সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, কীভাবে বলছেন!
ফকির ইলিয়াস
========================================
একটি চরম শঙ্কা আর ভয়ের মধ্য দিয়ে সময় কাটছে বাংলাদেশের। পুরো দেশজুড়ে হত্যাকাণ্ড মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাজশাহী নগরীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকেও মোটরসাইকেলে এসে খুন করে গেছে দুর্বৃত্তরা। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের মূল ফটকের কাছে অবসরপ্রাপ্ত একজন কারারক্ষী রুস্তম আলীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে হত্যা করা হয়েছে নারকীয় কায়দায়। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল অ্যাসিস্টেন্ট জুলহাজ কাজ করছিলেন ইউএসএআইডির সঙ্গে। সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন তিনি। আর তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় লোকনাট্য দলের একজন সদস্য ছিলেন। এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। বার্নিকাট বলেছেন, ‘এই বর্বর হত্যাকাণ্ডে আমি হতবাক। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে আমাদের যারা জুলহাজের সঙ্গে কাজ করেছে, তাদের কাছে সে ছিল সহকর্মীর চেয়েও বেশি কিছু; সে ছিল আমাদের প্রিয় বন্ধুর মতো।’
কী এক বীভৎস রক্তবন্যা বইছে পুরো দেশজুড়ে। এই লেখাটি যখন লিখছি তখন খবর বেরিয়েছে, গেল দেড় সপ্তাহে ৪০টিরও বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে পুরো দেশব্যাপী। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সাধু পরমানন্দ রায়ের (৭৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সাধু পরমানন্দ গিমাডাঙ্গা হাটে বাজার করতে যান। হাট থেকে ফেরার সময় গিমাডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল মান্নান শেখ মানুর ছেলে শরিফুল শেখ ফার্নিচারের দোকান থেকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া দেয়। প্রথমে তার হাতে ও পেটের নিচের অংশে কোপ দেয় দুর্বৃত্তরা। একপর্যায়ে তিনি রাস্তার ওপর পড়ে গেলে শরিফুল তার পিঠে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে দেয়। অস্ত্রটি পেট দিয়ে বের হয়ে যায়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সেখানে তার অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে খুলনা নিয়ে যাওয়া হয়। খুলনা থেকে রাতে তাকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার দুপুরে তিনি মারা যান।
এ মাসের শুরুতেই রাজধানীর সূত্রাপুরে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিম উদ্দিনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ইসলামপুরের ঝব্বু খানম জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেনকেও মসজিদে ঢুকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার জের ধরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় এক স্কুলশিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ভেড়ামারার ফকিরাবাদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ভেড়ামারা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ নূর হোসেন খন্দকার হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। নিহতের নাম মজিবর রহমান (৬৮)। তিনি ফকিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। এতগুলো খুন প্রায় একই সঙ্গে ঘটেছে। দেশ একটি চরম বেদনাদায়ক মুহ‚র্ত পার করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিমের স্ত্রী হোসনে আরা শিলা বলেছেন, বাজারে আলু পটল বিক্রি করলে অধ্যাপক রেজাউল খুন হতেন না; বুদ্ধিজীবী হওয়ায় তাকে হত্যা করা হলো। তিনি বলেন- ‘বিচার হবে, বিচার হবে এটা শুধু মুখের কথা নয় এর প্রমাণ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে বলব বাংলাদেশ কত উন্নত হয়েছে, আপনি সিদ্দিকীর হত্যাকারীদের শাস্তি দিয়ে তার প্রমাণ করুন।’আমাদের মনে আছে, ২০০৪ সালে ২৪ ডিসেম্বর রাবি শিক্ষক ইউনুস হত্যার মধ্য দিয়ে রাবিতে শুরু হয় শিক্ষক হত্যাক্রম। যা এখনো চলছে। কারা এর নেপথ্যে তা এখনো সরকার বের করতে পারেনি।
বাংলাদেশে এই যে টালমাটাল অবস্থা চলছে, তারপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন- ‘আমি মনে করি না, সারা দেশে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চলছে। এটি বিছিন্নভাবে দু’একটা ঘটছে এবং আমাদের দেশে যারা আগে থেকে জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ত ছিল, তাদেরই একটি ভগ্নাংশ কিংবা তারা প্রয়াস পাচ্ছে।’ তিনি জানান- ‘সবকিছু দমন করা হচ্ছে। কেউ বাদ যাচ্ছে না। সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে। সে জন্য আমি মনে করি আমাদের দেশ, আমরা অনেক নিরাপদ আছি। মিডিয়াকে তিনি আরো বলেন- ‘আমরা সব সময় বলি, এগুলো প্রাথমিক অবস্থায় ছিল ছাত্রশিবির, তারপর জেএমবি, তারপর হরকাতুল জিহাদ, তারপর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম। এসব জঙ্গি সংগঠন একের পর এক তৈরি হয়েছে। আত্মপ্রকাশ করতে চেষ্টা করছে। আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি।’ তার মতে, বিচ্ছিন্ন ঘটনায় সারা দেশে ‘নিরাপত্তাহীনতা’ বোধ করার কোনো কারণ নেই। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘বিচ্ছিন্ন’ বলতে কি বুঝাতে চাইছেন? এতগুলো খুন ‘বিচ্ছিন্ন’ হয় কি করে? আমরা জানি, দেশে একটি সরকার আছে। বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা আছে। কেউ কি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না? না কি সরকারকে প্রকৃত সত্য জানতে দেয়া হচ্ছে না?
হত্যার ঘটনাগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, জামায়াত-বিএনপির ইন্ধনে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে। তিনি বলেন, যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিহত করতে গিয়ে শত শত মানুষ হত্যা করেছে, পরবর্তীতে সরকার উৎখাতের নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে তারাই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। তাদের ইন্ধনেই এসব হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এসব হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে ও ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করতে তারা (জামায়াত-বিএনপি) এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোনো অপশক্তির ওপর দায় চাপিয়েই কি রক্ষা পাবে সরকারপক্ষ? দায় পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে? যে কথাগুলো না বললেই নয় তা হলো, অভিজিৎ-দীপন-সাগর-রুনী-নীলাদ্রী-অনন্তবিজয়, এমন অনেক হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করতে পারেনি সরকার। প্রধানমন্ত্রী ‘দায় না নেয়া’র যে কথাটি বলেছেন তা মূলত ঘাতকদের আসকারা দিয়েছে। শান্তি যারা চান তারা কখনো সংঘাত চান না। এটাই মূল বিষয়। আর শান্তি চাইলে অন্যের বিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞা দেখানোর কোনো সুযোগও নেই। কিন্তু যারা খুন করছে তারা তো চরমপন্থা অবলম্বন করছে। এদের ধরতে সরকার কতটা আন্তরিক?
ভিন্ন ধর্ম বা মতের কারণে যদি কাউকে হত্যা করা হয় তাহলে পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। তিনি বলেছেন, ‘এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বরং দৃঢ়ভাবে বলা যায় বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের জন্য বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উদাহরণ। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এখানে নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মীয় সম্প্রীতির আবহে তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করেন। এটি এ দেশের ঐতিহ্য ও গর্ব। তবে, মাঝে মধ্যে ধর্মীয় বিভেদের কারণে খুন, মারামারি এবং ভাঙচুরের সংবাদ সংবাদপত্রে দেখা যায়। এটা যে কেবল ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে তা নয়; মুসলিমদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝেও এ রকম ঘটতে দেখা যায়। তিনি বলেছেন- ‘এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মাবলম্বীদের সহ্য করতে না পারা অথবা ভিন্ন মতের কারণে যদি মানুষকে হত্যা করতে হয় তাহলে পৃথিবী মানুষের জন্য বাসযোগ্য থাকবে না। আমি বিশ্বাস করি এই উগ্র মতাদর্শকে আমি যেমন সমর্থন করি না আপনারাও নিশ্চয়ই করবেন না।’ সব মিলিয়ে বাংলাদেশে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে বলে যারা বাণী আওড়াচ্ছেন, তাদের বোধোদয় দরকার। না দেশ ঠিকঠাক চলছে না। ব্যক্তির নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় কল্যাণ হতে পারে না। একজন নাগরিক নির্বিঘ্নে কাজ করতে না পারলে স্থবির হয়ে পড়ে শ্রমমাঠ। বাংলাদেশে সেটাই হচ্ছে। মানুষ শঙ্কায় ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। অন্যের ওপর দোষ দিয়ে একটি সরকার দায় এড়াতে পারে না। যারা দোষী তারা যেই হোক না কেন আইনের আওতায় আনতে হবে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ঠিকই বলেছেন, ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি, সভ্যতা মানুষের লোভকে লাগামহীন করে তুলেছে। সারা বিশ্বে মানবতা আজ বিপর্যস্ত ও বিপন্ন। আমাদের মাঝে ন্যায়বিচার, সুশাসন, কল্যাণ, ঐক্য, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতাবোধের বড়ই অভাব।’ এই অভাব কাটিয়ে উঠতে প্রজন্মকে সুসংহত হতে হবে। আর ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে সরকারকে।
----------------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:০০