সময়টা ২০১৪ সালের মার্চের শেষ দিক।
সকাল আনুমানিক ১১টা।
আজ একটা কঠিন দিন।
আজকে আমার ইন্সপেকশন, লুব ওয়েল সাম্প ট্যাংক।
জাহাজের ইন্জিন ফাউন্ডেশনের নিচে থাকা একটি ছোট ট্যাংক। আমার জাহাজে এই ট্যাংক টি লম্বায় ৩০ ফুট, প্রস্থে ৬ ফুট আর উচ্চতা মাত্র দেড় ফুট মানে মাত্র ১ হাত। প্রতি ২ফুট দুরে দুরে আড়াআড়ি ফ্রেম এবং মাঝে একটি পার্টিশন আছে। ইন্সপেকশনের জন্য প্রতি ফ্রেমে ২ফুট পাশ্বে আর দেড় ফুট উচ্চতার পথে আমাকে ৩০ ফুট ক্রলিং (শুয়ে কনুই দিয়ে চলতে হবে) করে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। স্পটে গিয়ে প্রথমে ভয় পেয়ে গেলাম, ফিরে আসতে পারবো তো ?
যাই হোক এটাই আমাদের প্রফেশন, মাল্টি গ্যাস মিটারটা চেক করে বুকে আটকিয়ে নিয়ে বুকে ফু দিয়ে ডুকে পড়লাম। আমার কাজ লাইট দিয়ে ওয়েল্ডিং ও স্ট্রাকচার ইন্সপেকশন সহ ভিতরের সঠিক অবস্থা জানা।
চলতে শুরু করার পর মনে হলো কবর বুঝি এমনই হবে? চলতে চলতে বার বার মনে হচ্চিল এখন কোন কিছু হয়ে গেলে আসলেই কি বের হতে পারব? কয়েক ফ্রেম যাওয়ার পর হঠাৎ মনে হলো আমি প্রচন্ড ঘামতে শুরু করেছি এবং আমার হাত পা আর চলছে না, আমার নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই চরম অবস্থায় আমার প্রথমেই মনে হলো আমার অনাগত সন্তানের কথা (যদিও ডাক্তারের কল্যানে জানতাম, ছেলে !!)। পৃথিবীর সকল বাবার ই কি প্রথম সন্তানের কথা মনে পড়ে ? মনের অজান্তেই বলে ফেল্লাম, আল্লাহ এক ছেলেকে তো তুমি দুনিয়াতে আসার আগের দিনই নিয়ে গেলে, আমাকে শুধু দেখালে তার নিথর দেহ খানি, আজ কি তাহলে এমন কিছু ঘটছে যে কিছু দিন পর আমার আরেক ছেলে জন্ম নিয়ে তার মৃত বাবার ছবিই দেখবে ? আমি মনে হয় অনেক পাপী, তাই আমার সাথেই এই চক্র শুরু হলো। কিন্তু আমার ছেলেরা তো নিস্পাপ, আমি মারা যাওয়ার আগে কি আমার ছেলের সাথে মুখোমুখি দেখা হবে না? আমাদের রক্ষা করুন আল্লাহ।
কতক্ষন ছিলাম জানি না, হঠাৎ ই মনে হলো আমার মাল্টি গ্যাস মিটার তো কোন এলার্ম দেয়নি এবং এখনো দিচ্ছে না, তার মানে অক্সিজেনের অভাবে নয়, আমি কাবু হয়েছি আসলে ভয়ে। তারপর আবার আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলাম এবং আল্লাহর ইচ্চায় একসময় কাজ শেষ করে বের হলাম।
আমার ছেলের জন্ম হয়েছে ২৮ এপ্রিল সকালে চট্রগ্রামে, আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ছেলেকে কোলে নেওয়ার মুহুর্তে বার বার আমার সেদিনের কথা মনে হচ্ছিল। তাই ছেলের নাম রেখেছি মাহরুস (অর্থ, আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন)।