ভাবনা যুগিয়েছে যে লেখা -
মুহাম্মাদ বিন কাসেমের বিজয়ের সূচনার পথ ধরে এক সময় সমগ্র ভারতবর্ষ হয় মুসলমানদের দেশ (শাসন অর্থে)। পরন্তু ইসলামী আদর্শকে চিন্তার ভিত্তি দাঁড় করালে দেখা যায় যে, ইসলাম কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ড কিংবা কোন নির্দিষ্ট জাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমগ্র মানব জাতির জন্য। আর মানব জাতির আবাসস্থল হিসেবে সমগ্র পৃথিবীই প্রকৃত অর্থে ইসলামের তথা ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের। আদর্শের থিউরী আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য হলো, মুসলমানরা তাদের অযোগ্যতার ফলে আল্লাহর দেয়া দানকে অর্জন করতে এবং অর্জনের পর ধরে রাখার সক্ষমতায় দুর্বল হয়ে পড়েছে, নয়ত তৎকালীন অর্ধ পৃথিবী একজন শাসনকর্তা উমারের (রাঃ) অধীনেই ছিল।
সুতরাং ইকবাল কিংবা তার বন্ধু আবুল আ'লা মওদূদী অথবা অন্য কোন মুসলমান যদি 'সারা যাঁহা'কে 'হামারা' বলেন, তো মোটেই ভুল কিংবা অত্যুক্তি করেননি। মুসলিম ঐহিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখাও তাদের জন্য অলীক ছিল না।
আবার নিখিল ভারত যখন বিভক্ত হয়েই গেল, তখন বিভাজনে খণ্ডিত হলেও ইসলামের শত্রু হিন্দুপ্রধান ভারতের ষড়যন্ত্রে তৎকালীন পাকিস্তানকে টুকরো করার মাধ্যমে এ অঞ্চলের মুসলিম শক্তি নাস্তানাবুদ হোক; বাংলাদেশের ধর্মসচেতন মানুষেরাও এটা কিছুতেই বরদাশ্ত করতে পারেননি। তাই তাদেরই একটা অংশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয়া না দেয়াকে উহ্য রেখে চেয়েছিল এ অঞ্চলের মুসলিম শক্তি হিসেবে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান তথা একটি মুসলিম দেশ অটুট থাকুক।
কিন্তু হানাদার পাকিস্তানী স্বৈরশাসকের হিংস্রতা তা হতে দিল না। তাদের ক্ষমতার অন্ধত্ব আর দমনের নামে কৃত অত্যাচারই পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষকে বিপ্লবী করে তুলেছে; যার ফলাফল পাকিস্তানের ভাঙ্গন কিংবা বাংলাদেশ নামক নতুন মুসলিম রাষ্ট্রের পত্তন।
যারা ইসলামী চিন্তাচেতনা পোষণ করতেন, তারা "সারে যাঁহা হামারা" দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেছেন, আর এ কারণে দ্বীন ইসলাম এবং আলাদা স্বদেশ বিবেচনায় সর্বাত্মক আকাংখী ছিলেন যে, সমস্যাটা মিটে যাবে এবং মুসলিম শক্তি অটুট থাকবে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানী হন্তারক সরকার যে তাণ্ডব লীলা চালিয়েছিল, সেসব কর্মকাণ্ডে ইসলাম পন্থীরা পড়েছিলেন দারুন সিদ্ধান্তহীনতায়, পরিস্থিতিই তাদেরকে এই অবস্থায় পতিত করেছে। অন্যদিকে ইসলাম নিয়ে যাদের মাথা ব্যাথা ছিল না, তাদের সামনে লক্ষ্য একটাই; দেশ আক্রান্ত হয়েছে, দেশ বাঁচাও। লক্ষ্যণীয় যে, একপক্ষের চিন্তার পরিধি সমগ্র বিশ্ব ব্যাপী আর অন্যপক্ষের চিন্তার পরিধি শুধুমাত্র তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান কেন্দ্রিক; যা পরে আমাদের সোনার বাংলাদেশে রূপ নেয়। দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্যটুকু এবং এর ফলে সৃষ্ট সিদ্ধান্তহীনতার দায়ভার প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশকে আজো বহন করে যেতে হচ্ছে নিদারুন অশ্লীলতা আর অরজকতাসৃষ্টিকারী দাঙ্গা-ফ্যাসাদের মধ্য দিয়ে।
মূলতঃ প্রতিজন মানুষই তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেয়, তাই তার মতে যথার্থ। অতএব, সমগ্র বিশ্বের জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকে নির্দিষ্ট করে দৃষ্টিপাত করলে অটুট মুসলিম দেশের আকাংখীদের দৃষ্টিভঙ্গিও যথার্থ। কিন্তু অন্যদের দৃষ্টিতে এটা সিদ্ধান্তহীনতা, তবে এ সিদ্ধান্তহীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে বাস্তব পরিস্থিত। 'অখণ্ড ভারতে ইংরেজদের পর আবার মুসলমানগণ ফিরে আসবেন কর্তৃত্বে' –এ আশার অগ্রপথিক ইকবাল এবং মওদূদী পর্যন্ত মুসলিম লীগের আন্দোলনের কঠোর সমালোচনা করার পরও ঘটে যাওয়া বাস্তবতাকেই মেনে নিয়ে মুসলিম পাকিস্তানের অধিবাসী হলেন এবং নতুন দেশের জন্য অকুণ্ঠচিত্তে কাজ করে গেলেন মৃত্যু পর্যন্ত। ঠিক একই ধারাবাহিকতায় 'আমাদের স্বাধীনতা' কিংবা 'অখণ্ড মুসলিম পাকিস্তান' প্রশ্নে শত্রুর ষড়যন্ত্র এবং স্বৈরাচারীর ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট সিদ্ধান্তগুলোও বাস্তবতাকেই মেনে নিয়েছে এবং নতুন শপথে স্বদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে। তাদের বর্তমান দেশ গড়ার কাজই সেটার প্রমাণ বহন করে।
রবি ঠাকুর হিন্দু (যদিও তিনি ছিলেন হিন্দু ধর্মেরই একটা উপধর্ম ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত) ছিলেন, তাই (সাধারণভাবে) হিন্দুত্বের প্রতি (তথা হিন্দু প্রধান ভারতের প্রতি) তার আকর্ষণ, সমর্থন, পক্ষপাত থাকাটাই স্বাভাবিক। 'বাংলা'কে তারা মায়ের মর্যাদা দেয়, এ মর্যাদা ঠিক মূল হিন্দু ধর্মের অংশ নাকি রবি বাবুর বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ "মাকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে" ভাবের কাব্য-কথা থেকে সৃষ্ট; সে প্রশ্ন অবান্তর। মূল কথা হলো রবি বাবু যেহেতু বঙ্গভঙ্গের পর পশ্চিম বঙ্গের অধিবাসী হলেন, তথা ভারতের অধিবাসী হলেন, সেহেতু তার পক্ষে কি করে সম্ভব বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাওয়া। আর একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের সাথে না থেকে ভারতের সাথে থাকতো, তবে ভারতের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেতে যে আন্দোলন হতো, সে আন্দোলনে রবি বাবুই হতেন ভারতের পক্ষে রাজাকারদের প্রধান; যুক্তির বিচারে একথা নিঃসন্দেহ।
সুতরাং ধর্মভিত্তিক ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি আর স্বদেশভিত্তিক নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধান ভুলে সর্বপ্রথম আমাদেরকে যে পদক্ষেপ নিতে হবে, তা হলো- দেশ গড়ার সিদ্ধান্ত। আর এর মাপকাঠিতেই বিচার্য হবে কারা দেশপ্রেমিক আর কারা দেশের শত্রু। শুধুমাত্র আবেগ দিয়ে কখনোই দেশপ্রেম মাপা সম্ভব নয়। কেননা, সিরাজুদ্দৌলাকে দেখানোর মত যথেষ্ট আবেগ মীর জাফরের আয়ত্তে ছিল।
(এটি আমার একটি বিশ্লেষণ, শুদ্ধও হতে পারে আবার ভুলও থাকতে পারে; অতএব, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে মন্তব্য করুন।)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০০৭ ভোর ৬:৫৩