পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন, ফিরে আর আসবে কি কখনও ......
[ ছবি ও লেখা ব্লগ ]
[ প্রথম পর্ব ]
জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো ......... যুগ যুগ ধরে শোনা এমন কথাটির একটি আবেগীয় অনুভূতির মূর্চ্ছনা দিয়ে লেখাটি শুরু করতে পারলে ভালো হতো । ভালো হতো বলছি এ কারনে যে, এই অনুভূতিটা আজ যে জনে জনে মরে গেছে সেটা যদি না হতো।
এই জনমানুষের নিঠুর থাবার নীচে যে শ্যামলীমার কিছুটা আজও বেঁচেবর্তে আছে , সময়ের পালাবদলে যে নিঃস্বর্গের অপরূপ ছায়া মানুষের অবিমৃষ্যকারীতায় বদলে বদলে গিয়ে এখনও আবছায়া হয়ে ধরা দিয়ে যায় চোখে , বেঁচে থাকার অসম দৌঁড়ে যে মানুষ নামের আত্মীয়গুলো অনাত্মীয় হয়ে কোথায় ভেসে যায় ক্রমে ক্রমে তারই যেটুকু ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে ওখানে , তাই বা কম কিসে !
অনেকেই হয়তো এই কমটুকুরও খোঁজ রাখেন না । মানব থেকে অমানবিক হয়ে যাওয়ার এই সর্বগ্রাসী সময়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে কোনও কিছুই হয়তো তার মনে দাগ কাটেনা ।
আর দাগ কাটেনা বলেই, যে কজন মানুষ সর্বগ্রাসী সময়ের এই অভিঘাত সয়েও এখনও “জন্ম আমার ধন্য হলো...” বলতে পেরে ধন্য হয়ে যান লেখাটি তাদের জন্যে ।
এই ছবি ও লেখা ব্লগটি সাজানো হয়েছে কয়েকটি অধ্যায়ে – বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত আর গ্রীষ্ণ নিয়ে ঋতুচক্র – পালাবদলের দিন, নিঃস্বর্গ, দেশ ও জীবন গাঁথা ; এমন করে।
আমার একটি পোষ্ট “মাগো, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে .....” [ ছবি ও লেখা ব্লগ ] তে সহব্লগার সচেতনহ্যাপীর মন্তব্যটিই আমার এই ছবি ও লেখা ব্লগটির প্রেরনা । প্রবাসী এই মানুষটির অন্তরে “ ইনহাস্ত ওয়াতানম...” এর আবেগ জড়ানো ক্ষুধায় কাতর যে লুকোনো ছবি দেখেছি আমি, তাকে সম্মান করেই এই ছবি ও লেখা ব্লগটি তাঁকে উপহার দিলুম......
নিত্যগামী কালের রথে চড়ে পাখির বাসার মতো ঠাস বুনটের প্রকৃতির যে ছবি ঘুরে ঘুরে আসতো তাকেই বোধহয় লোকে বলতো, ঋতুচক্র । বারোটি মাস জুড়ে চলতো পালাবদলের মোড়কখুলে প্রকৃতির নিজেকে মেলে ধরার নৈঃস্বর্গিক খেলা । এই মাটিতে কখনও সে কাঁদতো ঝরঝর, কখনও নীলাম্বরী শাড়ীতে নববধূর মতো ঢেকে রাখতো শরীর। কখনও বা সোনালী ধানের গন্ধ ভরা গায়ে মেখে নিতো কুয়াশার পরশ । শিহরিত হত ক্ষনে ক্ষনে । ফুলে ফুলে নিজেকে সাজিয়ে তুলতো কখনও বা । আর তার শরীরের পরতে পরতে লুকানো মোহময়ী এই লাস্যপঞ্চমী নৃত্যে যখন বছর পার হয়ে যেত তখন নতুন বছরের শুরুতেই ফুঁটে উঠতো তার আর এক রূপ । সে রূপ রুদ্র বৈশাখের মতো চন্ডালিনীর । ক্রোধের আগুনে ঝলসে দিত চারিধার ।
এসবই ঋতুচক্রের পৌরানিক কাহিনী ।
এখন ঋতুচক্র আর মান্ধাতা আমলে পড়ে নেই । আধুনিকা হয়ে উঠেছে সে দিনে দিনে । খোলস বদলে বদলে গেছে তার, দ্রুত তালে। মানুষের অবিমৃষ্যকারীতার সাথে নিরন্তর পাল্লা দিতে গিয়ে ঋতুচক্র আজ চরিত্র হারিয়েছে । কখন যে সে কাঁদে , কখনই বা ওঠে রেগে আর কখনই বা লাজনম্র হয় তা বুঝে ওঠা ভার । সে আধুনিকার রঙ ও ঢং এখন আর বারো মাসের ছয় ছয়টি কাল ব্যাপী খন্ডিত চিত্রে আলাদা করে চিত্রিত হয়না । একটা রঙ কখন যে আর একটা রঙে ঢুকে পড়ে খেয়াল রাখতে হয় খুব ভালো করে ।
এমন দিনে তারে বলা যায় , এমন ঘনঘোর বরিষায় ....... ।
বলা গেলে হয়তো ভালো হতো কিন্তু সময় যে বড় বৈরী এখানে । এখন আর কারো মন কাঁদেনা তেমন করে । ঘনঘোর বরিষার অপেক্ষায় থাকেনা আর তেমন কেউ । বরং ছিটেফোঁটা বৃষ্টির হাত থেকেও গা বাঁচাতে, গেল গেল রব তুলে সজোরে জানালা কবাট বন্ধ করে ফেলে ।
ঝরঝর বর্ষাও যেন আজকাল তাই অনাদরে –অবহেলায় হয়ে গেছে ডুমুরের ফুল । একপশলা দু’পশলা করে ঝরে যায় এখানে ওখানে কৃপনের মতো। মানুষ যেমন পাল্টে গেছে বর্ষাকালও গেছে তেমন পাল্টে ।
এদেশে বর্ষাকালেরও একদিন ছিলো ভরা যৌবনের দিন । ঝরঝর , ঝুম বর্ষার দিন । আকাশ যেন ভেঙে যেত তুমুল জলভারে । ঝরছে তো ঝরছেই, দিন পেড়িয়ে হপ্তা ধরে । সারা দেশটি জুড়ে । মাটির কানে কানে তার যে কতো কথা, ফুরোতোই না যেন । কবিও বন্দনা করে গেয়ে যেতেন বর্ষা মঙ্গলের গান। সরোদ আর বাঁশীতে বেজে উঠতো মেঘ মাল্লার রাগ ।
বর্ষার যৌবনে এখন লেগেছে টান । প্রকৃতিকে অবহেলা ভরে মানুষ যতো কারসাজি করেছে , বর্ষামেয়ে বিমুখ হয়েছে ততো । শরীর-গতরে তার সে জেল্লা আর নেই । চকিত হরিনীর মতো তার আসা যাওয়া , ক্ষনেকের । তাও আবার লোডশেডিং এর মতো । একই শহরের এ মাথার আকাশ থেকে ঝরে তো ও মাথায় তার টিকিটিরও দেখা মেলেনা আজ।
তবুও যেটুকু তার মধুর মুরতি অন্তরে ঝিরঝির করে ঝরে যায়, তা-ও এই জল-কাদা-মাটিকে সাজায় স্নিগ্ধসজল মেঘকজ্জল এক একটি নতুন দিনে ......
ওগো বর্ষা তুমি ঝরো নাকো অমন করে ....
ধীরে অতি ধীরে পত্র পল্লব ঘিরে
নেমেছে দেউল প্রান আকুল .....
জলের কনক আভায় তারে
সাজাই থরে বিথরে .....
রিমঝিম ঝিম বৃষ্টি, মাটির কানে কানে
কি কথা নিয়ে যেন পড়ে ঝরে ঝরে,
আমার সারা দিন কি ভাবে কেটে যায়
শুধু তুমি....তুমি করে ........
কাজল মেঘের উড়িয়ে আঁচল আর
দিনান্তের আলো মেখে গায়,
কে তুমি যাও বাতাসের নায় ?
কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে .....
প্রখর খরদাহ ভুলে
আষাঢ়ের প্রথম কালে
ওগো মা , সাজাই তোমায়
হরিদ্রাভ কদমফুলে .......
বৃষ্টি ঝরে গেছে একটু আগে
ক’টি কাক বসে আছে তারে,
কি জানি কি আলাপন
গভীর গোপন, ভিজে শরীরে .........
বর্ষা যে শুধু স্নিগ্ধ করে তাপিত ধরাতল তা-ই নয়, ভালোবাসার অমোঘ টানে ভাসায় নদীর দু’কুল । বন্যা আসে । ভেসে যায় আমার ঘর-গৃহস্থালী । দিগন্ত জোড়া ফসলের ক্ষেত জল থৈ-থৈ করে । জীবন হয়ে ওঠে জলমগ্ন । জলধির সে আর এক রূপ, সর্বগ্রাসী । তবুও মানুষ বেঁচে থাকে একই আকাশের নীচে । স্রোতের টানে টানে জীবন তাকে নিয়ে যায় এ ঘাট থেকে অন্য ঘাটে .........
তবুও যেতে হয়
ঐ দূর গায়, জল ঢাকা পথে ।
যেথায় নবীন পাতায় , পাঠশালায়
অক্ষর সেজে বসে আছে
আমারই আশায় ..........
জল থৈ-থৈ বরষায়
কোন ভরসায়
পথে নামি,
হে অন্তর্যামী .......
হে বন্যা , সর্বনাশী
আমি যে পথে পথে ভাসি .....
আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে হাড়িতে
বন্যা ঠাকুর এলো বাড়ীতে .....
কি ভাগ্য আমার !
চারিদিকে পানি আর পানি ।
তবুও দু’ঢোক তৃষ্ণা মেটাবার জল,
কোথা পাবো নাহি জানি ......
বিবশ ধরাতল অলস অচল
থির হয়ে আছে আঙিনায়,
কলসি কাঁখে জল ভেঙে ভেঙে
কোন অপ্সরী ঐ যায় ......
নিঝুম চরাচরে
জলমগ্ন ঘরে
কতো কাজ
আছে যে পড়ে ......
কোথা থেকে কোথা
হে জলডুব বসুধা
নিয়ে যাবে মোরে ......
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী
একা একা করি খেলা ....
বৃষ্টিধারার একটুখানি স্নেহের পরশ মাঝেমাঝে তাপদাহে ঘেমে-নেয়ে ওঠা আমাদের এই পঙ্কিল শহরে নিয়ে আসে স্বস্তির একটুকরো আবেশও । নেচে ওঠে মনের ময়ূর, তা..তা... থৈ...থৈ..তা...তা..থৈ ... । দুরন্ত কৈশোর মানে না কোনও বাঁধা । উচ্ছাসে আবেগে ভরপুর এক নিষ্কলুষ মানবাত্মা যেন খেলা করে যায় ...........
কে কে তোরা খেলবি রে আয় -
মেখে জলের আদর গায় ......
এই একটুখানি পাওয়া
বৃষ্টি স্নানে যাক ভিজে যাক
আমার সকল চাওয়া ....
সেদিন দু’জনে
এক বরষার দিনে ........
আহা ... কি মিষ্টি, একটু বৃষ্টি
ঝরিছে হৃদয় জুড়ে .....
আমার একটি পোষ্ট “মাগো, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে .....” [ ছবি ও লেখা ব্লগ ] তে সহব্লগার সচেতনহ্যাপীর মন্তব্যটিই আমার এই ছবি ও লেখা ব্লগটির প্রেরনা । প্রবাসী এই মানুষটির অন্তরে “ ইনহাস্ত ওয়াতানম...” এর আবেগ জড়ানো ক্ষুধায় কাতর যে লুকোনো ছবি দেখেছি আমি, তাকে সম্মান করেই এই ছবি ও লেখা ব্লগটি তাঁকে উপহার দিলুম........
চলবে ..........
ছবি – ইন্টারনেট থেকে ।
প্রতিটি ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি তাঁদেরই যারা ছবিগুলোর প্রকৃত দাবীদার ।
আর স্বনামধন্য যে সব কবি-লেখকের দু’একটি চরন তুলে এনেছি, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি সেই মহাগুনীজনদের ও ।
এদের সকলের কাছেই ঋনী হয়ে রইলুম ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৫