নিলীমা বোঝেনা । বোঝেনা ।
বোঝেনা বলেই নিলীমা হুটহাট হারিয়ে যায় এদিক সেদিক । ভ্রমর পাখনা মেলে ঘরের আগল খুলে আলটপকা কই কই যে যায় ! সন্ধ্যেবেলার অপেক্ষা রাতে গড়ায় । নিলীমা ফেরেনা । কোন তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে সে কখন কোথায়, কোনখানে ! এদিকে পূর্ণিমায় যে নোনা গাঙে জোয়ার উথলায় , মাঝ পুকুরে ঘাঁই মারে পোনামাছ তার টুকটাক গল্প অজানা থেকে যায় নিলীমার কাছে । নিলীমার এই না থাকা যে বুকের গাঙে , মনের পুকুরেও কষ্টের ঘাঁই মেরে যায় তার ব্রাত্যসঙ্গীত এক তুড়িতে উড়িয়ে হররোজ তার কিন্নরী পায়ের ঝঙ্কার সরে সরে যায় দূর থেকে আরও দূরে ...... !
নিলীমা বোঝেনা , যে ভাঙা জমিনে তার পরাগায়ণ সে জমিন পড়ে থাকে একা এবং একাকী অনাবাদি । একটুখানি জলে তার গতর যে লাউডগার মতো লকলকিয়ে উঠতে পারে বোঝেনা সে, বোঝেনা ! সে জমিনের ভাঙা শরীরের ভেতরেও কোথায় কাউকে মুগ্ধ করার মতো আস্ত একখানা মন যে বসে থাকতে পারে, খুলে রাখতে পারে উদোম বুক,বইয়ে দিতে পারে উথাল পাথাল ভালোবাসা নিলীমা বোঝেনা তা-ও ! নিলীমা বোঝেনা, সেখানেই আছে তার দু’দন্ড জিরোবার ঠাঁই, বসে থাকা চুপচাপ,সবই । সেখানেই বাঁধা আছে তার ভালোবাসার ময়ুরপঙ্খি নাও, আছে ঘাট ,পারাপারের মাঝি ।
তবুও ফাজিল একটা পাখির মতো টুক করে ডেকে নিলীমা পূবে উড়ে যায় । এ তার নিত্যদিনের চর্চিত কানামাছি -ভো -ভো খেলা । তার নি-আঁচল শরীরের পালে বাউল হাওয়া লাগিয়ে সে তখন দিগ্বিদিক। ভাঙা জমিনের সিক্ত ভালোবাসা সে বাউরি হাওয়ার ঝাপটায় শুকিয়ে যেতে চায় । ভরা চৈত মাসের খরা ভর করে যেন ভাঙা জমিনের আলে, এক অকালে। থোকায় থোকায় ধরে কষ্টের গোটা গোটা বেতফল !
নিলীমা পরিযায়ী হয়ে ওঠে । থিতু হয়না কোথাও । এ যেন তার অনেককালের অর্জিত অভ্যেস ।
নিলীমা বোঝেনা , কোথায় তার সেই জোনাক জ্বলা রাত । অন্ধকারে পিদিম জ্বালা গাঁয়ের মেঠোপথে কি করে হাটতে হয়, হাতে রেখে হাত ! বোঝেনা কোথায় বা সেই ছায়া সুনিবিড় হিজল গাছের তল ! শিশির ভেজা ভোরের দূর্বাঘাসের দল হাতে তুলে দিলেও নিলীমা বোঝেনা, এ যে তার মেখলা কুন্তল । দীর্ঘদিন প্রতীক্ষায় থাকার পরে এ যে তার প্রাপ্তি , সে প্রাপ্তির ধানিস্বাদও বোঝেনা সে ।
অবুঝ নিলীমা ছুটে চলে পথ থেকে পথে, নিশিন্দির ডাক ডেকে যায় । ধরা দেয়না । লুটানো শাড়ীর আঁচলের মতো ভোরের ভ্যাবলা রোদ্দুর তখন লুটিয়ে থাকে জানালায় । ঝুলবারান্দায় বসে থাকে ন্যাতানো বিকেল । বিপুল স্তনের মতো তুলতুলে, কামজর্জর উদ্ধত রাত ফনা তোলে । সে রাত উজিয়ে টেরি কেটে দাঁড়ায় এসে আর এক ভদ্রবেশী ভোর । মালয় সাগর থেকে নীমোর প্রান্তর ঢুঁড়েও দেখা মেলেনা নিলীমার।
নিলীমা বোঝেনা প্রতীক্ষা শুধু কতো কষ্টের ।
লাঙল চষে চষে ভাঙা জমিনের অতল থেকে খুঁড়ে তোলা এসব কথারা নিলীমার চেতনবৃক্ষের ডালে ডালে কখনও দোলা দিয়ে গেছে কিনা তা নিলীমার খেড়োখাতায় লেখা হয়নি কস্মিনকালেও । নিলীমা বোঝেনা, হৃদয়ের নিলয় থেকে ঝর্ণার মতো অঝোর বেয়ে বেয়ে সে রঙিন কথারা যে তার ধমনীর হেই সুদূর-সর্পিল পথ পাড়ি দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত ।
জীবনবোধের অনভিজ্ঞতা থেকেই নিলীমা বুঝি অপরিতোষণীয়া হয়ে ওঠে । গাছের আপেলটাকে জীবনভর সে যে গাছেই ধরে রাখতে পারবেনা, নিলীমা বোঝেনা তা । মধ্যাকর্ষন যে অমোঘ এক নিয়ম বোঝেনা নিলীমা ।
চোখে চোখ রেখে বোঝাতে হয় । বড় অবুঝ চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে নিলীমা । যেন রূপকথার এক গল্প শুনে ফেলেছে সে । তার জন্যে তুলে রাখা সব শব্দরা তখন গোসসা করে । সব কিছু যে সব কিছুর মতো হয়না, নিলীমা বোঝেনা । এই মায়াটুকুই যে আমাদের নুন-লঙ্কা ! আর তখনই নিঃসংসার সাধু হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে । কাঁধে বোঁচকা-পুটুলী, দু’প্রস্থ জামা, জীর্ণ তোয়ালে আর কিছু টুকিটাকি নিয়ে হাটতে হাটতে সমুদ্রকে দূরাগত করে তুলি । সমুদ্দুরের বিপরীতে জলাভূমি, ঢিবি, এবরো থেবরো কন্টকময় পথ, অনুচ্চ পাহাড় ডিঙোই গৌরিক সাধু বেশে । তবুও সাধু কি হওয়া যায় ? সাধু সাজা যায় , সাধু হওয়া যায় না !
নিলীমাকে বোঝাই , সাধু হতে গিয়েও সাধু হয়ে ওঠা হয়না আমার ! গৃহীমানুষের পিঞ্জরের রোজকার কবাট খুলে ভারী গতরের দেমাগ নিয়ে হুটহাট সেই যে নিলীমা অনায়াস বেড়িয়ে যায় , নিলীমা বোঝেনা লোডশেডিং হয়ে যায় তাবৎ গৃহে গৃহে । হুলুস্থুলু লেগে যায় তামাম পৃথিবীতে ।
নিলীমা কেন যে বোঝেনা !!!!!!!!!!!
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:০১