যে জোনাকি লুকিয়ে রেখেছি চোখে, পলকে অশ্রুজল......
নন্দন, মনে করিস নে যে, আমি সত্যি সত্যিই এই গল্পটা লিখতে বসেছি । এটা মূল গল্প নয় । এটা গল্প লেখার পেছনের গল্প । পেছনের কেন ? তা বলি ----
নিশীথাকে আমি কখনও দেখিনি । তবুও নিশীথার সাথে আমার একটা যোগাযোগ ছিলো । রাত-বিরেতে ঘুম ভেঙে গেলে সে আমাকে লিখতে বসতো । নিছক কথার পিঠে কথা সাজিয়ে যেতো । আমার সাথে তার যেন একটা লেখা লেখা খেলা চলছিলো । কী-বোর্ডে নিশীথার আঙুল চালানোর শব্দ পেতুম আমি তাতে । নিশীথার আঙুল কেমন, তার বর্ণনা আমি দিতে পারবোনা । কবি সাহিত্যিক হলে হয়তো স্বপ্নের ঘোরে বলতে পারতুম চম্পাকলি আঙুল -- শ্বেতশুভ্র , দ্যুতিময়, হীরন্যক । সে আঙুলের ছন্দে নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ হতো কিনা জানিনে তবে আমার ঘুম ছুটে যেতো তাতে । তার শব্দকথার ঝংকারে আমাকেও তাল মেলাতে হতো । এককাপ চা বানিয়ে বসে যেতুম সুর-সংগতে । ঘন দুধের চা নাকি নিশীথারও খুব প্রিয় , এমন কথাই একবার লিখেছিলো সে । দুজনার এখানেই নাকি অনেক মিল ।
নিশীথাকে আমি পেয়েছি কোথায় ? হঠাৎ করেই পেয়ে গেছি, বলতে গেলে কুঁড়িয়েই । সেই যেবার আমরা দল বেঁধে জাফলং গেলুম তখন ট্রেনে থাকতেই একটা কল এসেছিলো আমার ফোনে । অপরিচিত নম্বর । হ্যালো বলতেই ও পাশে নারীকন্ঠ । কারও নাম ধরে তাকে চাইছে । রং নাম্বার ।
নন্দন ; তুই ও তো বলেছিলি – কার ফোন ?
তোর মতোন চন্দ্রা ভাবীও আমাকে খেয়াল করছিলেন । রং নম্বর বলার পরেও আমি আরো চালিয়ে যাচ্ছি দেখে তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছিলো ।
- কি হে , রং নম্বরে এতো কি রঙের কথা ?
“ আছে আছে ....” বলে তোদের যন্ত্রনায় আমি উঠে কামরার বাইরে চলে গিয়েছিলুম ওয়াশরুমের কাছের ঘুপটি জায়গাটায় । ওখানে কি কথা শোনা যায় ভালো করে ! কী বিকট আর কান ঝালাপালা ইঞ্জিনের ঘটাং ঘটাং আওয়াজ । তবুও কথা চললো আধা শোনা না শোনার মধ্যে দিয়ে । শেষমেশ আবারও কথা হবে বলে ফোন ছেড়েছিলুম । সীটে বসতেই তুই আমায় একটা গাট্টা মেরে বলেছিলি – কিরে কার সাথে কথা বললি এতোক্ষন ? রং নম্বরে লোকে এতো কি কথা বলে রে ? দাঁড়া তোর হবে আজকে, হোটেলে গিয়ে উঠি আগে ।
চন্দ্রা ভাবীও যোগ দিয়েছিলো তোর সাথে ।
সে কথা তোর কি মনে আছে নন্দন ?
মূল গল্পটি রং নম্বরের তাকে নিয়েই । কিন্তু আমি তো লিখতে বসেছি গল্পের পেছনের গল্প । রায়হান গফুর তন্ময় এর গল্প । যে দৈনিক সংযোগ পত্রিকার একজন কলামিষ্ট । সেই কোন এক মফস্বল শহর থেকে অনেক ঝড়ঝাপটা পার হয়ে এখন আরামবাগের এক মেস বাড়ীর দোতালার শেষ মাথায় তিন নম্বর রুমে একার একটা ঠাই করে নিয়েছে যে। রায়হান গফুর তন্ময় একাই ভাড়া নিয়েছে রুমটি । মানুষজনের অহেতুক সঙ্গ তার খুব একটা পছন্দ নয় । পত্রিকা অফিসে আবার উল্টো চিত্র । চীফ কলামিষ্ট জহুর আহম্মদ এর টেবিলে চায়ের কাপে ঝড় না তুলে যে নিজের চেয়ারখানায় পেছনটা ছোঁয়াতে মোটেও স্বস্তি বোধ করেনা । তারপরে সহকর্মী দেলোয়ার হোসেনকে দু’চারটে কথার খোঁচা না দিয়ে যে আবার কলম ধরতে পারেনা । সাব-এডিটর মিজ আফরোজা বানুর টিফিন বক্স থেকে কিছু না কিছু একটা মুখে না দিলে যার পেটের ভাত হজম হয়না । আবার মিজ আফরোজা বানুকে এটা না বললেও উসখুস করতে থাকে মুখ –
“মাইয়া মানুষ , কি যে রান্না করেন ...... ! আমিও তো এর চেয়ে ভালো রান্না করি ।”
তারপর ঝাল-মিষ্টি একটুকরো হৃদ্যতাময় ঝগড়া ।
দৈনিক সংযোগ এ তার নিয়মিত কলাম “ ভেতরে বাইরে” আপনার হয়তো অনেকেই পড়েন নি । পড়লে দেখতেন, কী তুখোড় তার লেখার ষ্টাইল, বক্তব্যের ধার ! সেই রায়হান গফুর তন্ময় এর ভেতর বাইরের গল্প এটা । এই যাহ .. আবারও ভুল হলো । গল্প গল্প করছি কেন ? এটাতো গল্পের পেছনের গল্প ।
নন্দন জানে কিন্তু আপনাকে কি এখনও বলে দিতে হবে যে, এমন রাখঢাক, চালচুলোহীন রায়হান গফুর তন্ময় আমি নিজেই ?
না , নিশীথার পুরো নামটি আমি ঠিক জানিনে । প্রথম আলাপে নিশীথা নামটিই শুধু বলেছিলো সে, হেয়ালী করেই হয়তো । ফোন ছেড়ে আমাদের মাঝে যোগাযোগের যে ব্যাপারটি ছিলো সেটা মেইলেই । ফোনালাপ গৌন হয়ে গেছে তখন। টুকটাক লেখার নেশা আছে নিশীথার । তাই ফোন থেকে সরে এসে এখন মেইলেই যা কিছু নিশীথার সাথে । এতে ধীরে সুস্থ্যে বসে আকাশ পাতাল বলা যায় । নিজেকে উজার করা যায় লিখে লিখে ।
মেইল এ্যাড্রেসটিতে তার পুরো নামটি নেই , দু অক্ষরের একটি নামের পরে কয়েকটি নম্বর মাত্র । অবশ্য তার নামটি জানা কোনও বড় বিষয় নয় । সমুদ্রঝড়ের যতো সুন্দর নামই থাকনা কেন তার আসল রূপটি হলো, জনপদে তার আছড়ে পড়ার ধরনটিতে । নিশীথার না জানা সত্যিকারের নামটি যতোই সুন্দর বা অসুন্দরই হোক না কেন , তার আছড়ে পড়ার ধরনটি ছিলো ঢেউয়ের মতো উচ্ছল, সুন্দর। ছিটকে যাওয়া জলের কুয়াশা হয়ে উড়ে যাওয়ার মতোই ছিলো তার ভেতরের ঝিরিঝিরি দ্যুতিময় রূপটি । কথার পিঠে কথা সাজিয়ে যেতে পারতো বেশ । কুমোরের মতো ছেনে তোলা মাটি থেকে গড়ে তুলতে পারতো মৃন্ময়ী এক একটি মৃৎপাত্র ।
আমি দিব্য চোখে দেখতে পেতুম , ঘন দুধের এককাপ চা নিয়ে নিশীথা তার ল্যাপটপ রাখা ডেস্কটির সামনে চেয়ার টেনে বসেছে । এতোক্ষন রান্নাঘরে থেকে তার নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে । গালে লেগেছে গোধুলীর লাল রঙের আমেজ । তার মরালী কন্ঠ আগলে রাখা একলহরী সোনার চেইনটিতে লেগে থাকা একফোঁটা ঘাম এই পড় পড় তার বুকের ঢালে ।
জানি , একথাই সে লিখবে এভাবে ---
“----ঘুমিয়ে গেছে সব চরাচর । আমি শুধু জেগে আছি । এককাপ চা আমার সামনে, যেমন থাকে আপনার ও। চা বানাতে গিয়ে নাকে ঘাম জমেছে আমার । আপনি একবার বলেছিলেন , নাকে ঘাম জমলে কি জানি কী সব হয় ।
নিঃশব্দ রাত । কেন যে এতো রাতে আপনার কথা মনে হলো ......”
এসব লিখতে শিখেছে সে আমার কাছে । প্রথম প্রথম লিখতে গিয়ে নিশীথা হোচট খেতো । সে হোচট খেয়ে ছড়ে লাল হয়ে যাওয়া জায়গাটুকুতে আমি আনাড়ী শব্দগুলি খুঁজে পেতুম । সে শব্দগুলোর ভাব মন্থন করে অমৃত উঠলে তা নিয়ে তার ছড়ে যাওয়া শব্দক্ষতে মলমের প্রলেপ মাখিয়ে বলতুম -
“ লিখুন । যাবতীয় শ্রমে ভরা দিনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু করে লিখুন । ইচ্ছেদের খেয়ে নেয়া জটিল সময়ের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে দেখবেন সুবাতাস বইছে । এটি একান্ত আপনার নিজের । নিজের ভেতরে আর একটি নিজস্ব ভুবন গড়ে তোলা । এখানে কারো কোনও প্রবেশাধিকার রাখবেন না । দেখবেন, মনটা সকালের রোদের মতো কনক আভায় ভরে উঠছে । লিখতে লিখতে হাত খুলবে একদিন । শব্দ করেই খুলবে ।”
তার উত্তরে নিশীথা বলতো ---
“ ভাঙনেরও তো শব্দ থাকে । জলের নীচে নিঃশব্দে মাটি ভাঙনের শব্দ । সে শব্দ সবাই শুনতে পায় না । পায় কি ?”
আমিও উল্টে বলতুম --- “ কান পাতলেই শোনা যায় , যদি সে কানে তেমন জোর থাকে ।”
আমার কানে বোধহয় তেমনটা জোর ছিলোনা । থাকলে সে শব্দ আমি তেমন করে শুনতে পাইনি কেন ? যে শব্দ নিঃশব্দে আছড়ে পড়ে, তেমন শব্দের কথা হয়তো জানাই ছিলোনা আমার । অনিয়মিত মাসকাবারী মাইনের আধেকটার বেশী পেনশনে যাওয়া জন্মদাতাকে পাঠিয়ে যা থাকে তা দিয়ে জীবন ধারনের কসরত করতে করতে স্বপ্নের সেসব বর্ণমালার ঝংকার আমার শোনা হয়ে ওঠেনি কখনও । আরামবাগের কোনও এক মেসবাড়ীতে থাকা চালচুলোহীন সামান্য এক কলামিষ্টের তেমন ঝংকার শোনার কথাও নয় ।
রায়হান গফুর তন্ময় তাহলে কি তখন তন্ময় হয়ে ছিলো অন্য কোনও খেলায় ? যা মেলেনা সহজে , সংসারে অচল এমন কিছুতে ? একটা নিটোল সখ্যতার মাকড়সার জাল বুনে তুলতে চেয়েছিলো যা সহজে দেখা যায়না অথচ ছুঁয়ে দেয়া যায় , অনুভব করা যায় ?
হৃদয়ের সব সৌহার্দ্য সঞ্জাত মোহহীন , কায়াহীন এক অপার্থিব বন্ধনজাল ?
শুরুটা ছিলো এরকমের , নিশীথা যেদিন লিখলো –
“------শুভেচ্ছা দ্বিপ্রহরের । অসম্ভব সুন্দর একটি মেইল এলো যা আমি কোনওদিন পাইনি । কি কাব্যিক মায়াময় শব্দগুলো একরাশ শিউলি ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে আমার হাতে ঝরে পড়লো যেন টুপটাপ করে এই বেলা । সকালে মেইল খুলে আপনার লেখাটি পেয়ে আমার এমন অনুভূতিই হলো । ফোনে কি এভাবে বলা যেত ....... ?”
আমি ফিরতি মেইলে লিখলুম --- “ বাহ , বেশ হাত খুলেছে তো আপনার ! এই তো বেশ লিখলেন, হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার মতো লেখা । জীবনের অপূর্ণতাটুকু পূর্ণ করে তুলুন লেখায় লেখায় । না পাওয়ার খেদটুকু ঝেড়ে ফেলুন কলমের কালির মতোন । লিখতে থাকুন । যে অভ্যেসটা মরে গিয়েছিলো বলে দুঃখ ছিলো , দেখলেন তো একফোঁটা জল পেয়ে সে আবার কেমন করে লকলকিয়ে উঠতে চাইছে ......” ।
এরকম একটা খেলায় মেতে ওঠা তখন থেকেই । রাজনীতি, সমাজনীতি এই সব নিয়ে কাঠখোট্টা কলাম লিখতে লিখতে মনের সুকুমার একটুকরো আঙিনায় যে শ্যাওলা গজিয়ে উঠছিলো এতোদিনে তা সরতে শুরু করলো বোধহয় । ভালো লাগছিলো আমারও লেখার হাত খুলছে দেখে । নিশীথা যে একজন নারী তা আমার মনেই হয়নি তেমন করে । সে যে আমার লেখার একনিষ্ঠ এক পাঠিকা । নিশীথা যেন আমারই আর একটা রূপ, আমার ভেতরের আয়নাখানি । আমি তার সাথে শব্দজাল বুনে চলি চাঁদের বুড়ির চরকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আপন মনে সুতো কাটার মতো ।
রায়হান গফুর তন্ময় এই লেখার খেলাতেই মজে ছিলো । লেখা লেখা খেলা।
রায়হান গফুর তন্ময় তাই একবার লিখেছিলো এমন করে – “ আমার লেখা কি ভালো হচ্ছে ? হঠাৎ হঠাৎ লেখার ফুলছাপ ফ্রকে রোদের ফিচেল হাসি দোলা দিয়ে যাচ্ছে কি ? জানেন, লিখতে ভালো লাগে বলেই আপনাকে লিখছি । একজন ভালো শ্রোতা - পাঠক পেলে লেখারা তরতর করে মাথা তুলতে থাকে । নিজে ফুরিয়ে গেছি কিনা, তা পরখ করে দেখি ।”
নিশীথার জবাব এলো – “ বাহ , লেখার ফুলছাপ ফ্রক ! দারুন বলেছেন , শ্রুতিনন্দন । আপনার ভেতরে একটা কি যেন আছে !
নিশীথা সেদিন আরও লিখলো এমন করে-.........
“ আপনার এই অদ্ভুত মায়া মাখানো কাব্যিক চিঠিগুলো তো আপনার পত্রিকার সাহিত্য পাতায় মুক্তগদ্যের মতো করে ছাপিয়ে দিতে পারেন ..........” ।
তা হয়তো যেত ! কিন্তু নিজ ভুবনের আলোয় বাইরের আলোভূক পিপীলিকাদের টেনে আনতে বড় ভয় ছিলো রায়হান গফুরের । ততোদিনে দারুন অবাস্তব এক খেলার নেশা তার আঙ্গুলের ডগায় ভর করে ফেলেছে ! কীবোর্ডে বাজিয়ে চলেছে নাইনথ সিম্ফনী । কলমীলতার মতো সঘন সবুজে সাজিয়ে লতিয়ে লতিয়ে সে সুর ছড়িয়ে গেছে বহুদুর । রায়হান গফুর তাই লিখলো –
“চিঠি শুধু চিঠি – ই । এর সৌগন্ধ আলাদা । একদম করমচা ফুলের মতো । তাকে মুক্তগদ্যের ছাপ দিতে চাইনে । আপনাকে পেয়ে আমার লেখার হাত খুলছে , বুঝলেন নিশীথা ? ”
সেই নিশীথাই মাঝখান থেকে হঠাৎ উধাও একদিন, আমার শেষের মেইলটির জবাব না দিয়েই । তারপরেই বেশ ক’দিন বাদেই মেঘবৃষ্টির আড়ালে হেসে ওঠা রোদ্দুরের মতো আবার নিশীথার মেইল এসে হাজির ।
---- “ অনেকদিন হলো আপনার মেইলের জবাব দেয়া হয়নি । দুঃখিত । ইচ্ছেকৃত নয় , আটকে ছিলুম অন্য কাজে । আপনিও তো একটা ফোন দিতে পারতেন, বলতে পারতেন এতোদিন কোথায় ছিলেন..."
নিশীথাকে আমি নিজ থেকে কখনও ফোন দিইনি । যা কিছু ফোনালাপ তার শুরুটা ওধার থেকেই । রায়হান গফুর তন্ময়ের ভেতরের সৌন্দর্য্যবান সংবেদনশীলতার কাছে এইসব ফোনালাপকে বড়বেশী উপযাজক হয়ে ব্যক্তিগত উঠোনে ঢুকে পড়ার মতো মনে হতো বলেই নিজ থেকে ফোন দেয়নি কখনও । আঙুলের ছড় টেনে টেনে যে সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা তোলা যায় , মুখে কি সে সুর তেমন ফোঁটে ?
উত্তরে লিখেছিলুম –
“ আপনার মেইলের "বলতে পারতেন এতদিন কোথায় ছিলেন..." এই লাইনটি আমাকে বনলতা সেনের কথা মনে করিয়ে দিলো । বনলতা সেন কবিতাটি আপনি পড়েছেন ? আপনার মতো বনলতাও সেদিন এমনি করেই বলেছিলেন - " ...তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে ; বলেছে সে, "এতদিন কোথায় ছিলেন ? " / পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন ।"
কবিতাটি আমার কাছে , আমার কাছেই বা কেন , সবার কাছেই অদ্ভুত সুন্দর লাগে তাই কোট করে দিলুম আবার আপনার জন্যে ।
হ্যা .. বলছি, এতোদিন কোথায় ছিলেন , শুনি ? ”
উত্তর এলো –
“ হারিয়ে গিয়েছিলুম কক্সবাজারে , দলেবলে । আমার যেতে ইচ্ছে ছিলোনা তেমন, কিন্তু কি করি ! আমার কর্তার বন্ধুবান্ধব সব । মাঝে মাঝেই এরকম হুটহাট বেড়িয়ে পড়ার স্বভাব আছে তার । দলেবলে আড্ডা দেয়া । বোতলে গ্লাসে ঠুং ঠাং আওয়াজ তুলে কয়েকটা দিন হৈ-হৈ করে কাটিয়ে দেয়া । আমার ওসব ভালো লাগেনা ।
যাকগে.....বনলতা সেন এর বাকীটুকু আর লেখেননি কেন ? বুঝতে পারছি বনলতা সেন আপনার পছন্দের , আমারও । তা আপনার গল্প লেখার কি হলো .......... ?”
খুব একটা অবাক হইনি আমি । নিশীথা বিবাহিতা এটা কোনও বড় চমক ছিলোনা সে মুহূর্তে। বরং নিশীথার সব লেখার ভেতর থেকে হঠাৎ করে ভাঙনের শব্দগুলো বড় বেশী বাজলো যেন কানে । নিশীথা কি অব্যক্ত কিছু বোঝাতে চেয়েছে এতোদিন ধরে ? এদেশে মানুষের চারিধারে নৈঃশব্দ হয়তো নেই কিন্তু প্রতিটি মানুষের ভেতরেই কিছু কিছু নৈঃশব্দ কি থেকেই যায় আগোচরে?
নইলে প্রথমদিকে কেন সে লিখেছিলো – “ ...... জীবন সম্পর্কে আপনার ব্যাখ্যাগুলো দারুন ভাবে আমাকে মুগ্ধ করে রাখে। সত্যি বলতে কি আপনার লেখার গাঁথুনী আমাকে মুগ্ধ করে ফেলে দারুন ভাবে। একাকী নিঃসঙ্গ আমার মত শুনে খুব দুঃখ পেলাম। সত্যি এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সারাদিন ব্যস্ত থেকেও আমরা ভেতরে ভেতরে কি একাকী এক এক জন। কাউকে ভর করে বেতস লতার মত লতিয়ে উঠতে চাই, আকড়ে ধরতে চাই, তাই নয় কি ! তারপর কিছু দিন পর সেই আকড়ে ধরা ডালটা ভেঙ্গে পরে যায় নিঃশব্দে....... “ ।
আমি জবাব দিলুম - “আপনার সাথে দ্বিমত করি । নিঃশব্দে নয় সশব্দেই ডালটি তখোনই ভেঙে যায় যখোন বেতস লতার মতো লতিয়ে ওঠাটা কোন দেনা পাওনায় জড়িয়ে যায় । যখন ঘুণ ধরে, তখন ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পড়ার কথা। তা কি সশব্দে হয় ? কি জানি..... !”
নিশীথাও তর্কে কম যায়নি । লিখলো --- “ হা...হা.. হা... আপনার দ্বিমতের সাথে আমাকে যে দ্বিমত করতে হচ্ছে এখোন ! ঘুণ পোকার শব্দ শুনেছেন কখোনো ? নীরবে নদীর পার ভেঙে পড়ার শব্দ ? নৈঃশব্দের মাঝেও যে আরেক অলৌকিক শব্দ বাজে, জানেন তো ? বাইরে থেকে কিছুই শোনা যায় না । কান পেতে রাখলে তবে শোনা যায় । ”
উত্তরে আমি আর বেশী কিইবা লিখতে পারতুম ? নিশীথার একান্ত নিজস্বতায় ঢুকে পড়া হয়ে যায় যে তাতে ! তাই এক লাইনে লিখলুম – আপনার লেখায় একটু কি আক্ষেপ , একটু কি হতাশারা ছায়া ফেলে গেলো !
এবারে যেন অনেকটা সোজা করেই লিখলো নিশীথা – “ কি জানি হয়তো বা ! হয়তো বা না। বুঝে উঠতে পারিনা কি চাই কেমনটা চাই । একটা ঘোরের মাঝে চলেছি মনে হয় যেন। রাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভাবি এমন জীবন কি আমি চেয়েছিলাম ! জানি না ....... ” ।
বুঝতে পারলুম, অজান্তে নিশীথার কোনও গোপন তন্ত্রীতে আমার হাত ছুঁয়ে গেছে । তা থেকে যদি বারে বারে কোনও বেদনার রাগিনী বেজে বেজে ওঠে তা রায়হান গফুর তন্ময়ের কাছেও অসম্ভব ভারী মনে হবে ।
নন্দন, তুই হয়তো অবাক হবি এটা জেনে যে, “ ভেতরে বাইরে” কলামটি লেখার কলামিষ্ট কেউ একজন, কারো এই ভেতর বাইরের খোঁজটি রাখেনি !
রায়হান গফুর তন্ময় তাই লিখলো --- “ আপনার লেখাগুলো পড়ে আপনাকে একটা কষে ধমক দিতে ইচ্ছে করছে । খুব ব্যবহারে মলিন এই কথাগুনো আবার নতুন করে আপনাকে বলি - " যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই । যাহা পাই তাহা চাইনে......"। আসলে জীবনটাই এমনি । কেউই আগেভাগে জীবনটাকে সোনালী ক্যানভাসে বন্দী করে রাখতে পারেনা, চাইলেও । পথ চলতে চলতে জটিলতায় ভরা এই পৃথিবীর যাবতীয় অনুষঙ্গ জীবনকে এখান থেকে ওখানে টেনে নিয়ে যায় । কে জানে কোথায় ! জীবন বড়ই ছটফটে অথচ কী সুন্দর ।
মন খারাপ হলে গুনগুন করে গান গাইতে পারেন বা শুনতে । গান ভালো লাগে আপনার ?
এই যাহ্ ........আহাম্মকী একটা প্রশ্ন হয়ে গেলো ! গান ভালো লাগে না কার ? .................”
নিশীথা উত্তর দিলো এরকম করে --- “..... রাত চারটে বেজে গেছে । আপনি হয়তো গভীর ঘুমে অচেতন । ঘরের লোকেরাও ওদিকটাতে ঘুমিয়ে । শুধু আমার ঘুম আসছে না । আপনার কথা মনে হলো । জানিনে কি ভাবছেন আমাকে । আপনি হয়তো জানেন না , জীবন সম্পর্কে আপনার ফিলোসোফিগুলো আমি মেনে চলতে চেষ্টা করি । আসলে বড়ই অদ্ভুত মানুষের এই জীবন ! আপনার ভেতরে বাইরে কলামখানি আমি মনযোগ দিয়ে পড়ি । । মাঝে মাঝে আপনার পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আপনার যে দু-একটা গল্প ছাপা হয় হঠাৎ হঠাৎ সেগুলোও পড়েছি আমি । মনে হয় আপনি বেশ পরিনত, রূচিশীল , বুদ্ধিদীপ্ত নইলে সুযোগ থাকা সত্বেও আপনার তেমন কোনও কলামে বা গল্পে কোনও নোংরামী বা অশ্লীলতা আপনি টেনে আনেন নি । আপনার এই পরিমিতি বোধ ভালো লেগেছে বলেই এই রাত জেগে আপনাকে লেখা । মনে হলো আপনাকে অনেক কিছুই হয়তো বলা যায় অকপটে................”।
নিশীথার এমন লেখা পড়ে রায়হান গফুর তন্ময় কি অবাক হবে ? তার মনের গভীরে কি অজস্র সঙ্গীতের গুঞ্জরন উঠবে ?
না....... নন্দন , আমার তেমন কিছুই হয়নি । আমার তেমন হওয়ার কথাও নয় । বরং ভয় পেয়েছিলুম । পক্ষাঘাতে আমার শরীরের বাম দিকটি, বিশেষ করে বাম হাতটি যে বেশ খানিকটা অচল সে তো তুই জানিস । এ রকম খানিকটা পঙ্গু একজনের এরকম সঙ্গীতের বিলাসিতা মানায় না । বরং নিশীথার লেখা পড়ে খুব মায়া পড়ে গেছিলো তার উপর । আমি তার জীবন কাহিনী জানিনে । জানিনে জীবন নিয়ে তার এমন হাহাকার কেন ! বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলুম । নিজের কাঁধটাকে এগিয়ে দিতে চেয়েছিলুম নিশ্চিন্ত নিরাপদে নিশীথা যেন সে কাঁধে মাথাটি রাখতে পারে বন্ধুর মতো ।
তাই লিখলুম ------ “ যদি বন্ধু বলে ভাবতে পারেন তবে প্রান খুলে বলুন, আমি শুনছি ...........”
নন্দন, কক্সবাজার থেকে নিশীথার ফিরে আসার পরে তার আগের লেখা মেইলগুলো আমি আবার পড়লুম । বারে বারে ।
মেলাতে চেষ্টা করলুম তার পাঠানো সব মেইলের সব কথা । নিশীথার বাইরেরটুকু আমি তেমন দেখিনি , ভেতরটাও কি দেখেছি খুব ! তাই মেইলের ঝাঁপি খুলে উঁকি দিয়ে তার ভেতরের সবটুকু দেখে মনে হলো , এখানেই থামা উচিৎ আমার । অনেকটা অকেজো হাতের মতো আমার মনের চোখ দু’টোও কি অকেজো হয়ে ছিলো এ্যাদ্দিন ? না কি; লেখা লেখা খেলায় মজে ছিলুম বলেই মাদুরের মতো বেছানো কারো মনের একটুকরো উঠোনের ভেতরে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখার ফুরসৎটি মেলেনি !
দু’টো হাত ধরার মধ্যে দিয়ে যে এতো বড় পৃথিবীটাকে কেউ ধরে ফেলতে পারে, জানা ছিলোনা ।
তাকে লিখলুম - “জীবন যেখানে যেমন, তাকে সেভাবেই নিতে শিখুন । পারছেন না ? হাহাকার উঠে আসে ? এটাই তো সংসারের নিয়ম ! পৃথিবীটা তো আর স্বর্গ নয় , এ যে কাঁটা বেছানো এক পথ । যে পথের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ ফুলের দেখাও মেলে । চোখ রাখতে হয় । এর পরেও জানি , জীবনটাকে যতোই হেলাফেলা করিনে কেন , তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই না কেন , মাঝে মাঝে জীবনের হিসেবটা নিয়ে বসতেই হয় । ইচ্ছায় কিম্বা অনিচ্ছায় । এই যেমন আমি, পক্ষাঘাতগ্রস্থ একটি মানুষ । বাম হাতটি তেমন নাড়াতে পারিনে খুব একটা । নিতান্ত সাধারন । সেই সাধারনত্বকে পুষিয়ে দিতে লেখালিখির কাজ করি । আপনার সাথে তাই এই লেখালিখির খেলায় আমার নিজের অপূর্ণতাকে ভুলে থাকার একটা পথ তৈরী হয়েছে । অকেজো বাম হাতটির ক্ষতি পুষিয়ে ডান হাতটি কী-বোর্ডে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে । আমার লেখা যে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সে কথা আপনাকে আগে লিখেছিও আমি ........”
জানিস নন্দন ; নিশীথাকে সেই-ই আমার শেষ লেখা । নিশীথা সেই লেখার জবাব আর দেয়নি আমাকে । কোনদিন দেবেও না , জানি । শুধু ফোনটিই নয় , তার মেইল এ্যাড্রেসটিও সরে গেছে আমার থেকে । আকাশের তারা গুনতে গিয়ে চাঁদটাই হারিয়ে গেছে যেন !
নন্দন ; নিশীথা আমাকে চিঠিতে লেখা শব্দমালা সাজিয়ে মুক্তগদ্য লিখতে বলেছিলো । সেই মুক্তগদ্যটিই আমি লিখবো এখন নিশীথাকে নিয়ে ...............
[ ছবির কৃতজ্ঞতা ইন্টারনেট এ সমর্পিত । ]
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:০৭