❑ ১ ❑
কুরবানিদাতারা নয়, গরীবরাই আসলে সবদিক দিয়ে ঠকছে ।
ব্যবসায়িক চাতুরী ও নানা কৌশলে কুরবানির পশুর দাম বাড়ানো হচ্ছে প্রতিবছর, আর কমানো হচ্ছে চামড়ার দাম ।
এদেশের সিংহভাগ মুসলমান কুরবানির জন্য নিজেদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু পকেটে নিয়ে হাটে যায় একটা সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান পশু কেনার জন্য । কুরবানির পশুর দেহে গোশত বেশি থাকলে দরিদ্রদেরকে একটু বেশী গোশত দেয়া যায় । চামড়ার মূল্য বেশী পেলে মাদ্রাসা-এতিমখানা, কাজের বুয়া, মিসকিনদেরকে একটু বাড়িয়ে দেয়া যায় । কুরবানিদাতাদের ভাবনায় এই বিষয়গুলি অনেক বড় প্রভাব ফেলে ।
কুরবানিদাতারা কখনোই কসাইসুলভ বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে পশুর সাইজের দিকে তাকায় না । কুরবানির পশু ব্যবসায়িরা কিন্তু নিরাবেগ দৃষ্টিতে ক্রেতাদের পকেটের দিকে তাকিয়ে থাকে । ব্যবসায়িদের ভাবনায় ধর্ম কিংবা কুরবানি সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন বিষয় । তাদের কাছে অর্থই সব ।
ঘৃণ্য ব্যবসায়িক চাতুরী ও নানাবিধ খোঁড়া অজুহাতে ফি বছর যখন একদিকে কুরবানির পশুর দাম বাড়ানো হয়, আর অন্যদিকে কমানো হয় চামড়ার দাম, তখন এদেশের সিংহভাগ মধ্যবিত্ত কুরবানিদাতার তেমন কোন ক্ষতি হয় না, যতো ক্ষতি সব গিয়ে জুটে অগুনিত অভাবি মানুষের ভাগ্যে ।
মধ্যবিত্তের ক্ষতির মধ্যে শুধু এটুকুই হয় যে, কুরবানির পশুর ক্রমবর্ধমান বাজারমূল্যের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে তাদের এককভাবে পশু কুরবানি দেয়ার সামর্থ্য ক্রমে ক্রমে তিন, তারপর পাঁচ, তারপর সাত শরিকে নেমে আসে । তারপর যে বছর বাজেটে কুলায়না তারা কুরবানি দেয়ার মতো একটি কাংখিত ও আনন্দদায়ক ইবাদত থেকে মাহরূম হয়ে যায় ।
সমাজে বাড়তে থাকে গোশত বঞ্চিত মিসকিন ও প্রার্থীদের সংখ্যা । আর কমতে থাকে এতিমখানা-মাদ্রাসার দরিদ্র ছাত্রদের বার্ষিক আয় ।
❑ ২ ❑
বড় বড় আলেমসহ অনেককেই ঢালাওভাবে বলতে শুনি—এ দেশের অধিকাংশ মানুষের কুরবানিই সহীহ হয় না; কারণ, তারা শুধুমাত্র গোশত খাওয়ার নিয়তেই কুরবানি করে থাকে ।
আমি এই ধারনার সাথে পুরোপুরি একমত নই । কারন শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত থাকলে, মধ্যবিত্ত মুসলমানরা কুরবানির পশু কেনার জন্য কয়েকজন একজোট হয়ে, হাটে গিয়ে, ঘাম, গোবর আর দরকষাকষির মতো অপ্রিয় বিষয়গুলিকে এড়িয়ে বরং কাঁচাবাজার থেকে গোশত কেনাকেই শ্রেয় মনে করতেন । কারন, হিসেব করলে দেখবেন, কুরবানির গোশতের চাইতে বাজারের কসাইয়ের কাছ থেকে কেনা গোশতই বরং অর্থমূল্যের দিক দিয়ে অধিক সাশ্রয়ী । এছাড়া কুরবানির গোশত থেকে একটি টুকরাও অভাবীদেরকে না দিয়ে নিজেরাই সব হজম করে ফেলে--এমন মুসলমান আশা করি এ সমাজে এখনও তৈরী হয়নি ।
তাই আমি বিশ্বাস করি, এ দেশের অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে সাওয়াব লাভের আশাতে কুরবানি করে থাকেন ।
তাছাড়া, গোশত খাওয়ার আকাংখামিশ্রিত কুরবানি মোটেও দোষের কিছু নয় । বুখারি শরিফে বর্ণিত কুরবানি সম্পর্কিত একটি হাদিসে এক ব্যক্তি রাসুল (সা) কে বলছে,
--ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা), এটাতো এমন দিন যখন গোশত খাওয়ার ইচ্ছা জাগে…..
আর কুরআন মজিদে কুরবানির গোশত খাওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
'….এ থেকে তোমরা নিজেরা খাও এবং মিসকিন ও ভিক্ষুকদেরকে খাওয়াও…….
এইসব পশুর গোশত কিংবা রক্ত আল্লাহর কাছে যায় না--যায় আসলে তোমাদের তাকওয়া ।'—সুরা হজ্জ, আয়াত ৩৬-৩৭ ।
তবে মধ্যবিত্তের গোশত খাওয়ার আকাংখামিশ্রিত কুরবানিকে সহীহ বলা গেলেও হারাম উপার্জনকারী এবং বহু উচ্চবিত্তের আত্মমর্যাদা রক্ষা, অহংকার ও লোকদেখানোর কুরবানিকে কোনভাবেই সহীহ বলা যাবে না ।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের সংখ্যা এ সমাজে দিনদিন বেড়েই চলেছে ।