চড়া দামে কেনা পৃথিবীর সব ছবিরা
--- মানি হ্যাজ নাথিং টু ডু উইথ আর্ট !
[ দ্বিতীয় পর্ব ]
......একটুকরো ক্যানভাসের জমিনে ফুটে ওঠা ছবি দেখে স্বপ্নের রাজ্যে চলে যাওয়া বা মুগ্ধতার ঘোরে হারিয়ে যাওয়া নয়, কেবল ভিরমি খেতে হলে আসুন - যে ছবিগুলোতে "মানি হ্যাজ নাথিং টু ডু..."এমোন একটা ব্যাপার জড়িয়ে আছে, তাদের একনজর দেখে আসি .....
প্রথম পর্বটাও দেখে আসুন এখানে ....... http://www.somewhereinblog.net/blog/GSA1953happy/2989492
ওম্যান থ্রি / উইলেম কুনিং
Woman III / Willem Kooning
বাচ্চাদের হাতে যদি রং পেন্সিল ধরিয়ে দিয়ে বলেন , একটা মানুষ আঁকো , তবে যা হবে এমোনটাই হলো উইলেম কুনিং এর সাড়া জাগানো ছবি "ওম্যান থ্রি"। ত্যাড়া ব্যাকা একটি মানুষ । বুকে মেয়েলী ভাব না থাকলে আর কিছু দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা ছবিটি মেয়ের না পুরুষের। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩, মাত্র দু'বছরে আঁকা ছয়টি ছবির সিরিজের একটি, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছে নারী । এর আগে ও নারী নিয়ে এঁকেছেন আরো সিরিজ ছবি ।
১৯৫৩ সালে আঁকা শেষ হলে ৬৮ ইঞ্চি বাই সাড়ে ৪৮ ইঞ্চি সাইজের ক্যানভাসে আঁকা এমোন ছবিটি ২০০৬ সালে বিক্রি হয়ে যায় পিলে চমকানো ১৫৮.৮ মিলিয়ন ডলারে ।
বলবেন, বিমূর্ত ! বটেই ! এ্যাবষ্ট্রাক্ট এক্সপ্রেসনিষ্ট পেইন্টার উইলেম কুনিং এর আঁকা যে ! ছবির বিষয়বস্তু ঠিক নয়, ছবিটির ওজন বাড়িয়েছে এর আঁকার ধরনটি আর ছবির পেছনের আর এক ছবির কথা । এ্যাকশান পেইন্টিং । ছবি সম্পর্কে কুনিং নিজেই বলেছেন, "প্রকৃতি বিশৃঙ্খল আর একজন শিল্পী নাকি তাকে শৃঙ্খলতা দান করেন, এমোন ধারনা খুবই হাস্যকর । আমরা যা আশা করতে পারি তা হলো, আমাদের নিজেদের মাঝেই খানিকটা শৃঙ্খলা নিয়ে আসা"।
কুনিং এর নিজের মধ্যে এই শৃঙ্খলা কতোটা তা খানিকটা খুঁজে দেখা যাক ।
১৯৪৮ সালেও "আর্টিষ্ট'স পিগমেন্ট" বা মোদ্দা কথায় রং কেনার ক্ষমতা ছিলো না তার । তাই এঁকেছেন সাদা কালোতে । তা ও আবার ঘরবাড়ীতে ব্যবহৃত এনামেল পেইন্ট দিয়ে । "লাইট ইন আগষ্ট" আর "ব্লাক ফ্রাইডে " নামের বিশাল বিমূর্ত ছবি দু'খানি খানিকটা সাদার ছোপ নিয়ে পুরোটাই কালোতে । আর "জ্যুরিখ"এবং "মেইল বক্স" হলো উল্টোটা, সাদায় । তার প্রথম প্রদর্শনীর পরে পরেই তার উত্তরন ঘটেছে যেন । জটিল হয়েছে আরো, এসেছে অন্য রংয়ের বাহার । সম্ভবত পয়সার মুখ দেখতে পেয়েছিলেন বলেই । তখোন থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছে তার "এ্যাবসট্রাকশানস " । যেমনটা ঘটেছে তার "এ্যাটিক (১৯৪৯)" আর "এক্সক্যাভেশান (১৯৫০)" ছবির বেলাতে । যেখানে ছবিতে মুক্ত কম্পোজিশানে অনুষঙ্গ জনিত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর ধরে তার চেষ্টাকৃত দৃঢ় প্রত্যয়টির সফলতা দেখতে পেয়েছেন ছবি বোদ্ধারা । একটি ফিগারকে কি করে ভীষন রকম দুমড়ে মুচড়ে দিতে হয় তুলির ক্ষীপ্র টানে তা হয়তো কুনিং এর চেয়ে ভালো আর কেউ জানেন না । এটা তার তুলনাহীন সহজাত কৌশল যা একই সাথে বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তোলে আবার মিশিয়ে দেয় বিমূর্ততার ভেতরে ।
ছবির ফিগারকে যদি ভেঙ্গে চুরে, দুমড়ে মুচড়ে তোলা হয় তবে বুঝতে হয় ফিগারটির বাস্তব আকৃতিটি শিল্পীর কাম্য নয় , পূর্ণতার বা বাস্তবের উপস্থিতির প্রয়োজন ফুরিয়েছে তার কাছে হয়তো বা ! ইউজলেস মনে হয়েছে ।
ক্যানভাসে এই ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি কি শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনের কোন গভীর হতাশা বা কষ্ট থেকে উঠে আসা কিছু ? কোনও আক্রোশ ? ব্যক্তি জীবনের অপূর্ণতা থেকে উৎসারিত কোনও ক্ষোভের প্রকাশ ? জীবনের ভেতরে গুমড়ে গুমড়ে ওঠা কিছু অতৃপ্তি, যাকে ফ্রয়েড হলে বলা যেতো - ”প্রাইমাল ইভেন্ট” যা শিল্পীকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে ? তাই কি অবচেতনে জমে থাকা কষ্ট কে অসংখ্যবার ক্যানভাসে তুলে এনেছেন ক্ষীপ্র তুলির টানে , নিজের অজান্তেই ?
হয়তো !
শিল্প বোদ্ধারা ভাবছেন তাই ই । নারীকে নিয়ে এতো সিরিজ কেন ? নারীকে কি চোখে দেখছেন, কিভাবে জেনেছেন কুনিং ; তার একটা ধারনা পেতে চেয়েছেন তারা । জীবনে প্রথম যে নারীটির সংস্পর্শে আসে মানুষ, সে নারীটি আর কেউ নয় - তার মা । এই মা'কে ঘিরেই চিত্রিত হতে থাকে তার জীবন, নারী সম্পর্কে তার ধারনা । শিল্পীর বেলাতে এ চিত্র অন্যরকম, মধুময় নয় । তার পাঁচ বছর বয়সকালেই মা–বাবার বিচ্ছেদ দেখতে হয়েছে তাকে । ছিলেন বাবার সাথেই । ছিনিয়ে এনেছেন মা তাকে নিজের কাছে আইনি লড়াইয়ে জিতে । লড়াকু সে মায়ের কঠিন শাসনের নিগড়ে পিষ্ট হয়েছেন তিনি । উদ্ধত, আত্ম নিমগ্ন আর অক্লান্ত ভাবে তাকে কব্জা করার ধাতে গড়া মা'কেই দেখেছেন তিনি শুধু । এমোন পরিবেশে একটি শিশুর ভেতরে আতঙ্ক বাসা বাঁধতেই পারে । মায়ের প্রতি বিরক্তি এমোনকি ঘৃনার জন্মও হতে পারে । উগ্র মেজাজী মায়ের ভালোবাসা না পেয়ে পেয়ে , ভালোবাসার প্রতি তার সহজাত আকাঙ্খাটুকু মরে যেতে পারে । তবুও তার মা-ই তো ! ঘৃনাটি তাই মনের গহীনে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছেন দিনের পর দিন । পরিনত বয়সে নারীর প্রতি এই বিতৃষ্ণা বোধের জন্ম, নারীর ভালোবাসা এমোনকি নারীর প্রতি তার যৌন আকর্ষনকে গলা টিপে মেরেছে । মনের ভেতরের এই ঘৃনা, এই কান্না-ই হয়তো তিনি ঢেলে দিতে চেয়েছেন ক্যানভাসে ।
ছবি - ওম্যান ওয়ান । ঘৃনা, বিতৃষ্ণা আর কান্না থেকেই কি এই খন্ড-বিখন্ডতা !!!!
নিজের জীবনের এই যন্ত্রনাতেই শিল্পী ছবিতে নারীকে খন্ড-বিখন্ড করেছেন । নারীকে শুদ্ধতা থেকে টেনে নামিয়েছেন কাঁদা মাটিতে । বানিয়েছেন ভঙ্গুর । ছবিতে তার রং চড়ানোর ধরন তাই শুদ্ধতা থেকে অসুন্দরের দিকে ধাবিত হয়েছে বারবার । খাপছাড়া ভাবে রং চড়িয়েছেন খন্ডিত ভাবে, ছেড়া ছেড়া । তার পর আবার তাদের মিশিয়ে দিতে চেয়েছেন । তার ছবির দর্শকরা এমোনটাই ধারনা পাবেন তার রং চড়ানোর ধরনে । ছবিতে তিনি বিভিন্ন ঘনত্বের রং ব্যবহার করেছেন । ব্রাস, প্যালেট নাইফস আর স্ক্রাপার এর সাহায্যে এমোনভাবে রং চড়িয়েছেন যা ছবির বিষয় বস্তুকে প্রায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছে । ছবিতে পরিকল্পিতভাবে আঁকা নারীটির স্তন, কাধ , হাতগুলিতে অস্বচ্ছ অফ-হোয়াইট রং বিন্যাস করেছেন স্তরে স্তরে । অপরদিকে কালো এ্যালকাইড রং তরল করে এমোন ভাবে স্তন, শরীরের উর্দ্ধাংশের আউটলাইন এঁকেছেন তাকে মনে হবে যেন জলরংয়ে আঁকা । যে রং কে আবার গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে নেমে যেতে দিয়েছেন যাতে নীচের দিকের রংটি হয়ে উঠেছে কালো দানাদার । রং শুকিয়ে যাবার আগেই শুকনো ব্রাস অথবা ছুরি দিয়ে তা স্ক্রাপ করেছেন এবং তা টেনে টেনে নিয়ে গেছেন প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নীচের সাদা রংয়ের উপরে, যতোক্ষন পর্য্যন্ত না দু'টো রং মিলে একটি ঘসটানো পুরু আবরনের মতো মনে না হয়েছে ।
খুব দ্রুততা আর ক্ষিপ্রতার সাথে আঁকা মনে হলেও আসলে ছবিটি কিন্তু আঁকা হয়েছে বেশ সময় নিয়ে নিয়ন্ত্রিত ভাবে হিসেব করে করে । স্টেরিও মাইক্রোস্কোপের বিশ্লেষণে এমোনটার প্রমানই মিলেছে ।
এ হলো "ওম্যান থ্রি"র গল্প । শিল্পী উইলেম কনিং এর ভেতরের ক্ষুব্ধ মানুষটি শৃঙ্খলিত হয়নি । সময়ের সাথে সাথে তা বেড়িয়ে আসতে চেয়েছে বারবার । খাপছাড়া ভাবে রং চড়ানো আবার তাদের মিশিয়ে দিতে চাওয়া কি তার নিজের ভেতরের বিক্ষুব্ধ মানুষটিকে শান্ত করার প্রয়াস ?
শিল্পী উইলেম কনিং-ই ভালো বলতে পারতেন !
ছবির ভেতরের এই ছবিখানিই কি এর গগণচুম্বি প্রাইজ ট্যাগের কারন ? হয়তো নয় ।
কারন ২০০৬ সালের নভেম্বরে ছবিটি কিনেছেন স্টীভেন এ কোহেন । ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০০৫ সালে যাকে ঘোষনা করেছেন "টপ বিলিয়নিয়ার আর্ট কালেক্টর" । ফোর্বস এর তালিকাতে তিনি আমেরিকার ৩৫তম ধনী । SAC Capital Advisors এর প্রতিষ্ঠাতা, ইক্যুইটি মার্কেট ষ্ট্রাটেজী নিয়ে যার কাজ-কারবার । । তা হলে বোঝাই যায় - আর্ট ইজ নো ফ্যাক্টর । মানি টক্স....
২০০০ সালে কোহেন এর ছবি কেনার খেয়াল মাথা চাড়া দেয় । এ পর্য্যন্ত ছবি কিনেছেন মাত্র ৭০০ মিলিয়ন ডলারের । পাঁচ বছরে আয়ের ২০% ছবি কেনার পেছনে খরচ করে ছবির সবচেয়ে বড় ক্রেতাদের তালিকার “শীর্ষ দশ”এ জায়গা করে নিয়েছেন । সুতরাং "মানি হ্যাজ নাথিং টু ডু..." ।
ছবিটির পেছনে আর একটি কাহিনীও এর চড়া মূল্য নির্দ্ধারনে ভূমিকা রেখে থাকবে হয়তো । ১৯৭০ সালের শেষ থেকে ১৯৯৪ পর্য্যন্ত ছবিটি ছিলো "তেহরান মিয়্যুজিয়ম অব কন্টেম্পোরারী আর্টস" কালেকশানের এর অংশ হিসেবে । ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের পরে ছবিটি প্রদর্শন করা সম্ভব হয়নি ছবি সংক্রান্ত সরকারী ফতোয়ার কারনে । শেষ পর্য্যন্ত ১৯৯৪ সালে গোপনে ছবিটি চলে আসে ডেভিড গীফেন এর কাছে । মূল্য ? মূল্য নয় বিনিময় । ১৬ শতকের তাহমাসবী "শাহনামা"র পারসিয়ান পান্ডুলিপির বাকী অংশের বিনিময়ে থমাস আম্মান ফাইন আর্ট এর মধ্যস্ততায় ডেভিড গীফেন ছবিটি হস্তগত করেন । গীফেন এর কাছ থেকেই ছবিটি কিনে নেন স্টীভেন এ কোহেন ১৫৮.৮ মিলিয়ন ডলারে ।
১৫৮.৮ মিলিয়ন ডলার কি ছবিটির ঐতিহাসিক মূল্য না কি শিল্পীর অব্যক্ত কান্নার দাম ???????
লী রীভ ( দ্য ড্রীম) / পাবলো পিকাসো
Le Rêve (The Dream) / Pablo Picasso
এক বিকেলের মধ্যে আঁকা সাদামাটা একটি ছবি, যে ছবি আপনিও আঁকতে পারেন লহমায়; তার দাম কতো হতে পারে ? ১৫৫ মিলিয়ন ডলার ?
হ্যা তা-ই । ১৫ কোটি ডলার । অর্থাৎ প্রায় ১২০০ কোটি টাকা । যা দিয়ে ব্যাংকের কাছে হাত পেতে শূণ্য হাতে ফিরে আসা বাংলাদেশের প্রায় আড়াই হাযার তরুন উদ্দ্যোক্তাদের স্বপ্নকে সার্থক করা যেতে পারতো অনায়াসেই ।
কি আছে এই ছবিতে ?
আছে একটি স্বপ্ন । ১৩০ বাই ৯৭ সেন্টিমিটারের ক্যানভাসের বুকে , তেল রংয়ে । দ্য ড্রীম । ফ্রেঞ্চ ভাষায় "লী রীভ" বাট নট "লা রীভ" । যে স্বপ্নের ভেতর লুকিয়ে আছে উত্তেজক কিছুর চিন্তায় কারো মুখের স্মিত একটুকরো হাসি । কে সে ? ভুবনখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসোর রক্ষিতা, কুমারী মেরী থেরেজা ওয়াল্টার । ১৯৩২ সালের জানুয়ারীর ২৪ তারিখের বিকেলে পিকাসোর তুলিতে ফুটে উঠেছে সে । পঞ্চাশ বছরের শিল্পী আর তার বাইশ বছর বয়সের তন্বী প্রেমিকার কাঙ্খিত দিন যাপনের স্বপ্ন কি ?
শিল্পী তার প্রেমাষ্পদকে বসিয়ে রেখেছেন চেয়ারে , ঘুমন্ত । ঘাড়টি হেলে আছে একদিকে । একটি স্তন আধা উন্মুক্ত । রক্তিম অধরে ঝুলে আছে যেন স্মিত একটুকরো হাসি । ছবির মুখটি মাঝখান থেকে বিভক্ত । এর বাইরে আপনার চোখের দৃষ্টি আর বেশীদুর এগুবেনা । কিন্তু ছবি বোদ্ধাদের চোখকে ফাঁকি দেয়া অতো সহজ নয় । তারা এর ভেতরে পেয়েছেন আদি রসের খোঁজ । ভালো করে খেয়াল করলে আপনিও তার হদিশ পেতে পারেন । মাঝখান থেকে বিভক্ত করা মুখের উপরের আধখানা যেন একটি পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ , দ্য ফ্যালাস । বোজা চোখের আকৃতি দিয়ে বোঝানো হয়েছে তা । ফাজিল আর্ট ক্রিটিকরা বারবার এদিকেই দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছেন দর্শকদের । বলেছেন , এই উত্থিত শিশ্ন পিকাসোর নিজের শিশ্নেরই প্রতিরূপ । তাই কি ছবির মেয়েটি তার টেরিফিক বুড়ো প্রেমিকের স্বপ্নবিলাসে ঘুম কাতুরে ? দৃশ্যকল্পনায় উত্থিত শিশ্নের কথা ভেবে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে ঠোটে ? তৃপ্তির একটি রোমান্টিক স্বপ্নই বটে !
সমস্ত দৃশ্যকল্পটি আঁকা হয়েছে এক বিকেলে , অতি সাধারন আঁচড়ে আর ব্রাসের রংয়ে । এভাবে আরো অনেক ছবির মডেল হিসেবেই তার শরীরকে ব্যবহার করেছেন তিনি । প্রেমিকার প্রতি পিকাসোর দৃষ্টিভঙ্গীই যেন ফুটে উঠেছে এসব ছবিতে । যেন মেরী থেরেজাকে শিল্পী দেখেছেন একটি যৌনবস্তু হিসেবে । জীবন সঙ্গিনী হিসেবে নয়, স্ত্রী হিসেবে নয় এমোনকি বন্ধু হিসেবেও নয় ; দেখেছেন খেলার পুতুল হিসেবে । যৌন উত্তেজনার হাতিয়ার হিসেবে ।
নইলে মেরী থেরেজার জীবন এমোন দুঃখময় হবে কেন ?
প্যারিসের লাফায়েত্তি গ্যালারীতে ১৯২৭ সালে ৪৫ বছরের পিকাসোর সাথে দেখা ১৮ বছরের ব্লন্ড তরুনী মেরী থেরেজা ওয়াল্টারের ।
ছবি : বাস্তবের মেরী থেরেজা ওয়াল্টার ।
তারপর চুটিয়ে প্রেম প্রেম খেলা । স্ত্রীর মর্যাদা মেলেনি কখোনও । পিকাসোর স্ত্রী ওলগা খোকলোভার কাছে ব্যাপারটি অজানাই ছিলো ততোদিনই যতোদিনে মেরী থেরেজা একটি কণ্যা সন্তানের জন্ম না দেন । ১৯৩৫ সালে খবরটি কানে যেতেই ওলগা পিকসোর জীবন থেকে সরে যান । অথচ পিকাসো স্ত্রীকে ডিভোর্স দেননি । অনুরক্তি কিমবা ভালোবাসার টানে নয়, ফ্রান্সের বিয়ে বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে, সেই ভয়ে । ১৯৫৫ সালে মরে গিয়ে সে ভয় থেকে পিকাসোকে চিরতরে মুক্তি দিয়ে যান ওলগা । অভিমান নিয়ে স্ত্রী হারিয়ে গেলেও ধন-সম্পত্তির কানাকড়ি ও হারাতে হয়নি পিকাসোকে । ওলগা মরে গেছেন, বেঁচে গেছেন পিকাসো । সেলুকাস.... কি বিচিত্র !!!!
ছবি : অষ্টাদশী থেরেজা, পিকাসো যাকে নিয়ে শুধু খেলেই গেছেন .......
যদিও ওলগা যতোদিন বেঁচে ছিলেন, তার খোরপোষ চালিয়ে গেছেন পিকাসো । দেখভাল করেছেন কন্যা মায়া সহ মেরী থেরেজাকেও । ততোদিনে রস টসকেছে মেরী থেরেজার । বাচ্চা হবার পরে পরেই তার উত্তাল দেহে ভাটার টান ধরেছে । পিকাসোর মন উঠে গেছে তাতেই । মজেছেন অন্য নারীতে – ডোরা মার । নতুন বিয়েও করেছেন আবার । পিকাসোর জীবনে মেরী থেরেজা তাই পড়ে থেকেছেন মলিন বস্ত্রখন্ডের মতো । আর এই দুঃখ নিয়েই পিকাসোর মৃত্যুর পরে নিজেও আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়িয়েছেন জীবনের । কিন্তু আজো মেরী থেরেজা ওয়াল্টার অমর হয়ে আছেন এই ছবিতে ....... এটুকু ছবির পেছনের একটুকরো ভালোবাসার গল্প ।
আরো খানিকটা গল্প আছে এতে । ভালোবাসার নয় , আর্ট সম্পর্কিত গল্প ।
টেক্কা দেয়ার গল্প । ১৯৩১ সালে প্যারিসে পিকাসোর প্রতিদ্বন্ধী নীল রংয়ের যাদুকর শিল্পী হেনরী মাতিস এর ছবির প্রদর্শনী চলছিলো । ঈর্ষা চরমে উঠলো পিকাসোর । একটা ছবির প্রদর্শনী তাকেও করতে হবে এবং তা বছর না ঘুরতেই । যা তাকে অতীতে বেঁধে রাখবেনা , নিয়ে যাবে শীর্ষে । তাকে করে তুলবে ফার্টাইল আর ভাইটাল, বেটার দ্যান এভার । কাজে লেগে পড়লেন পিকাসো । কয়েক মাসেই তার এ্যাকোয়াভেলা শো'য়ের জন্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যার ছবি আঁকা হয়ে গেলো । খানকয়েক আবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই । দর্শকদের টানতে বেছে নিলেন হালল্কা পর্ণো ধরনের সেক্সি আর সেন্টিমেন্টাল ছবি । রংয়ে যা ধাঁধিয়ে দেবে চোখ । কুমারী থেরেজার ব্লন্ড চুল, উত্তেজক শরীর আর বাকানো নাক এসবের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে বাজীমাৎ করতে চেয়েছেন পিকাসো ।
"Nude on a Black Armchair "(1932) - Marie-Thérèse
বাজীমাৎ হয়ে গেছে । এ্যাড্রেনালিনের মাত্রা তুঙ্গে উঠেছে দর্শকদের । তার প্রদর্শনী হিট ।
এ দু'টো গল্প হয়তো স্বপ্ন নামের ছবিটির মূল্য আকাশমুখি করতে খানিকটা উপরে ঠেলে দিয়েছে, বাকীটুকু করে দিয়েছে একটি কনুইয়ের গুতো । অবাক হবেন না । যার-তার কনুই নয় । লাস-ভেগাসের ক্যাসিনো ম্যাগনেট স্টীভ ওয়েইন এর কনুই । আনুমানিক ৬০ মিলিয়ন ডলারে কেনা ছবিটি ২০০৬ সালে ১৩৯ মিলিয়ন ডলারে বিক্রীর বন্দোবস্ত পাক্কা করে ফেলেছেন ছবির মালিক স্টীভ ওয়েইন । খুশিতে বাগবাগ স্টীভ বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত দিয়ে ছবিটি দেখাচ্ছিলেন উত্তেজিত হয়ে । কথা বলতে বলতে অসাবধানতা বশতঃ বাম কনুইয়ের ভর রাখলেন ছবিটির উপর । ব্যস.... হয়ে গেলো । পিকাসোর সাধের মেরী থেরেজার বাম বাহু নিয়ে ছয় ইঞ্চি পরিমান ডেবে গেলো ক্যানভাসটি । উপস্থিত বান্ধবী স্ক্রীন রাইটার নোরা এফরন দোষ দিলেন , রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসাতে ভোগা স্টীভের পেরিফেরাল ভিসন নষ্ট হয়ে যাওয়ার । নেহাৎ দূর্ঘটনা । কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে । আর স্টীভের ভাষ্য, "আমি যাতে ছবিটি বিক্রী না করি এটা তার একটি লক্ষন ।" কুসংস্কার এখানেও !!!!
এরপরে জলজ্যান্ত একটি ক্ষত সহ ছবিটি কিনতে নতুন ক্রেতা যদি অস্বীকৃতি জানান তবে তাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায়না । আপনি হলে কি, এমোন একটি ক্ষত-বিক্ষত ছবি ১৩৯ মিলিয়ন ডলারে কিনতেন ? না । হলো ও তাই । ক্রেতা বেঁকে বসলেন । কি করা ! ছবি মেরামত করতে হবে । ছবি কনজারভেটরদের ডাকা হলো । খুব দক্ষতার সাথে সুক্ষভাবে মেরামত করতে গিয়ে স্টীভের পকেট থেকে বেড়িয়ে গেলো নগদ নব্বই হাযার ডলার । নিখুঁত ভাবে সারিয়ে তোলা ছবিটির মূল্য পুনঃনির্দ্ধারিত হলো মাত্র ৮৫ মিলিয়ন ডলারে । স্টীভ ছবিটির বীমাকারী প্রতিষ্ঠান লয়ে ড'স এর কাছে এই কমতি ৫৪ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপুরন চেয়ে বসলেন । ৫৪ মিলিয়ন ডলার একটি কনুইয়ের গুতোর মূল্য ? অবাক হবার কিছুই নেই । আদালত পর্য্যন্ত গড়ালো ব্যাপারটি । ফয়সালা হলো আদালতের বাইরে । ততোদিনে সময় গড়িয়ে গেছে । স্টীভ ওয়েইন এর আর্ট ডিলারের গ্যালারীতে ছবিটিকে আরো কয়েকটি মিয়্যুজিয়ম থেকে ধার করে আনা মেরী থেরেজার সেক্সি ছবির পাশে ঠাই করে দেয়া হয়েছে । সিকিউরিটি গার্ডের বহর আর ষ্ট্রীট ব্যানারের কল্যানে প্রচার হয়ে গেলো , গ্যালারীর কোনও ছবিই বিক্রয়ের জন্যে নয় । এটাও কি নেগেটিভ একটি প্ররোচনা, যাতে ছবি কেনার জন্যে জিদ চেপে যায় তেমন কারো কারো আর দাম চড়চড় করে বাড়তে থাকে ? হতে পারে তা-ই ! এভাবে প্রচারের সুবাদে ছবির ক্ষত দেখতে আসা লম্বা লাইনে দাঁড়ানো দর্শকরা খুব কাছে থেকে দেখেও ধরতে পারলেন না ক্ষতটা কোনখানে । এইসব ঘটনা, রটনা নিয়ে ছবিটি তখোন চড়চড় করে ৮৫ থেকে ১৫৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যে পৌঁছে গেছে ।
কে কিনেছেন ? আর কেউ নয়, ছবিটির আগেরই বিমুখ ক্রেতা স্টীভেন এ কোহেন । আগেরবারের রফা হওয়া দামের চেয়ে ১৬ মিলিয়ন ডলার বেশী দিয়েই কিনতে হলো তাকে । ইগো বলে কথা !
নামটি চেনা লাগছে ? হুমমমম .... উইলেম কুনিং এর ছবি, ওম্যান থ্রি ( উপরে ) কিনেছেন যিনি । যারা নিজের দখলে সেরা জিনিষটিই চান, তাদের একজন । সেরা জিনিষটিই চান তারা, সেটা হোকনা কেন তাদের নারী - বাড়ী - গাড়ী । আর্ট এ্যাডভাইজার তানিয়া পস এর সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হয় - ইটস্ জাস্ট দ্য ওয়ে দে লিভ দেয়ার লাইভস । অথচ এই ছবিটিই ১৯৪১ সালে সর্বপ্রথম বিক্রি হয়েছিলো নিউইয়র্কবাসী ভিক্টর আর তার স্ত্রী শ্যালী গ্যানজ এর কাছে মাত্র সাত হাযার ডলারে । ১৯৯৭ সালের ভেতর এরা দু' জনেই মারা গেলে তাদের "ইনহ্যারিট্যান্স ট্যাক্স" এর বিল মেটাতে তাদের পরিবারটিকে আরো ছবি সহ "লী রীভ"কে তুলতে হয় ক্রিষ্টি'জ নিলামঘরে । "লী রীভ"বিক্রি হয়ে যায় ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ম্যানেজার , অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভুত উলফগ্যাঙ ফ্লটেল এর কাছে অস্বাভাবিক চড়া দামে , ৪৮.৪ মিলিয়ন ডলারে । ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল অর্থাৎ ছাপ্পান্ন বছরের মধ্যেই ৭ হাযার ডলারের ছবিটি হয়ে ওঠে ৪৮ মিলিয়ন ডলারের একটি ছবি । বাঙলাদেশের জমির দামের মতো , দু'বছর না ঘুরতেই দশগুন !
২০০১ সালে অর্থনৈতিক চাপের মুখে উলফগ্যাঙ ছবিটি ৬০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন । ক্রেতা ? যাকে কনুইয়ের একটি খোঁচার খেসারত গুনতে হয়েছে নব্বই হাযার ডলার , সেই ক্যাসিনো ম্যাগনেট স্টীভ ওয়েইন । যিনি কুসংস্কারের বশে পরবর্তীতে ছবিটি বিক্রি করে দিতে প্রথমে নারাজ ছিলেন । তার স্ত্রী তার চেয়েও এক কাঠি সরেস । ছবি বিক্রি হবেনা । বাঁধা পড়েছে । কিন্তু টাকা নাকি কথা বলে ! ক্রেতার জেদ আর টাকার জোর জিতে যায় যুদ্ধে । ২০০৬ সালের ২৬ মার্চ আবার ছবিটির নতুন মালিক বনে যান স্টীভেন এ কোহেন । ১৬ মিলিয়ন ডলার বাড়তি গচ্ছা দিয়ে হলেও নিজের পছন্দকে ছিনিয়ে নিতে দেননি আর কাউকে ।
তাই "মানি হ্যাজ নাথিং টু ডু উইথ আর্ট " কথাটি একেবারে নর্দমায় ফেলে দিতে পারবেন কি ?
[লেখাটি তিনটি পর্বের দ্বিতীয় পর্ব । প্রতিটি পর্বই স্বয়ং সম্পূর্ণ । অনুগ্রহ পূর্বক বাকী পর্বটির অপেক্ষায় থাকুন । ]
ছবি ও তথ্য ইন্টারনেট থেকে ।