি সাইলোতে গম সংরক্ষণ করাই হতো। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ ও সান্তাহারে অবস্থিত এ সাইলোগুলো বিজ্ঞানসম্মত হলেও আধুনিক নয়।
দেশের ৬২৩টি স্থানে ২৭০০ ফ্ল্যাট গোডাউন আছে । এসব গুদামে চাল-গম রাখলে তা ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যেই নাকি পোকায় ধরে যায়। কারন তা আধুনিক নয়।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের অধীনে সরকারি হিমাগারের সংখ্যা ২১। বেসরকারি হিমাগার আছে ৪০৭টি, এর মধ্যে প্রায় ৩৮৫টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা হয়। অথচ কোথাও অন্যসব পচনশীল পন্যের জন্যে সংরক্ষনাগারের কথা কাউকে বলতে শুনিনি।
তার সাথে তাল মিলিয়ে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইন্ডাস্ট্রি তেমনভাবে যদি গড়ে তোলা যেতো তবে দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মেীসুমি কৃষিপণ্য প্রতি বছর নষ্ট হতোনা।
যথাযথ এলাকায় যদি কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করা যেতো, তাহলে একদিকে যেমন উৎপাদিত ফসল নষ্টের পরিমাণ কমে যেতো, অন্যদিকে কৃষকেরা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পেতো।
প্রধানমন্ত্রীর বলা, “এক ইঞ্চি জায়গাও খালি ফেলে রাখা যাবেনা।“ একথার মূল্য কতোটুকু যদি কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পান ?
সংরক্ষন করার ব্যবস্থা সহ মজুদদারদের চক্রান্ত, সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজদের দমাতে না পারলে প্রধানমন্ত্রীর এমন কথায় কেউই উৎসাহিত হবেন না। এগুলো কি বন্ধ করা যায়না ? কেন যাবেনা ? একটু সদিচ্ছা বা “সাসটেইনেবল ডেপেলপমেন্ট”য়ের যে কথা আমরা বলি তার প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেই এগুলো সামাল দেয়া সম্ভব। কেন প্রতিটি ইউনিয়নে পচনশীল সব্জীর হিমাগার গড়ে তোলা হয়না ?
আমরা জানি, কৃষি হচ্ছে আমাদের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত, এ খাত থেকে জিডিপির আনুমানিক ১৪ শতাংশ আসে। মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৬৩ শতাংশ এর সঙ্গে জড়িত। আমরা এও জানি, মোট সব্জীর ৩০ শতাংশই উৎপাদন হয় গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে যার পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টন এবং বাজার মূল্য প্রায় ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই গ্রীষ্মকালীন সবজিগুলোই এখন কৃষকের জন্য হয়েছে গলার কাঁটা।
রবি মৌসুমে সবচেয়ে বেশি শাকসবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে যা আমাদের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু মৌসুমে বাজারমূল্য খুব কম হওয়ায় ও অধিকাংশ শাকসবজি দ্রুত পচনশীল হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। অন্য দিকে দ্রুত পচনশীল বলে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না এবং প্রচুর অপচয় হয়ে থাকে। কৃষককেও পানির দামে তার ফসল বিক্রি করতে হয় বাধ্য হয়েই।
পিপিপি আওতায় কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিপণন কার্যক্রম এর এক তথ্যে বলা হয়েছে - “ বর্তমানে দেশের কৃষিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বিপরীতে ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। রোপণ ও সংগ্রহ মৌসুমে তীব্র শ্রমিক সংকট পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে। এ অবস্থায় কৃষিবিদরা জোর দিয়েছেন শস্যগুদাম ঋণ কার্যক্রমে। এতে ইউনিয়ন পর্যায়ে শস্য সংরক্ষণ কার্যক্রম যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি কমমূল্যে ফসল বিক্রি করতে হবে না কৃষককে।“
মহাবেকুব জাতকের বেকুবি প্রশ্ন -শস্যগুদামের জন্যে সরকার ঋণ কেন দেবে ? কে বা কারা এই শস্যগুদাম বানাবেন ? সরকার নিজে এটা করতে পারেন না ?
কৃষিবিদরা জোর দিয়েছেন শস্যগুদাম ঋণ কার্যক্রমে। এই কৃষিবিদরা কি আমার মতোই মহাবেকুব ? ব্যক্তি পর্যায়ে বা নিদেন পক্ষে সমবায় পর্যায়ে এরকম শস্যগুদাম এদেশে কোথায় আছে ? যা আছে তা আলু সংরক্ষনের জন্যে। অথবা তারা কি জানেন না এমন কৃষক কোথায় আছেন আমাদের দেশে যারা ঋণ নিয়ে এক একটা শস্যগুদাম বানাবেন ? এ তো তেলা মাথায় তেল দেয়া কর্মসূচী। এতে কেবল মাত্র ইউনিয়ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ আর টাউট বাটপারদের সোনার খনি হাতে তুলে দেয়া কার্যক্রম। তারাই এই ঋণের সুবিধাভোগী হবেন এবং শস্যগুদামের মালিক হয়ে কৃষকের গলা কাটবেন! সরকারও এমনটা চায় বলেই কি নিজেরা এই ভারটা নিচ্ছেন না যদিও মুখে বলছেন -কৃষিবান্ধব সরকার ? সরকার কি পারেন না , ইউনিয়ন পর্যায়ে না হোক উপজেলা পর্যায়ে একটি করে সরকারী খাদ্যগুদাম তৈরী করতে ? আর তৈরী করতে একটি সমন্বিত বাজার প্রক্রিয়া যেখানে কৃষকরা তাদের পন্যের উৎপাদন মূল্যের উপরে ২৫ থেকে ৩০% লভ্যাংশ পাবেন যা নিজেই কিনে নেবে সরকার? সরকারই তা পরিবহন করবে নিজস্ব খরচে ? অনেকটা সরকারী সমবায় পদ্বতি হবে তা।
আমাদের দেশের মিল্কভিটা, ভারতের আমূল যেভাবে সমবায়ের মাধ্যমে দুধ উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে দুধ কিনে নেন এবং নিজেরাই সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন করে থাকেন তেমনি করে কি সরকার সব্জীও সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন করতে পারেন না ? কৃষিতে ভর্তুকি নূন্যতম রেখে ভর্তুকির বাকীটা দিয়ে সমন্বিত এমন একটি প্রকল্প হাতে নেয়া কি খুবই কষ্টকর ? জটিল বটে তবে আন্তরিকতা ও কমিটমেন্ট থাকলে কোনও অসম্ভবই অসম্ভব নয়। যেমন পদ্মা সেতু। কোনও অসম্ভবই কি এটাকে আটকাতে পেরেছে ?
এ পদ্ধতিতে কৃষকরা নিজেরাই তাদের পন্য সরাসরি সরকারের খাদ্যগুদামে দিয়ে তৎক্ষনাত ন্যায্যমূল্য নগদে নিয়ে যাবেন অথবা একটি একাউন্ট তৈরী করবেন যেখানে পণ্য বিক্রির পরে তার টাকা জমা হবে। সরকার এই সব পণ্য অপ্রকৃয়াজাত অবস্থায় বা প্রক্রিয়াজাত করে নিজস্ব হিমাগার সম্বলিত পরিবহনে করে দেশের সকল পাইকারী বাজারে ১০% লাভে বিক্রি করবেন। এতে কৃষক তার ন্যায্যমূল্য পাবেন, মধ্যসত্বভোগীদের হাত থেকে বাঁচবেন। সরকার তার সব খরচ উঠিয়ে নেবেন ঐ ১০% লভ্যাংশ থেকে। তাতে না পোষালে কৃষি ভর্তুকির টাকা থেকে তা পুষিয়ে নেবেন। কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পেলে আর কৃষিঋণের দিকে ঝুঁকবেন না। সেই হাযার কোটি কৃষিঋণের টাকা সরকার প্রয়োজনে নিজেই এই কাজে খরচ করতে পারবেন।
উদাহরন দিলে মনে হয় ভালো হয় ---বেগুনের উৎপাদন খরচ এখন প্রতি কেজি ৭ টাকা। খামারপ্রান্তে এর দাম ৩০% লভ্যাংশ ধরে হওয়ার কথা ৯ টাকা থেকে ১০ টাকা। তাহলে কৃষকদের কাছ থেকে সরকার এই বেগুন কিনবেন কেজি প্রতি গড়ে ১০টাকা করে। ঐ টাকা কৃষক পাবে যা সে নিজে ফরিয়াদের কাছ থেকে কোনও কালেই পেতোনা। ( কখনও কখনও এই বেগুন প্রতি কেজি ২ টাকাতেও বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন কৃষক। ) সরকার যদি এই বেগুন ১০% লভ্যাংশে পাইকারী বাজারে বিক্রি করেন তবে কেজি প্রতি পাবেন ১১ টাকা। বেগুনের পাইকারদের লভ্যাংশ ১০% বেঁধে দিলে পাইকারী মূল্য দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ১২ টাকা। ২৫% লভ্যাংশ যোগ করে খুচরা বাজারে সেই বেগুনের মূল্য হতে পারে বেশী হলে ১৫ টাকা ।
অথচ সেই বেগুনই আমরা কতো করে কিনছি? এই মহাবেকুব জাতক প্রশ্নটা আপনাদেরই কাছেই রাখছে! কারন ১০ টাকার জিনিষই আপনাকে গাঁটের পয়সা খরচ করে কেন কিনতে হবে ৬০ -৭০ টাকায়, বিশেষ বিশেষ সময়ে ১০০ বা ১২০ টাকায় ?
ছবি --কৃষকের ন্যায্যমূল্য আর ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষনে করা মহাবেকুব জাতকের একটি ছক ।
এই পদ্ধতিতে সবারই স্বার্থ সংরক্ষন করা সম্ভব কেবল মাত্র ফড়িয়া -বাটপার , মধ্যসত্ত্বভোগী ও চাঁদাবাজদের বাদ দিয়ে। সরকার যদি নিজেরাই এসব কেনেন তবে ঘাটে ঘাটের অসংখ্য ফড়িয়া -বাটপার , মধ্যসত্ত্বভোগীদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়না কৃষকদের। কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেয়ে যাবেন সরাসরি ৩০% লভ্যাংশে । কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক পলাশ কান্তি নাগ অবশ্য বলেছেন, “উৎপাদনের খরচের সঙ্গে ৩৩ শতাংশ মূল্য সহায়তা দিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে প্রতিটি ফসল ক্রয় করতে হবে।”
আর সরকার নিজেই যেখানে সংগ্রাহক ও পরিবহনকারী সেখানে চাঁদা তুলবে কে ? এই অসংখ্য মধ্যসত্ত্বভোগীদের বাদ দিতে পারলেই আমরা সাধারণ ক্রেতাদের গলাকাটা মূল্যে আর কিনতে হয়না এসব পন্য। এতে চাঁদা সহ পরিবহণ খাতের ব্যয় কমবে বর্তমানের অর্ধেকেরও বেশী। সরকার তখনই সত্যিকার অর্থেই কৃষি ও জনবান্ধব হয়ে উঠতে পারেন সহজেই। আর সরকার যদি এইসব মধ্যসত্ত্বভোগীদের লালন পালন করতে চান তবে তা ভিন্ন কথা!
সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালে সরকার “ভিশন ২০২১” গ্রহণ করে। অথচ জাতীয় কৃষিনীতি ১৯৯৯, জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৩ এবং সর্বশেষ জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ বিশ্লেষণ করে ধানসহ সব কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ এবং কৃষিতে চলমান শ্রমিক সংকট প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
বাস্তবে কৃষক উৎপাদনের চেয়েও কম দামে তার উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে পারেন না, কোনো ন্যায্য বাজার পান না এবং যখন কৃষি মৌসুমে তীব্র শ্রমিক সংকট দেখা দেয়; তখন পাবলিক মিডিয়াতে এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা চলে। পাবলিক পরিসরে কিছুটা সাড়া তৈরি হয়। নগণ্যমাত্রায় হলেও কিছু মানুষ নানাভাবে কৃষি ও কৃষকের পাশে দাঁড়ান। উৎপাদিত ফসল রাস্তায় ফেলে প্রতিবাদ জানান বা কৃষকের জমিতে ধান কাটতে এগিয়ে আসেন অনেক সংবেদনশীল অকৃষক নাগরিক। কিন্তু ধানসহ কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয় না।
এতো এতো পরিকল্পনার পরেও কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয় নি।
সরকার কি এটা জানেন না, বোঝেন না ? যদি জানেন ও বোঝেন-ই তখন তা করা হয়না কেন ?
এই মহাবেকুব জাতক এযাবৎ সরকারের কাছ থেকে কেবল এমন কথাই শুনে এসেছে - “করা হবে” , “পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে”। কিন্তু কখনই শোনেনি - “করা হয়েছে” বা “পরিকল্পনা মতো কাজ চলছে”।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের “কৃষির সালতামামি”তে বলা হয়েছে -মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপি’তে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। কৃষকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি ও নিরাপদ সবজি/ফল সহজলভ্য করার নিমিত্ত ঢাকায় শেরেবাংলা নগরে কৃষকের বাজার চালু করা হয়েছে যেখানে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বাজারজাত করছে। ক্রমান্বয়ে এই ব্যবস্থা জেলা-উপজেলা শহরে সম্প্রসারিত হবে।
এখানেও ঐ একই কথা - “হবে” ! ভবিষ্যত কাল! মহাবেকুব জাতক ভেবে পায়না, এই “হবে”টা কবে নাগাদ “হয়েছে” হবে!
মহাবেকুব জাতক ভেবেই পায়না, সরকারের কৃষি পরিকল্পনাবিদরা সুষ্ঠ বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারী মালিকানায় কোল্ডস্টোরেজ এবং “শীতল চেইন পরিবহনের সুবিধা” সহ সামগ্রিক একটি “সাপ্লাই চেইন” সৃষ্টি করে উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত নিরাপদ সবজি পৌঁছানোর ব্যবস্থা কেন করতে পারেন না ? এটা কি খুব কঠিন কিছূ ? যদি কঠিনই হয় তবে দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার সাহায্য নেয়া যেতে পারে, কৃষিতে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কৃষির উৎপাদন, মজুতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও বহুমুখীকরণের নানা স্তরে নানাভাবে তরুণদের তাদের আগ্রহ, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার নিরিখে যুক্ত করতে বিশেষ প্রণোদনামূলক কর্মসূচিও গ্রহণ করা যেতে পারে।
বেকার লক্ষ লক্ষ তরুনদের সাথে নিয়ে সরকারী ভাবে একটি “সাপ্লাই চেইন” সৃষ্টি করতে পারলে একদিকে যেমন বেকার সমস্যার কিছুটা লাঘব হতো তেমনি কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হতো । ক্রেতাসাধারণও পর্যাপ্ত পরিমানে ভালোমানের শাকসব্জী ও ফল কিনতে পারতেন। ফলে কৃষক তো বটেই ব্যবসায়ী আর ভোক্তারাও লাভবান হতেন।
সরকার যদি নিজেকে কৃষিবান্ধব বলতে চান এবং তা আন্তরিক চাওয়া হয়ে থাকে, তবে এমন কোনও ব্যবস্থা করা হচ্ছেনা কেন ?
[ লেখাটি উৎসর্গ করছি ব্লগার “ ঠাকুর মাহমুদ ”কে যিনি নিজেই শাকসব্জী উৎপাদন ও বিপণনের সাথে জড়িত। এর অলি-গলি আর ফাঁক-ফোঁকড় তারই বেশি জানার কথা। এই মহাবেকুব জাতকের মতো বেকুবি কথন তিনি নিশ্চয়ই করবেন না। এর চেয়েও ভালো কোনও পথ হয়তো উনি বাৎলে দিতে পারবেন .....................]
তথ্য সূত্রঃ
আনুমানিক ব্যয় ৬০ মিলিয়ন ডলার : প্রথমবারের মতো চালের সাইলো নির্মাণের টেন্ডার এ মাসেই
ধান ও কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য
কেজিতে বেগুনের দাম দুই টাকা, বিপাকে চাষি
https://www.thedailystar.net/bangla/মতামত/কà§à¦°à§Ÿ-বà§à¦¯à¦¬à¦¸à§à¦¥à¦¾à¦°-গোড়ায়-গলদ-সà§à¦¬à¦¿à¦§à¦¾-পান-না-কৃষক-112375
ঢাকা টাইমস
সবজি উৎপাদনেও বিপ্লব বাংলাদেশে
প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০১৯, ০৯:১১
প্রথম আলো
হিমাগারের অভাবে সবজি নষ্ট
প্রকাশ - ২৮ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:০৩
এবং অন্যান্য নেট থেকে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ৮:১১