যুদ্ধ কালীন সময় ব্যতিত বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহতম নৌ দুর্ঘটনা কোনটি? উত্তরটা কি টাইটানিক ? নারে ভাই, এটি এশিয়ায়, যেখানে টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল এটা ঘটেছে পৃথিবীর ঠিক অন্য প্রান্তের দেশ ফিলিপাইনে, টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ৭৫ বছর পর। ১৯৮৭ সালের ২০ ডিসেম্বর রাতে ৪০০০ এর অধিক যাত্রী নিয়ে ফিলিপাইনের মিন্ডোরোর উপকূলে ডুমিলা পয়েন্টে ডুবে যাওয়া যাত্রীবাহী জাহাজ এমভি ডোনেয়া পাজ। মাত্র ২৪ জন সৌভাগ্যবান জীবন্ত উদ্ধার পেয়েছেন।
ফিলিপাইন, 7000 এর বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপমালা, এমভি ডোনেয়া পাজের মত যাত্রীবাহী ফেরি ফিলিপাইনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় এবং এটি একদ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে চলাচলের সবচেয়ে জনপ্রিয়, সস্তা ও সহজ উপায়। আগেই বলেছি, ফিলিপাইন খ্রীষ্টান অধ্যুসিত দেশ। রাষ্ট্রীয় ধর্ম খ্রীষ্টান। প্রায় ১০ কোটি মানুষের ৯০% ই খ্রীষ্টান। তাই এখানে বড়দিন বা ক্রিসমাস সবচেয়ে বড় উৎসব। অনেক ইউরোপিয়ানের মতে, ফিলিপিনোরা ক্রিসমাসের ব্যাপারে অনেক ক্রেজি, কারন এখানে ক্রিসমাস এর সপিং, ডিসকাউন্ট, ডেকোরেশন সেপ্টেম্বর থেকেই শুরু হয়। আর ক্রিসমাস এ ফিলিপিনোরা যেমন পরিবারের সাথে ক্রিসমাস পালন করতে ম্যানিলা ছাড়ে আবার অনেকে সপরিবারে বেড়াতে যায়, আবার অনেকে এই কয়দিন বাড়তি আয়ের আশায় ম্যানিলা আসে । তাই ১৯৮৭ সালের ক্রিসমাস এর মাত্র ৫ দিন আগে ১৫১৮ জন সর্বোচ্চ যাত্রী ধারন ক্ষমতার জাহাজে যাত্রী বহন করছিল প্রায় ৪০০০ এর অধিক যাত্রী। তবে এই অতিরিক্ত যাত্রী ই কিন্তু দূর্ঘটনার প্রধান কারন নয়, এটি শুধু অতিরিক্ত প্রানহানীর কারন।
৯৩.১০ মিটার ( ৩০৫ ফুট) দৈর্ঘ্যের, ১৩.৬০ মিটার ( ৪৫ ফুট) প্রস্থের এবং ১৮ নট গতির প্রায় ২২০০ ডেড ওয়েট টনের এমভি ডোনেয়া পাজ ১৯৬৩ সালে নির্মিত হয়েছিল অনোমিছি (Onomichi) সীপইয়ার্ড, হিরোশিমা, জাপানে, তখন এর নামকরন করা হয়েছিল Himeyuri Maru এবং সর্বোচ্চ যাত্রী ধারন ক্ষমতা ছিল ৬০৮। ১৯৭৫ সালে এই দ্রুতগামী যাত্রীবাহী ফেরি একটি ফিলিপিনো অপারেটর সালপিসিও ( Sulpicio ) লাইনস এর কাছে বিক্রি হওয়ার আগ পর্যন্ত জাপানি আভ্যন্তরিন রুটে চলছে। সালপিসিও লাইনস জাহাজটির আভ্যন্তরিন নক্সা পরিবর্তন করে, সর্বোচ্চ যাত্রী ধারন ক্ষমতা ১৫১৮ তে উন্নীত করে ফিলিপিনো রেজিস্ট্রেশন নেয় এবং এরপর এমভি ডোনেয়া পাজ নামে রুট পারমিট পায় রাজধানী ম্যানিলা থেকে দক্ষিনে লেইটে ( Leyte ) দ্বীপের তাকলোবান শহর পর্যন্ত। প্রায় ২৪ ঘন্টার সমুদ্রযাত্রা, সপ্তাহে দুইদিন।
১৯৮৭ সালের ২০ ডিসেম্বর সকাল ০৬:৩০ টায় এমভি ডোনেয়া পাজ তাকলোবান শহর থেকে রাজধানী ম্যানিলার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে এবং ২১ ডিসেম্বর ভোর ০৪:০০ টায় ম্যানিলায় পৌছানোর কথা ছিল। ২০ ডিসেম্বর রাত ১০:৩০ টা। জাহাজের অবস্থান ম্যানিলা থেকে ১২০ কিমি দক্ষিনে ডুমালি পয়েন্টে, এখানে সাগরের গভীরতা প্রায় ৫৫০ মিটার (১৮০০ ফুট) এবং এই ডুমালি পয়েন্ট হাঙ্গর এর অভয়ারন্য হিসাবে পরিচিত। চাঁদহীন রাত পরিস্কার আকাশ, সাগরে মাঝারি ঢেউ। জাহাজটি তার প্রায় সর্বোচ্চ গতিতে চলছিল। অধিকাংশ যাত্রীই ঘুমিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত, কারন খুব ভোরে তাদের ম্যানিলায় পৌছানোর কথা। শুধু জাহাজের ক্রুরা কিছু গেস্ট নিয়ে পার্টিতে ব্যস্ত। কোন সতর্কবাণী ছাড়াই, হঠাৎ প্রচন্ড এক ধাক্কা এবং তৎপরবর্তী এক প্রচন্ড শব্দে জাহাজের সকল যাত্রী শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান। তারা ভাবতেই পারেন নি কি এক ভয়াবহ সময়ের দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন। এটি আসলে ছিল প্রায় ১০০০ টন পেট্রোলিয়াম ও কেরোসিনবাহী একটি অয়েল ট্যাংকার এম টি ভিক্টর এর সাথে এমভি ডোনেয়া পাজ এর আড়াআড়ি সংঘর্ষ। এর পরই এম টি ভিক্টর এর অগ্রভাগে এবং এমভি ডোনেয়া পাজ এর ইন্জিন রুমে প্রচন্ড বিস্ফোরন হয় এবং দুটি জাহাজে আগুন ধরে যায়। দুটি জাহাজের ই হাল বা বডি ফেটে যায় এবং ট্যাংকার থেকে তেল সাগরে পড়তে থাকে। জাহাজের সেই আগুন ক্রমে সাগরের পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সমগ্র এলাকা তখন এক ভয়াবহ অগ্নিকুন্ডে পরিনত হয়। হাজার হাজার মানুষকে এক জলন্ত চিতায় পুড়ে মরতে হয়। শুধু যারা পানির আগুনে ঝাপ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মাত্র ২৪ জনকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এই সংঘর্ষের ২ ঘন্টার মধ্যে এমভি ডোনেয়া পাজ এবং ৪ ঘন্টার মধ্যে এম টি ভিক্টর ডুবে যায়। প্রথম উদ্বারকারী হিসাবে এগিয়ে আসে ঘটনাস্থলের পাশ দিয়ে যাওয়া আরেকটি যাত্রীবাহী ফেরি যারা কোন সংকেত পায়নি শুধু আগুনের শিখা দেখে এসেছে, তাও দূর্ঘটনার দেড় ঘন্টা পর, তারই ঐ ২৪ জনকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে। তারা আসার আগেই সব পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং কিছুক্ষন পরেই এমভি ডোনেয়া পাজ সাগরের অতলে হারিয়ে যায়। ফিলিপিনো কোস্টগার্ড ই ঘটনাটি জানতে পারে ঘটনার ৮ ঘন্টা পরে। এবং অফিসিয়াল উদ্ধার কাজ শুরু হয় আরো কয়েকঘন্টা পর যখন জীবিত কারো আর উদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল না।
এই ঘটনায় সার দেশে এক আলোড়ন তৈরী হয় এবং এটি এক বিক্ষোভে রুপ নেয় যখন এমভি ডোনেয়া পাজের মালিক ঘোষনা করে জাহাজে ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত কোন যাত্রী ছিল না। অফিসিয়াল টিকেট কাটা ছাড়া অন্য কোন যাত্রী জাহাজে উঠে থাকলে তার দায়িত্ব জাহাজ কর্তৃপক্ষ নিবে না।আসলে ফিলিপাইনে আন্ত- দ্বীপে জাহাজ নেভিগেশন কুখ্যাতিপূর্ণ। এখানে ৪ বছরের নিচের শিশুদের টিকেট ছাড়াই ভাড়া হাফ, সৌজন্য টিকেট এবং স্ট্যান্ডিং টিকেটের ও রেকর্ড থাকে না। তাই অফিসিয়াল লিস্ট হিসাবে হাজার হাজার যাত্রী বাদ পড়ে। উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের তথ্য অনুযায়ী জাহাজে ৪০০০ এর অধিক যাত্রী ছিল কারন তারা রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার আগে জাহাজের ডেকে, বারান্দায় এবং ছাদে অনেক যাত্রীকে ঘুমাতে দেখেছেন। সমুদ্র উপকুল থেকে যে লাশগুলো পাওয়া গিয়েছিল তার মধ্যে মাত্র ২১ জনকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়, তাদের মধ্যে মাত্র ১ জনের নাম ঐ অফিসিয়াল লিস্টে ছিল। আর জীবিত উদ্ধার হওয়া ২৪ জনের মধ্যে মাত্র ৫ জনের নাম ঐ অফিসিয়াল লিস্টে ছিল। ফলে এ সংক্রান্ত মামলাটি ক্রমেই জটিল হতে থাকে এবং জন অসোন্তোষ বাড়তে থাকে। এর পর ফিলিপাইনের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে লৌহ মানবী প্রেসিডেন্ট কোরাজন একুইনো এক ডিক্রী জারির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ টাস্কফোর্স গঠন করে এ ঘটনার বিস্তারিত তদন্তের নির্দেশ দেন।
এ তদন্তে উঠে আসে ফিলিপাইনের সমাজের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি। উঠে আসে ঘটনার অনেকটা গ্রহনযোগ্য কারন এবং হতাহতের সংখ্যা। ঐ রিপোর্ট টি আদালত গ্রহন করে এবং এর ভিত্ততে বিচার কাজ শুরু হয়। কি ছিল ঐ রিপোর্টে .......
জীবিত উদ্ধার ২৪ জন, এর মধ্যে এম টি ভিক্টর এর ২ জন ক্রু, এমভি ডোনেয়া পাজ এর ক্রু কেউ বেচে নেই । মোট হতাহত ৪৩৮৬ জন এর মধ্যে এমভি ডোনেয়া পাজ এর ক্রু ৫৯ জন, এম টি ভিক্টরের ক্রু ১১ জন বাকিরা যাত্রী। এ দূর্ঘটনার সময় এমভি ডোনেয়া পাজ এর মোট ক্রু সহ যাত্রী ৪৩৭৫ জন। যদিও তাকলোবান বন্দরের সরকারি রেজিস্টারে যাত্রী সংখ্যা ১৪৯৭ যা জাহাজ মালিক ঘোষনা করেছিল, কিন্তু কোন কর্মকর্তা তা চেক করেননি বা গুস গ্রহন করে মিথ্যা তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন।
এ দূর্ঘটনার সময় এমভি ডোনেয়া পাজ জাহাজের নামে কোন রেডিও লাইসেন্স ছিল না, যে লাইসেন্সের কপি জাহাজ মালিক বিভিন্ন সরকারি অফিসে জমা দেন, তা জাল ছিল। জাহাজের ইনস্পেক্টর এবং রেজিস্ট্রেশন অফিস তা চেক না করে নবায়ন করেন অথবা তারা দূর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। শুধু যে জাল তাই নয়, জাহাজ ছাড়ার সময় থেকেই জাহাজের রেডিও ভি এইচ এফ এর কোন রেকর্ড আশে পাশের কোন জাহাজ বা অফিসে নেই, তাই ঐ রিপোর্টে বলা হয়, জাহাজ ছাড়ার সময় থেকেই জাহাজের রেডিও ভি এইচ এফ নস্ট ছিল। আর এম টি ভিক্টরের রেডিও লাইসেন্সের মেয়াদ ১ বছর আগে শেষ হয়ে গেলেও নবায়ন হয় নি। তাই ধারনা করা হচ্ছে এ দূর্ঘটনার সময় দুই জাহাজের মধ্যে কোন কথা হয় নি। তা ছাড়া ও জাহাজ মালিক জাহাজের ৫৯ জন ক্রু দের যে তালিকা প্রকাশ করে, তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় শুধু জাহাজের ক্যপ্টেন ছাড়া আর কারো রেডিও অপারেটর হিসাবে লাইসেন্স ছিল না।
জাহাজের নিরাপত্তা সরন্জাম গুলো ছিল লকার বন্ধী। এবং চাবি ছিল ক্যপ্টেনের রুমে অন্য লকারে তাই ক্রু রা সেই চাবি খুজে পাননি। আর ক্যপ্টেন এবং ওয়াচ কিপার রা এক ক্যডেটের কাছে জাহাজের নেভিগেশন বুঝিয়ে দিয়ে ব্যস্ত ছিলেন পার্টিতে, উদ্ধার হওয়া অনেকের ভাষ্য মতে জীবনে শেষ বারের মত ক্যপ্টেন ছিলেন মাতাল অবস্থায়।
তবে রিপোর্টে দূর্ঘটনার সময়ের কোন বিবরন নেই, কারন যে ২ জন ক্রু বেচে গিয়েছেন তারা অফ ডিওটিতে ঘুমাচ্ছিলেন, পরে তারা সাগরে ঝাপ দেন এবং বেচে যান। তাই এতবড় একটি ট্রাজিঢির সঠিক কারন জানা যায় নি, যাবে ও না হয়ত কোন দিন।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল ২০০৯ সালের ২৫ আগস্ট এমভি ডোনেয়া পাজ ট্রাজিঢির উপর এশিয়ার টাইটানিক নামে একটি ডকুমেন্টরি প্রিমিয়ার করে। ভিডিও টি দেখুন, তবে যাদের হার্ট দূর্বল তারা না দেখাই ভালো।
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৪০