@ তাওহীদুল্ উলুহিয়্যাহ্ বা ইবাদাতে একত্ববাদ-এর প্রমাণাদি (২)
যদি আপনি একজন মুসলমান হিসেবে নিজেকে চিন্তা করে থাকেন, তবে সর্বপ্রথমই আপনাকে যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং আদি-অন্ত গুরুত্ব দিয়ে যেতে হবে; তা হচ্ছে তাওহীদ বা একত্ববাদ। কেননা, এ ক্ষেত্রে বিন্দুসম অস্বীকার বা অংশীবাদ মিশ্রিত করলে আপনার মুসলমানিত্ব আপনাকে ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে। অপরদিকে যদি একজন মানুষ হিসেবে চিন্তা করেন, তাহলে আপনাকে জীবনের কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হবে। আর সেসব উত্তরগুলোকে অবশ্যই সুস্থ্য বিবেক, সত্যনিষ্ঠ প্রমাণাদি, যুক্তি, সর্বোপরি আপনার অন্তরের অন্তস্থল থেকে সায় পেতে হবে। প্রশ্নগুলো এমন- আপনি কোথায় ছিলেন, কেন পৃথিবীতে, কোথায় এগিয়ে যাচ্ছেন এবং তথাকার অবস্থা কিরূপ হবে? এতে যদি আপনি কোনক্রমে একজন স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন, তাহলে অবশ্যই এ দিকটি আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে যে, স্রষ্টা কেন পাঠালেন পৃথিবীতে এবং মৃত্যুর মাধ্যমে তো নিশ্চিতই আমি আমার স্রষ্টার নিকট পৌঁছে যাবো, তখন কি হবে আমার প্রতিদান? এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর অনুধাবনের উপরই অনেকাংশে নির্ভর করছে আপনি আপনার স্রষ্টাকে এককরূপে বিশ্বাস করেন কিনা। কারণ, দু'জন স্রষ্টা হলে আপনাকে যে কোন একজনের পক্ষাবলম্বন করতে হচ্ছে, অথচ বিশ্বব্যবস্থা কিন্তু কোনভাবেই সেদিকে ইঙ্গিত করছে না; পরন্তু অসংখ্য সত্য প্রমাণ, সত্যানুভূতি তো রয়েছেই।
মোদ্দাকথা, তাওহীদ বা একত্ববাদে বিশ্বাস এমন এক চাবি যদ্দারা একদিকে যেমন আপনি আপনার সমস্ত জীবনের দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারেন, অন্যদিকে তাতে সহস্র রকমের বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে মুক্তির পথ রুদ্ধও করে দিতে পারেন। তিন প্রকার তাওহীদের মধ্যে আমরা আলোচনা করছিলাম তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ্ বা ইবাদাতে একত্ববাদের কুরআনিক প্রমাণাদি। এবার উপস্থাপন করছি হাদীসের প্রমাণ। মূলত এখানে আমরা দেখতে পাবো কি করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন যাতে করে তারা আল্লাহর বান্দাদের নিকট তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে যেতে পারে।
মু'আয ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
"হে মু'আয! তুমি কি জানো বান্দার উপর আল্লাহর কি হক বা অধিকার রয়েছে? মু'আয বললেন: আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল অধিক অবগত। তিনি বললেন: তারা তাঁর ইবাদাত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। তুমি কি জানো আল্লাহর উপর তাদের কি অধিকার রয়েছে? মু'আয বললেন: আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল অধিক অবগত। তিনি বললেন: আল্লাহ্ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না।"
[বুখারী: ৭৩৭৩]
আমরা নিজ নিজ অধিকার সম্পর্কে তো বিরাট সচেতন; এমনকি অন্যের অধিকার থেকে নিয়ে পশুপাখির অধিকার নিয়েও দারুন ব্যস্ত, অথচ যে সুমহান স্রষ্টা আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তৎপরবর্তীকাল থেকে প্রতিপালন করে যাচ্ছেন, তাঁর অধিকার নিয়ে ঔদাসীন্যতার অন্ত নাই। এর দ্বারা আমরা কোনভাবেই সুমহান প্রতিপালকের বিন্দুমাত্র ক্ষতিও করতে পারছি না কেবল নিজেদের ক্ষতি ছাড়া। অতএব, এ জগত সংসার যাঁর দয়ার দান; তাঁর অধিকার সম্পর্কে আমরা ক'বে সচেতন হবো?
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু 'আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু'আয রাদিয়াল্লাহু 'আনহুকে ইয়ামান পাঠানোর প্রাক্কালে বললেন:
"তুমি আহলে কিতাবের এক সম্প্রদায়ের নিকট গমন করছো। অতএব, তাদেরকে তুমি মহান আল্লাহর একত্ববাদ মেনে নেয়ার প্রতি সর্বপ্রথম আহ্বান করবে। এ বিষয়টি তারা জেনে নিলে তাদেরকে অবহিত করবে যে, আল্লাহ্ তাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন.................(শেষ পর্যন্ত)।" [বুখারী: ৭৩৭২]
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, অন্য কোন ইবাদাতের কিংবা সৎকর্মের দিকে আহ্বানের কথা কিন্তু বলা হয়নি; বরং একত্ববাদের কথাই সর্বপ্রথমে বলা হয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, বান্দা তার নিজের মধ্যে "ইবাদাত" প্রতিষ্ঠার পূর্বে "ইবাদাতে একত্ববাদ" বা "তাওহীদুল উলুহিয়্যা"র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, অন্যথা তার ইবাদাত বিনষ্ট হতে বাধ্য থাকবে এবং ফলাফলে যে ভয়াবহ পরিণাম তার জন্য অপেক্ষমান, সে দৃশ্যের জন্য নিচের হাদীসে দৃষ্টি দিন।
ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
"যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে সমকক্ষ স্থির করে আহ্বান করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।" [বুখারী: ৪৪৯৭]
অর্থাৎ, সারাজীবন শির্কে নিমজ্জিত থাকার পরও যদি মৃত্যুর পূর্বে তাওহীদকে নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে মরতে পারে, তাহলেই কেবল এ ভয়াবহ পরিণতি থেকে মুক্তি সম্ভব। কিন্তু মৃত্যু সম্পর্কেও আমাদের গাফলতীর অন্ত নেই, আমরা হিসেব কষতে থাকি বছরের, শতাব্দীর অথচ আমার জন্য মুহূর্ত বাকী আছে কিনা সে ব্যাপারেও আমার নিকট কোন তথ্য নেই!
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ্ রাদিয়াল্লাহু 'আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
"যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন কিছুর শরীক না করে তাঁর সাথে সাক্ষাত করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শির্ক করা অবস্থায় তাঁর সাক্ষাতে যাবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।" [মুসলিম: ৯৩]
পরিস্কার হলো যে, দু'টো বিপরীত প্রান্তিক বিষয় হলো শির্ক এবং তাওহীদ। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্ সোবহানাহু ওয়াতা'আলার সাথে শির্ক করা অবস্থায় যদি কেউ তাঁর সাথে সাক্ষাত করে অর্থাৎ মৃত্যুবরণ করে, তবে তার জন্য জাহান্নাম অপরিহার্য হয়ে যাবে। আর শির্কের বিপরীত নির্ভেজাল তাওহীদ বা একত্ববাদ নিয়ে কেউ আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে পারলে তার জন্য জান্নাত অনিবার্য; যা প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপরোক্ত হাদীসে সুস্পষ্ট।
২৩.০২.২০০৮