somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিষিদ্ধ যতো বই .......

২০ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নিষিদ্ধ যতো বই .......
[ প্রথম পর্ব ]

"বই" ।
দু'অক্ষরের একটি শব্দ মাত্র কিন্তু কী বিশাল এর পরিধি, কী অতলান্ত এর গভীরতা । তাই কি সৈয়দ মুজতবা আলী বলে গেছেন --- রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে , প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয় ?
আসলেই তাই । বই যারা ভালোবাসেন, বই পড়েন তাদের কাছে এক একখানা বই-ই তেমনি অনন্ত যৌবনা ।
এই যেমোন আপনার কাছে হয়তো সযতনে রাখা আছে বহুবার পঠিত
" অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েষ্টার্ণ ফ্রন্ট " বই খানা । এটা আপনার প্রিয় বইয়ের তালিকায় । কারো কাছে " আঙ্কল টম'স কেবিন"। কারো কাছে
" অলিভার টুইষ্ট" বা "এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস" কিম্বা কারো কাছে
" ড্রাকুলা" ।
কিন্তু আপনি কি জানেন, বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে ঠাই পাওয়া এইসব বইগুলোর সবার গায়েই যে "ব্যানড বুকস" ছাপ মারা ছিলো কোনও কালে ? এরা যে এক কালের নিষিদ্ধ সব বই ?
এমোনকি আপনার সোনামনির প্রিয় " এ্যালিস'স এ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড" বইখানাও এই "ব্যানড" ছাপের হাত থেকে রেহাই পায়নি ?
রেহাই পায়নি মার্ক টোয়েন এর শিশুতোষ বই " টম সয়্যার" ও ।
নিষিদ্ধের খাতায় নাম লেখানো এই সব বইগুলো আপনার কাছে যেমোন সবই ক্লাসিক , তেমনি বিশ্ব সাহিত্যের দরবারেও । তারপরেও কেন এদের গায় "ব্যানড" ছাপ সেঁটে দেয়া হয়েছিলো ? আপনি হয়তো বলে বসবেন , ওসব ব্যান-ফ্যান তো আগে হতো এখোন আর হয়না । এখোন মুক্ত চিন্তার যুগ । ফ্রীডম অব স্পীচ এর কাল ।

ভুল ।

এই ২০১২ সালেই বই ব্যান করার ঘটনাই ঘটেছে সাড়ে চারশোর ও বেশী বার । আরো অবাক হবেন এটা জেনে যে, এই ব্যানড তালিকায় আছে পৃথিবী কাঁপনো বই "হ্যারি পটার" । এই হ্যারি পটার ছবিটি দেখা কিম্বা বইটি কেনার জন্যে আপনি কতো কোশেশ ই না করেছেন ।

একটি বই ব্যান করা হয় মূলত সেন্সরশীপের কারনে । আর এতেই বইটিকে সরে যেতে হয় লাইব্রেরীর সেলফ থেকে । এটি ঘটতে পারে রাষ্ট্রীয় কিম্বা স্থানীয় প্রশাসনিক পর্যায়ে । এতে আইনগত ভাবেই বইটি নিষিদ্ধ হবার সাথ সাথে বইটির সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে না কাউকে জরিমানার মুখে পড়তে হয় । আবার বইটি সামাজিক স্তরে স্থানীয় রোষানলেও পড়তে পারে । ফলে এটি কোনও কোনও স্কুলের তালিকা থেকে সরিয়ে ফেলা হতে পারে কিম্বা লাইব্রেরী থেকে টেনে নামানো হতে পারে । পুড়িয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটতে পারে ।

কি দোষ বই এর ?
দোষ অনেক । সব বই ই যে সবার কাছে সমাদৃত হবে এমোনটা কিন্তু নয় । রাষ্ট্রীয় নেতারা এখানে রাষ্ট্র কিম্বা তাদের বিরুদ্ধে কিছু খুঁজে পেতে পারেন । ধর্মীয় পুরুত ঠাকুরেরা ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা বা অশালীনতার দাগ দেখতে পেতে পারেন । সুশীল সমাজ বিধায়করা সমাজ উচ্ছন্নে যাবে এমোন কিছুর আঁশটে গন্ধ পেতে পারেন । আবার রাজনীতিবিদরা তাদের মৌরসীপাট্টার প্রতি হুমকি দেখতে পারেন । ইত্যাকার... ইত্যাকার কারনে বইটি "ব্যানড" ছাপটি গায়ে মাখতে পারে । যদিও এই ছাপের গন্ধ তার গায়ে বেশীদিন থাকেনা । আবার এসে হাজির হয় আপনার সামনে ।

ইতিহাসের অনেকটা কাল জুড়েই এই সেন্সরশীপের ব্যাপারটি ছিলো , আছে এখোনও । যদিও এখোন ফ্রিডম অব স্পীচ এর যুগ তবুও এখোনও রাজনীতি, ধর্ম কিম্বা যৌনতা নিয়ে বাড়াবাড়ি কিছু দেখলেই বা মতের অমিল হলেই কিছু মানূষ মুঠি পাঁকিয়ে তেড়ে আসেন বই লেখকের দিকে । মাঝেমাঝে লেখকের মুন্ডটিও চাই তাদের । বইটি চলে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে । কারো ঘরে এমোন ব্যানড ছাপ মারা বইটি দেখতে পেলেই হয়েছে । শ্রীঘরেও যেতে হতে পারে ।
একালে ধন্যবাদ দিতেই হয় স্টীভ জোভসকে । এই ভদ্রলোকের কল্যানে এখোন আর কিছুই রাখঢাক নেই । সবাই সব কিছু পেতে পারেন অন্তর্জালে । সার্ন (CERN) বা য়্যুরোপীয়ান অর্গানাইজেশান ফর নিউক্লিয়র রিসার্চ এর কথাই বা বাদ যায় কেন ? এই যে আপনি ওয়র্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) এ সারা পৃথিবী ঘুরে আসছেন তার আঁতুড় ঘর কিন্তু এটাই । এদের কল্যানেই আপনি পেতে পারেন সব , কী ব্যানড বা আনব্যানড ।।

এমোন কিছু "ব্যানড" বা "নিষিদ্ধ" ছাপ মারা বইয়ের কথা নিয়েই বসেছি । যদি পড়তেই ইচ্ছে করে তবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ুন -

Alice's Adventures in Wonderland
এ্যালিস'স এ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড


Title page of the original edition (1865)

"এ্যালিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড" এই নামেই আপনি চেনেন তাকে । শিশুতোষ ফ্যান্টাসি বই । ছোট্ট বেলায় কে না পড়েছেন এই বইটি ? স্বপ্ন দেখার মতো মুগ্ধ হয়ে মজে ছিলেন ছবি আর গল্পে ।

১৮৬২ সালের জুলাই মাসের একটি স্বর্ণালী বিকেলে ( মতান্তরে হিমশীতল, মেঘাচ্ছন্ন আর বৃষ্টিভেজা বিকেল ) টেমস নদীপথে অক্সফোর্ডের কাছের ফলী ব্রীজ থেকে গডসটো, এই পাঁচ মাইল নৌকা ভ্রমনকালীন তিন তিনটি কিশোরীকে আনন্দ দিতে যে গল্পটির শুরু তা আজ সারা বিশ্বব্যপী লক্ষ লক্ষ ছোটবড় পড়ুয়াদের কাছে অনন্য সাধারন এক ফ্যান্টাসি হয়েই আছে ।
অক্সফোর্ড য়্যুনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর এবং ক্রাইষ্ট চার্চ এর ডীন হেনরী লিডেল এর তিন কন্যা লরীনা শার্লট লিডেল , এ্যালিস প্লেজান্স লিডেল আর এডিথ মেরী লিডেলকে রেভারেন্ড চার্লস লুৎউইজ ডসন নদীপথে যেতে যেতে যে গল্পটি শুনিয়েছিলেন, তিন বছর পরে ১৯৬৫ সালে "লুইস ক্যারল " ছদ্মনামে তাকেই বই হিসেবে প্রকাশ করেছেন তিনি । পর্বে পর্বে বেরিয়েছে বইটি । শুরুতে সমাদৃত হয়নি মোটেও । কাহিনীর চেয়ে বইটির ছবি আঁকিয়ে জন টেনিয়েল এর আঁকা ছবিগুলোই দৃষ্টি কেড়েছে বেশী । বইটির দ্বিতীয় পর্ব " থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস " বেরুনোর পরেই এর কদর বাড়ে । বিশ শতকের শেষে বইটি দাঁড়িয়ে যায় সেরা ফ্যান্টাসি হিসেবে । নামটিও সংক্ষিপ্ত হয়ে "এ্যালিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড" হয়ে যায় । ৯৭টির ও অধিক ভাষাতে প্রকাশিত হয়েছে বইটি । শত শত সংযোজন হয়েছে এর । অসংখ্য অভিযোজন হয়েছে কাহিনীতে । কী বইয়ে, কী চলচ্চিত্রে , কী নাটকে ।

আপনাদের মতো বইটি পড়ুয়াদের একদম প্রথম দিকের সারিতে ছিলেন স্বয়ং ইংল্যান্ড সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া আর কিশোর অস্কার ওয়াইল্ড । আপনারা কারা কোন অভিযোজিত সংষ্করনটি পড়েছেন জানিনে, তবে কাহিনীর শুরুটা এক স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে এরকম .....
বড় বোনের সাথে নদীর ধারে বসে বসে বিরক্ত হয়ে যাওয়া এ্যালিস নামের মূল চরিত্রের মেয়েটি হঠাৎ করেই কোটপ্যান্ট পড়া কেতাদুরস্ত আবার পকেট ঘড়িওয়ালা এক সাদা খরগোসকে কথা বলতে বলতে তাদের সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখে । এই অদ্ভুত প্রানীটিকে অনুসরন করে একটা খরগোসের গর্তে ঢুকে পড়তেই এ্যালিসের সামনে খুলে যায় এক আজব জগত । যেখানে আজব সব প্রানীরা । তারপরে এগুতে থাকে ফ্যান্টাসি । কাহিনীর শেষে তাসের দেশের এক বিচার সভায় দেখা যায় এ্যালিসকে । তাসের রানীর সাথে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে কাগজের তাসগুলো এ্যালিসের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তেই চা খেতে বড় বোনের ডাকাডাকিতে স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় তার । বড় বোনটি এ্যালিসের মুখের উপর দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়া তাসগুলো নয়, ঘুমন্ত মুখের উপর থেকে ঝড়ে পড়া পাতাদের সরিয়ে দিতে থাকে ।

গল্পটির ঘটনাপ্রবাহ বেশ যুক্তিসম্মত ভাবে তৈরী করা হয়েছে যা ছেলেমেয়েদের তো বটেই বড়দের কাছেও বইটিকে চীরকালের জন্যে জনপ্রিয় করে তুলেছে । গল্পটির বর্ণনা, এর গঠন আর এর চরিত্রগুলো এবং দৃশ্যকল্প স্বপ্নের জগতে বাস করা প্রজন্মকে দারূনভাবে প্রভাবিত করেছে ।
লেখক ডওসন (লুইস ক্যারল) বইটিতে বেশ কিছু সিম্বলিজম তুলে এনেছেন । এর চরিত্রগুলো , দালান-কোঠা আর ঘটনা প্রবাহের অনেকটাই অক্সফোর্ড এবং ক্রাইষ্ট চার্চ এলাকার মানুষজন, ঘরবাড়ী আর লৌকিক পরিবেশের সাথে মিলে যায় । খরগোসের যে গর্তটির ( র্যা বিট হোল) ভেতর দিয়ে গল্পের ডালপালা ছড়িয়েছে সে গর্তটি আসলে অক্সফোর্ডের ক্রাইষ্ট চার্চ কলেজের প্রধান ভবনের পেছনের ঘোরানো সিড়িটি । রিপন ক্যাথেড্রাল, যেখানে ডওসনের বাবা যাজকগিরি করতেন সেই ক্যাথেড্রালে খোদাই করা গ্রিফ্যান ( মাথা ও পাখা ঈগলের ন্যায় আর দেহটি সিংহের মতো দেখতে এক কল্পিত প্রানী ) আর খরগোসের মূর্ত্তি দেখে হয়তো ডওসন প্রভাবিত হয়ে গল্পের এই সব আজগুবী প্রানীদের চরিত্র সৃষ্টি করে থাকবেন । আবার যেহেতু ডওসন ক্রাইষ্ট চার্চ কলেজের ম্যাথেমেটিসিয়ান ছিলেন তাই আপনি এই গল্পে অনেক ম্যাথেমেটিক্যাল কনসেপ্টস দেখতে পাবেন । যেমোন দ্বিতীয় পর্বে আজব দুনিয়ার অনেক "মিরর ইমেজ" দেখানো হয়েছে যেখানে সবাইকে উল্টো দেখাচ্ছে বা সময় পেছনের দিকে দৌড়ুচ্ছে দেখা যাবে । মাথায় হ্যাট পড়া ম্যাড হেটার নামের যে চরিত্রটি আছে তার হ্যাটে যে তাসের ছবিটি আছে তাতে লেখা
"১০/৬" (10/6) । তাসটি একটি প্রাইজ ট্যাগ । 10/6 দিয়ে বোঝানো হয়েছে ১০ শিলিং ৬ পেনি । ইংলিশ পাউন্ড, শিলিং, পেনি কে বোঝাতে সেসময় ইংল্যান্ডে l/s/d এই অক্ষরগুলো ব্যবহার করা হতো ।
এভাবেই সব ঘটনা প্রবাহ বইটিকে একটি আজব শিশুতোষ ফ্যান্টাসি করে তুলেছে ।
আবার পাশাপাশি বইখানিকে "লিটারারী ননসেন্স" এর চমৎকার উদাহরন এর তালিকায়ও ফেলা হয়েছে ।


Page from the original manuscript copy of Alice's Adventures Under Ground, 1864



কে এই এ্যালিস ? কেউ কেউ বলেন , ভাইস চ্যান্সেলর হেনরী লিডেল কন্যা এ্যালিস প্লেজান্স লিডেলই গল্পের এই এ্যালিস । দশ বছরের এই কিশোরীটি-ই নাকি রেভারেন্ড চার্লস লুৎউইজ ডসনকে গল্পটি তাকে লিখে দিতে বলেন । এখানেই " পেডোফিলিয়া"র গন্ধ খুঁজে পেয়েছে কারো কারো নাক । এরকম নৌকা ভ্রমন তারা যে আরো বার দুয়েক করেছেন, এই তাদের যুক্তি । ডওসন নিজ হাতে লেখা পান্ডুলিপিও উপহার দিয়েছেন এ্যালিস প্লেজান্স লিডেলকে এই কথা লিখে - " গরমের দিনের একটি স্মৃতির স্মরনার্থে প্রিয় এক কিশোরীকে বড়দিনের উপহার "। পাশাপাশি তারা তুলে ধরেছেন , গল্পকার ডওসন এর তোলা ওই তিন কিশোরী কন্যার উলঙ্গ ছবির প্রসঙ্গ । যদিও সেকালে, সেই ভিক্টোরিয়া যুগে উলঙ্গ ছবি তোলা আর্টিষ্টদের জন্যে একটি সাধারন ব্যাপার ছিলো মাত্র তা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হলেও । ডওসন ছবি তোলার আগে কিশোরী কন্যাদের মায়ের অনুমতি নিয়েছিলেন যদিও । বলেছিলেন, তার মৃত্যুর পরে ছবিগুলো পুড়িয়ে ফেলা হবে । পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো কিনা জানিনে তবে তার ছাইভস্ম ডওসন এর উপর ছড়িয়ে পড়েছে । ছড়িয়ে পড়েছে বইটির গায়ে ও । ১৯০০ সালে প্রায় একই অভিযোগে নিউহ্যাম্পশায়ারের হ্যাভারহীল এলাকার উডসভিল স্কুল বইটিকে নিষিদ্ধ করে স্কুল লাইব্রেরী থেকে সরিয়ে ফেলে । স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের বাইরেও বইটি পড়া বন্ধ করে দেয়া হয় । অভিযোগ এই - বইটিতে যৌন বিষয়ের অনুপূর্বক বর্ণনা রয়েছে আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির অবমাননা সহ শিক্ষকদের চরিত্র খর্ব করা হয়েছে ।


Cover of the 1898 edition

১৯৩১ সালে চীনের হুনান প্রদেশের গভর্নর ও বইটিকে হুনান প্রদেশে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন । তার অভিযোগ ভিন্ন । তার অভিযোগ, প্রানীদের ভাষা মানুষের মতো হতে পারেনা । আর প্রানীকে মানুষের সমপর্যায়ে তুলে আনাও ভয়ঙ্কর অনৈতিক । হুনানের সেন্সর জেনারেল হো-চিয়েন এর মন্তব্য , প্রানীদের মুখে মানুষের ভাষা বসিয়ে মানুষপ্রজাতিকে অসম্মান করা হয়েছে । তার ভয় , এধরনের কাহিনী কোমলমতি শিশুদের মানুষ আর প্রানীদেরকে সমপর্য্যায়ে দেখতে শেখাবে যা সর্বনাশী ।
এমোন ভয়ের কথা বলেছেন ইংল্যান্ডবাসীরা ও । কেউ কেউ বলছেন , বইটিতে " ড্রাগস" বা মাদকের কথা বলা হয়েছে । বইটির ৫ম পর্বে এ্যালিস একটি ক্যাটারপিলারের দেখা পায় । ক্যাটারপিলারটি একটি মাশরুমের উপর বসে ছিলো যা তখোনকার দিনে ড্রাগস এর সিম্বল হিসেবে ধরা হোত । এই ব্যাপারটি উঠে আসে তখোনই যখোন ১৯৬০ সালে সারা ইংল্যান্ডব্যাপী LSD মাদক ব্যবহারের অপসংস্কৃতি চালু হয় । ম্যাড হেটার এর মাথায় থাকা হ্যাটটিতেও এই LSD র সিম্বলিজম ছিলো । এ প্রসঙ্গে ডওসন এর বক্তব্য, ম্যাড হেটার বিক্রির উদ্দেশ্যেই মাথার হ্যাট নিয়ে ঘুরতো । তার মাথায় থাকা হ্যাটটিও বিক্রির জন্যেই । যার মূল্য ১০ শিলিং ৬ পেনি । যেহেতু ডওসন একজন ম্যাথেমেটিসিয়ান এবং এই গল্পে বেশ কিছু সিম্বলও দেখিয়েছেন তাই ইংল্যান্ডের সাইকিয়াট্রিষ্টদের সংশয়, গল্পকার এখানে প্রকারন্তরে শিশুদের ড্রাগসের প্রতি আকর্ষন করতেই চেয়েছেন। পাউন্ড, শিলিং , পেন্স বা পেনি কে বোঝাতে সেসময় ইংল্যান্ডে l/s/d এই অক্ষরগুলো ব্যবহার করা হতো , একথা আগেই বলেছি । শিলিং , পেন্স এর ছদ্মাবরনে ডওসন কি ওই l/s/d র কথাই বলতে চেয়েছেন ? সাইকিয়াট্রিষ্টরা কিন্তু সে সিম্বলিজমের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন ।
সাহিত্যের বোদ্ধারা যারা বইটি নিয়ে বিশ্লেষন করেছেন তাদের কাছে বইটি শিশুতোষ হলেও গল্পে সমকালীন রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে এতো জটিলতা, বিদ্রূপাত্মক ঘোরপ্যাঁচ আর কৌতুক যে তা শিশুদের পক্ষে বুঝে ওঠা বেশ কষ্টকর বলে মনে হয়েছে । এতে রাজনীতি আর ধর্মের প্রতি তাদের বিরূপ ধারনার জন্ম হতে পারে । তাই তারা বইটি নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন ।
সেন্সর কর্তৃপক্ষ অবশ্য তেমনটা মনে করেননি । তাদের বক্তব্য , একজন লেখক অবশ্যই রাজনীতি কিম্বা ধর্ম নিয়ে তার নিজস্ব ধারনা ব্যক্ত করতেই পারেন ।

আমেরিকান সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে মানুষের কথা বলার অধিকারকে ফান্ডামেন্টাল রা্‌ইটস হিসেবে চিন্হিত করা হয়েছে । আমেরিকান লাইব্রেরী এসোসিয়েশান এর সভাপতি ক্যারল ব্রে বলেছেন , সব বই ই যে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হবে এমোন নয় । কিন্তু আমরা যদি পড়ার জন্যে দশ দিগন্ত খুলে না দিই তবে কিছু শেখা, কিছু কল্পনা করা , কিছু সন্ধান করে দেখা কি করে হবে ?

আমরাও এতে প্রচন্ড রকমের বিশ্বাসী ।
কিন্তু কথা থাকে । ভালো কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে সমাজের বিশেষ করে শিশু কিশোরদের মানসিক শুদ্ধতা বজায় রাখার স্বার্থে বই নিষিদ্ধকরনের ব্যাপারটি কি ফ্রিডম অব স্পীচ এর খুব একটা ক্ষতি করবে ?

The Da Vinci Code
দ্য দা ভিঞ্চি কোড



নামটি দেখেই লাফ দিয়ে উঠবেন না এটা ভেবে যে , এত্তো এত্তো জনপ্রিয় বইটি কি করে নিষিদ্ধের তালিকায় নাম লিখিয়েছে ! আপনিই বলুন, কেন নাম লেখাবেনা ?
ক্রিশ্চিয়ানিটির উপরে বইয়ের লেখক ড্যান ব্রাউন এর বিশ্বাস না থাকতেই পারে কিন্তু তাই বলে তিনি ক্রিশ্চিয়ান ধর্মকে নোংরা আবর্জনায় মুড়িয়ে দেবেন তা তো হয়না ।

৮০ মিলিয়নেরও বেশী কপি ছাপা হয়ে গেছে বইটির ইতিমধ্যে । অনুদিত হয়েছে ৪৪ টি ভাষায় ।
কেন ?
নিষিদ্ধ জিনিষের প্রতি মানুষের আকর্ষনের সংস্কৃতি তো সেই হাওয়া বিবির জমানা থেকেই শুরু হয়েছে ! তাই অবাক হবার কিছু নেই এতে যে এতো পড়ুয়ারা কোত্থেকে এলো ।
বইটিকে নিষিদ্ধ করেছে লেবানন, জর্দান, ইরান, সিরিয়া, মিশর, সামোয়া, চীন, পাকিস্তান আর ভারতের কয়েকটি প্রদেশ ।
মূল অভিযোগ একটিই - যিশুখ্রীষ্টের জীবনী এখানে বিকৃত করা হয়েছে । ক্যাথলিক চার্চ যে ক্রাইষ্টের সত্যিকার কাহিনী লুকিয়ে রাখতে যড়যন্ত্র করছে তা ও তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে ।
ক্যাথলিক চার্চ অবশ্য বইটিকে নিষিদ্ধ করেনি । নিষিদ্ধ করেছেন অন্যেরা ।

প্যারিসের ল্যুভর মিয়্যুজিয়মে একটি হত্যাকান্ডের সুরাহা করতে গিয়ে আশ্চর্য্য সব ধাঁধার সামনে পড়তে হয় মূল চরিত্র সিম্বলজিষ্ট রবার্ট ল্যাংডনকে । একে তো ল্যুভর এর মতো মিয়্যুজিয়মের গ্রান্ড গ্যালারীতে পড়ে থাকা উলঙ্গ একটি লাশ , তার উপরে লাশের দেহটি ভিঞ্চির আঁকা "ভিট্রুভিয়ান ম্যান" এর মতো হবহু একই রকম ভঙ্গীতে পড়ে আছে । রহস্যময় ব্যাপার হলো, মৃতের রক্ত দিয়েই মৃতদেহটির বুকে একটি পেন্টাগ্রাম আঁকা হয়েছে আর দেহটির পাশে লেখা রয়েছে একটি ক্রিপ্টিক ম্যাসেজ । তাই ডাক পড়েছে ক্রিপ্টোলজিষ্ট সোফির । এই দুজন মিলে কেঁচো খুড়তে সাপই নয়, কেউটে বের করে ফেলেছেন । যেশাশ ক্রাইষ্ট মেরী ম্যাগদালেন নামের কোনও এক নারীর সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন আর এতে তাদের এক পূত্র সন্তান জন্মলাভ করেছিলো যার বংশধরেরা বেঁচে আছেন এখোনও; এই বম্বশেল কাহিনী নিয়ে "প্রায়োরী অব সিওন" আর "অপাস দি" নামের দুটি গুপ্ত সংগঠন যুদ্ধে মেতেছে । জড়িয়ে গেছে ক্যাথলিক চার্চও । কাহিনীর সবটাই খৃষ্টান ধর্ম সম্পর্কে একটি বিপরীত মতবাদ । বইটির মূল বক্তব্য , ফ্রান্সের মেরোভিনজিয়ান গোত্রের রাজাগন যেশাস ক্রাইষ্ট এবং মেরী ম্যাগদালেন এর বংশধর । এই বিকৃত ইতিহাসটি নেয়া হয়েছে ১৯৯৭ সালে ক্লাইভ প্রিন্স এর লেখা "দ্য টেম্পলার রিভিলেশান" এবং "দ্য হলি ব্লাড এ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল" বই দুটি থেকে । এ কারনে "দ্য দা ভিঞ্চি কোড" বইখানিকে আবার অনুকরনকৃত বইয়ের ছাপ মারা হয়েছে । কপিরাইট ইনফ্রিঞ্জমেন্ট এর দায়ে আদালতেও যেতে হয়েছে লেখককে ।

তাই বইটিকে ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করার অভিযোগ গায়ে মেখে নিষিদ্ধের তালিকায় নাম লেখাতে হয়েছে ।
সমালোচকদের অভিযোগ , ধর্ম অবমাননার পাশাপাশি বইটিতে ইওরোপের বহু শিল্পকর্ম আর ইওরোপের অতীত ইতিহাস সহ স্থাপত্যবিদ্যা আর ভুগোলকে বিকৃত করা হয়েছে নিজেদের মতবাদ প্রচারে । সমালোচিত হয়েছে সাইন্টিফিক ইনএ্যাকিউরেসীর জন্যে । ক্রিশ্চিয়ান সংগঠনগুলো রোমান ক্যাথলিক চার্চের উপর লেখকের এই বিষোদ্গারকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে । গল্প লিখতে গিয়ে ইতিহাস নিয়ে ড্যান ব্রাউনের এই গবেষনাকে ছাড় দেয়নি সমালোচকরা । নিউইয়র্ক টাইমস এর কলামিষ্ট লরা মিলার লিখেছেন - " বইটি লেখা হয়েছে একটি সম্পূর্ণ ধোঁকাবাজির উপর ভিত্তি করে । র্যাং কিয়ে এটি একটি ননসেন্স রচনা এবং বোগাস । তিনি ইতিহাসকে নিজের মতো করে বানিয়ে লিখে বিকৃত করেছেন ।"
মার্সিয়া ফোর্ড লিখেছেন - "ড্যান ব্রাউনের সাথে আপনি একমত হন বা না হন, এটা পরিষ্কার যে ; তিনি ও তার প্রকাশক পাঠকের দীর্ঘ লালিত বিশ্বাসকে লংঘিত করেছেন ।"
রিচার্ড এ্যাবেন্স লিখেছেন - " বইটির সবচেয়ে অসৎ দিকটি হলো, ড্যান ব্রাউন ক্রিশ্চিয়ান ধর্মবিশ্বাসের সাথে দ্বিমত পোষন করছেন তা ই শুধু নয় , তিনি ইতিহাসের ঘটনাবলীকে বিকৃত করে তাকেই ফ্যাক্টস বলে চালিয়ে দিয়ে ধর্মের গায়ে অবিশ্বাসের চাদর জড়িয়ে দিতে চেয়েছেন ।"

অনেকগুলো দেশে বইটি যেমোন নিষিদ্ধ করা হয়েছে তেমনি এর কাহিনী নিয়ে ২০০৬ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রটিকেও নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে । খোদ ভ্যাটিকান বইটিকে নিষিদ্ধ না করলেও চলচ্চিত্রটির প্রযোজক, পরিচালক আর বেশ কিছু অভিনেতাকে ভ্যাটিকান সিটিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন ।


A display featuring a vandalized poster of the film protesting the release of the film The Da Vinci Code outside a movie theater in Culver City, California.

আমার আপনার কিছু বলার আছে কি ?
আপনি ফ্রিডম অব স্পীচের সমর্থক হলেও আপনার এই সমর্থনের পরিধি কিম্বা এর যৌক্তিকতা, নৈতিকতা কতোখানি ফ্রি হওয়া উচিৎ ??

[ চলবে....]
ছবি ও সূত্র - ইন্টারনেট ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১২:১৯
৩৪টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×