ফকির ইলিয়াস
=============================================
নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশী (এনআরবি) সম্মেলন নিয়ে দেশে-বিদেশে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশী বলতে মূলত: অভিবাসী বাংলাদেশী সমাজকেই বুঝায়। অবশ্য এর বাইরেও কিছু বাঙালী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন পেশাগত প্রয়োজনে, ট্রেনিং-প্রশিক্ষনে কিংবা অস্খায়ী ভিসা নিয়ে বাংলাদেশের বাইরে অবস্খান করছেন। তবে প্রধানত: যারা অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে, দেশের মৌলিক কাঠামোকে সাহার্য করছেন বিদেশে থেকে, তাদেরকেই এনআরবি অভিধায় অভিষিক্ত করা যায়।
প্রথম এনআরবি সম্মেলনটি আগামী ২৭, ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর ২০০৭, তিন দিন ঢাকা শেরাটনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর উদ্বোধনী সেশনে উপস্খিত থাকবেন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ। সমাপনী সেশনে অতিথি হিসেবে উপস্খিত থাকবেন বর্তমান সেনাপ্রধান মি. মইন উ. আহমেদ। বলা যায় তিন মাসের কম সময়ের নোটিশে এই সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনটি আয়োজনের জন্য ‘স্কলারস বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, এর সম্পূর্ণ খরচ বাংলাদেশ সরকার পক্ষই বহন করছেন। পুরো আয়োজনের হাক-ডাক দেখে মনে হচ্ছে এটা একটি ব্যয় বহুল সম্মেলন।
নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশীদের জন্য এমন একটি সম্মেলনের আয়োজনের জন্য বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ধন্যবাদের দাবীদার। দেশে প্রবাস বিষয়ক মন্ত্রণালয় থাকার পরও বিগত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো যা করেনি, বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা করতে এগিয়ে এসেছে। উদ্যোগটি নি:সন্দেহে অত্যন্ত মহৎ।
কিন্তু কথা হচ্ছে ‘স্কলারস বাংলাদেশ’ নামক যে আন্তর্জাল (ইন্টারনেট) সর্বস্ব সংগঠনটিকে এর স্বাগতিক সংগঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা কতোটা যুক্তিযুক্ত? এবং তারা কি তা সুচারুরূপে পালন করতে পেরেছে? বিদেশে নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশীদের সংখ্যা কত? এর একটি হিসেব নিশ্চয়ই সরকারের কাছে আছে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, কানাডা, জাপান, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। রয়েছে ইলেকট্রনিক মিডিয়াও। কিন্তু ‘স্কলারস বাংলাদেশ’ এই প্রথম এনআরবি সম্মেলন সম্পর্কে বিজ্ঞাপন দেয়াতো দূরের কথা, একটি পরিশুদ্ধ প্রেস রিলিজ পর্যন্ত দেয়নি। এর কারণ কি? সঙ্গত কারণে প্রশ্ন আসে তাহলে কি ‘স্কলারস বাংলাদেশ’ দেশ ও জনগণের টাকা খরচ করে তাদের ইচ্ছেমতো লোকজনকে নিয়ে সম্মেলন করতে চাইছে? যদি তাই হয়, তবে মাননীয় সরকার পক্ষ তাদেরকে এই সুযোগটি করে দিলেন কেন?
প্রথম এনআরবি সম্মেলন উপলক্ষে ওয়াশিংটনস্খ বাংলাদেশ দুতাবাস একটি আমন্ত্রণ পত্র ইস্যু করেছে। তাতে ‘স্কলারস বাংলাদেশ’ কে সার্বজনীন স্কলারদের প্লাটফর্ম বলে দাবী করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিন বছর বয়সী এই সংগঠনটি সম্পর্কে কতো জন নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশী জানেন এ পর্যন্ত? তাদের ওয়েবসাইটে কতোজন স্কলারের ডাটাবেজ আছে? এই সংগঠন প্রবাসী বাঙালীল কল্যাণে এ পর্যন্ত কি করেছে? এর পূর্ব পর্যন্ত তাদের কি কি পরিকল্পনা ছিল?
‘স্কলার বাংলাদেশ’ যে একটি দম্পতির নিজস্ব উদ্যোগ তা এই ওয়েবে ঢু মারলেই বুঝা যায়। মাহবুব এলাহী চৌধুরী শামীম এবং তার সহধর্মিনী দিলরুবা রূপা নিউইয়র্কে ছিলেন। শামীম ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ এর যুক্তরাষ্ট্র শাখার একাংশের প্রতিনিধি ছিলেন। জোট শাখাটি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যাবার পরে (অন্য অংশের প্রতিনিধি মিথুন আহমেদ)। শামীম-রূপা দম্পতি উদীচী যুক্তরাষ্ট্র শাখা গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। এরপর এক সময় উদীচীর পসরা চুকিয়ে তারা চলে যান বাংলাদেশে। দেশে যাবার পরই ওয়েবে ‘স্কলারস বাংলাদেশ’ নামক সাইটরি আত্মপ্রকাশ আমরা দেখি। ‘স্কলার বাংলাদেশ’ এরপর জয়েন্ট ভ্যাঞ্চারে একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে প্রবাসীদের জন্য একটি পাতা প্রকাশ শুরু করে। যা মাসে একবার প্রকাশিত হয়।
কোন ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ওয়েব সাইট কিভাবে সর্বজনের কাছে গ্রহনযোগ্য হতে পারে, এর উদাহরন বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাসির ওয়েব সাইটে আছে। ‘স্কলারস বাংলাদেশ’ সাইটটি তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। না পাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে উপাত্ত সংগ্রহের অভাব কিংবা অমনোযোগিতা। তারপরও তেমন একটি প্লাটফর্মকে কেন একটি রাষ্ট্রপক্ষ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে কিংবা করতে চাইছে- প্রশ্নটি উঠছে সেখানেই।
দুই.
এই প্রবাসেও আমরা প্রতিদিন নানা রকম প্যাড সর্বস্ব সংগঠন দেখি। প্রবাসীদের কাছে এদের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। তেমনি একটি ব্যানারকে এনআরবি সম্মেলনের দায়িত্ব দেয়ায় প্রবাসে, এর বিপক্ষে সমালোচনাটি তীব্রতর হয়েছে। স্বচ্ছতার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনুষ্ঠিতব্য প্রথম এই এনআরবি সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যারা অংশ নিতে যাচ্ছেন, তাঁদের অন্যতম একজন ডা. জিয়া উদ্দিন আহমেদ। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। শহীত ডা. শামসুদ্দিন আহমেদের সুযোগ্য সন্তান। ডা. জিয়া ফিলাডেলফিয়ার ড্রেক্সেল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষকতা করেন। আমি ডা. জিয়া উদ্দিন আহমেদকে এ বিষয়ে তাঁর মতামত জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি জানান, আমরা চাইছি এনআরবি সম্মেলনের মাধ্যমে কাজটির দ্বা উম্মোচন হোক। স্বাগতিক সংগঠনটির প্রচুর ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, কাজটি আরো সুশৃংঙ্খলভাবে করা যেতো। কিন্তু উদ্যোক্তরা তা করেননি, কিংবা পারেননি। তারপরও কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হতো। ‘স্কলারস বাংলাদেশ’ সে দায়িত্বটি পালন করছে মাত্র। ডা. জিয়া উদ্দিন আরো বলেন, প্রবাসে যারা আছেন, তাদের সবার ইচ্ছা-দেশের জন্য কাজ করার। সরকার সে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে চাইছে। আমরা এর সমন্বয়টি সাধন করে এগিয়ে যেতে চাই। অন্য একটি প্রশ্নের জবাবে ডা. জিয়া উদ্দিন জানান, আগামীতে এনআরবি সম্মেলন বিদেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আমার ধারণা। এবং এর স্বাগতিক সংগঠনের দায়িত্বও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠনকে দেয়া হতে পারে।
উল্লেখ্য, এ সম্মেলনটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বেশ ক’জন বাঙালী পেশাজীবীকে বিদেশের বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাঁদের ছবি ও পরিচিতিও এনআরবি সম্মেলনের ওয়েব পেজে রয়েছে। এরা মূলত: কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছেন।
বিভিন্ন সূত্রের মতে সরকার প্রবাসী বাংলাদেশীদেরকে স্বদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যেই, এ সম্মেলনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, প্রথম এনআরবি সম্মেলনের যারা পদক পেয়েছেন, তাদেরকে কোন বিবেচনায় মনোনীত করা হয়েছে? এ নির্বাচনে বর্তমান সরকারের ভূমিকা কতটুকু। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে প্রবাসে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফেডারেশন অব বাংলাদেশী অর্গানাইজেশন অব নর্থ আমেরিকা’ (ফোবানা) গঠিত হয়েছিল। মাত্র ক’বছরের মাথায় তা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। পরে ত্রিথা, এমনকি বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। স্বদেশ কিংবা প্রজন্মের কল্যাণে এই ফোবানা মূলত: কিছুই করতে পারেনি। শুধুমাত্র একটি বড় ধরনের আড্ডাই বলা যায় এটাকে প্রতি বছর।
এনআরবি সম্মেলনও যদি তেমন মেধা ও মননের স্পর্শে সঠিক দিক নির্দেশনা না পায়, তবে পুরো উদ্যোগই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। প্রথম এনআরবি সম্মেলনে যে সব সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আলোচানার তালিকা আমরা এ পর্যন্ত দেখেছি, তাতে বিশেষ গুরুত্ববাহী কিছু আছে বলে প্রবাসের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন না।
অন্যদিকে নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশ কনফারেন্সের নামে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীল ইমেজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সাধারণ প্রবাসী সমাজ কখনোই মেনে নেবেন না। যারা সত্যিকারভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী, তাদেরকে সুযোগ করে দিতে হবে সরকারকেই। সে বিনিয়োগ, অর্থ, বিত্ত, মেধা মনন যে কোন কিছুরই হতে পারে। যদি প্রবাস বিষয়ক মন্ত্রণালয় সরাসরি এ দায়িত্বটি নিতো, তবে শুরুতেই এতো বির্তকের সৃষ্টি হতো না।
নিউইয়র্ক, ১৭ ডিসেম্বর ২০০৭
---------------------------------------------------------------------------------
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ৮:২৪