“মুক্তচিন্তা” শব্দটির অর্থ কি? ইংরেজি Free Thought এর প্রতিশব্দ, উইকিপিডিয়া অনুসারে মুক্তচিন্তা হলো এক ধরনের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি যা বলে যে বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা এবং যুক্তির আলোকে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত; মতামত গঠনের ক্ষেত্রে প্রথা, অন্ধ বিশ্বাস এবং কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নহে। এই সংজ্ঞা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য? তা পরীক্ষা করি দেখি।
মুক্তচিন্তা কি আসলে মুক্ত? আসুন বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখি; মুক্তচিন্তা কেমন হওয়া উচিৎ, মুক্ত নাকি বাঁধা? যুক্তি বলে মুক্তচিন্তা মুক্ত হওয়া উচিত। আমি আপনাকে বললাম, আসুন ধনীদের সকল সম্পদ জোর করে গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিয়, তাদের প্রয়োজন ব্যতিরেকে। আপনি উত্তর দিলেন, না তা হতে পারেনা, আমি এটা সমর্থন করিনা! কারণ এতে যার সম্পদ কেড়ে নেয়া হবে তার ক্ষতি হচ্ছে। চিন্তা এমন হতে হবে যাতে কারও ক্ষতি না হয়। একটু আগে বলেছিলেন চিন্তা একেবারেই মুক্ত, কোনো শর্ত বা বাধা নেই। কিন্তু এখন আপনি একটি শর্ত জুড়ে দিলেন যে, চিন্তা এমন হতে হবে যাতে কারও ক্ষতি না হয়। তাহলে চিন্তা মুক্ত হয় কিভাবে বলুন? কারণ তাতেও তো অনেক সময় আপনি মুক্তচিন্তার কথা বলে অন্যের অধিকার বিনষ্ট করেন। এটা হলো মুক্তচিন্তার আসল চেহারা। মুখে বলবে মুক্তচিন্তা নিজেদের সুবিধা মত বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেবে। নিজেদের বানানো শর্তের বিপক্ষ হলেই অন্যরা হয় উগ্রবাদী।
চিন্তা কেমন হওয়া উচিত? চিন্তা যদি মুক্তই হয় তাহলে সেটা কখনও সৃজনশীল, আবার কখনও ধ্বংসাত্মক হতে পারে। ভালোও হতে পারে আবার মন্দও হতে পারে। যা কিছু ভালো তাকে আমরা সমর্থন করে থাকি। আর যা ভালো নয় তাকে সমর্থন করি না। সেটা মুক্তচিন্তার বেলায় হোক বা অন্য কিছু হোক।
চিন্তার স্বাধীনতা কতটুকু? মানুষ জন্মগত ভাবেই স্বাধীন। একথা বলে অনেকেই মুক্তচিন্তার পক্ষে যুক্তি দিয়। আসলে মানুষের স্বাধীনতারও একটা সীমা আছে। বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখা যাক; নিয়ন্ত্রণ হীনতা কি মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে? না, আনে না। যদি তা হত সন্তানের চলাফেরা উচ্ছৃঙ্খল হচ্ছে কিনা তা নিয়ে বাবা-মার চিন্তা হতো না। মানুষের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দেশে এত আইন-কানুন থাকত না। যেহেতু সন্তানের ওপর বাবা-মার শাসন এবং দেশের জন্য আইন-কানুন মানুষের কল্যাণের জন্য বলেই স্বীকৃত, তাহলে বোঝা গেল নিয়ন্ত্রণ হীনতা মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। এতেও বোঝা যাচ্ছে মুক্তচিন্তা, এসব সাধারণত ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি জন্ম দিয়ে থাকে। প্রতিটা বিষয়ের যেমন একটা মানদণ্ড আছে তেমনিভাবে চিন্তারও একটা নিয়ন্ত্রণ বা মানদণ্ড আছে। নিয়ন্ত্রণ বা মানদণ্ডের মধ্যেই চিন্তা হল মুক্তচিন্তা।
চিন্তার স্বাধীনতার ক্ষেত্র কি? একটু দেখি, তোমার পিতার সম-বয়সী কেউ জীবিত নাই, আর কোন দালিলিক প্রমাণও নাই তোমার পিতা-মাতার বিয়ের স্বপক্ষে। আমি বললাম, যুক্তি বলে তুমি জারজ। আর এর স্বপক্ষে কোন দালিলিক প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও তুমি বললা এটা বলা তোমার অধিকার নাই! তাহলে বোঝা গেল অন্যের অধিকারের উপর আঘাত করা মুক্তচিন্তা হতে পারেনা।
চিন্তার স্বাধীনতার প্রয়োগ ক্ষেত্র কি এই? বর্তমান বাংলাদেশ মত প্রকাশের নামে ক্রমাগত একটি গোষ্ঠী শুধুমাত্র ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ (সঃ) নিয়ে বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ ও মিথ্যা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে! এটাই কি চিন্তার স্বাধীনতা? মত প্রকাশের যে স্বাধীনতার কথা এই? নাকি ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা হলেই শুধু মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে তাতে সমর্থন দেয়া হয়? তাহলে ব্যক্তি বিশেষের প্রতি অবমাননামূলক শব্দ ব্যবহারে এত মামলা-হামলা কেন? চিন্তার সীমা কি? স্বাধীনতা ভালো জিনিস যখন এর সীমা নির্ধারিত থাকে। স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা যেমন কাম্য নয়, তেমনি নিয়ন্ত্রণের নামে স্বাধীনতা হরণ করাও অন্যায়। এই দুয়ের মধ্যে মধ্যপন্থাই হচ্ছে গ্রহণযোগ্য। মানুষের যেভাবে ভালো আর মন্দ দু’রকম কাজ করার ক্ষমতা আছে ঠিক সেভাবে ভালো আর মন্দ চিন্তা করার ক্ষমতাও আছে। চিন্তা করার শক্তি মানুষের মধ্যে আছে বলেই অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের মর্যাদা বেশি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, চিন্তার অনেক মূল্য আছে। চিন্তা করা ভালো। কিন্তু যে কোনও রকমের চিন্তা ভালো নয় যাতে অন্যের অধিকার হরণ হয় এবং তার বিশ্বাসকে ক্রমাগত আঘাত করে।
সব মুক্ত কি ভাল? মুক্ত হলেই কোনও কিছু ভালো হবে তা ঠিক নয়। যেমন মাঝি হীন নৌকার কথা বলা যায়। পিতা-মাতার শাসন বিহীন সন্তান বিনষ্ট হয়। আইন ও নিয়ন্ত্রণ হীন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা থাকে না। সুতরাং চিন্তার ক্ষেত্রেও মুক্তচিন্তা মানুষকে খারাপের দিকে ধাবিত করে। তাই আমাদের জেনে রাখা উচিত যে মুক্তচিন্তা নয় বরং ভালো চিন্তাই প্রশংসনীয়।
আধুনিক যুগে মুক্তচিন্তার কথাটা হচ্ছে বিদ্বেষীদের মুখ্য হাতিয়ার। সত্যিকার অর্থে মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি বলে কিছু নেই বরং হওয়া উচিত ভালো চিন্তা ও ভালো বুদ্ধি। আর যদিও থেকেই থাকে তবে এর মানে এই নয় যে, একটি গোষ্ঠীকে ক্রমাগত আঘাত করা ও মিথ্যা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৫ রাত ৯:৪৮