প্রতিদিন পত্রিকা খুললে দেখা যায় যে দেশের নানান জায়গায় বিভিন্ন ব্যাক্তি নানান জিনিস আবিস্কার করছেন [মুলতঃ কৃষিকাজের সুবিধার জন্য আবিস্কৃত নানান ছোটখাট যন্ত্রপাতির কথা আমি বিশেষভাবে বুঝাতে চাচ্ছি], যেগুলো ব্যবহার করে তারা এবং আশেপাশের নানান মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। সাথেসাথে বিভিন্ন অদম্য মানুষের খবরও ছাপা হয় যারা নানান জিনিস আবিষ্কার করে আমাদের চমকে দেন। আমার খুব কৌতুহল হয় এটা জানার জন্য যে, যারা এতো কষ্ট করে এই জিনিসগুলো আবিষ্কার করছেন তারা কি জানেন কিনা যে, এইসব জিনিসগুলো যদি তারা পেটেন্ট করেন তবে তারা নানাভাবে [মুলতঃ বাণিজ্যিকভা্বে] উপকৃত হতে পারেন। একটা বড় লাভ হলো, মানুষকে আপনার উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পর্কে জানান দেয়া, আর আপনার নিজের করা পেটেন্ট দেখিয়ে ভবিষ্যতে বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে গবেষণার জন্য তহবিলও পেতে পারেন। সর্বোপরি, দেশের জন্য ও সম্মান বয়ে আনতে পারেন যখন আপনি জানবেন যে, একটা দেশের সমৃদ্ধির অন্যতম পরিমাপক হলো সে দেশে বছরে কয়টা পেটেন্ট হয় তা দেখা। চায়না বিষয়টা এতো সিরিয়াসলি নিয়েছে যে, তারা "Made in China" না লিখে এখন লিখতে চা্চ্ছে "Invented in China".
যারা দাবি করেন যে, পেটেন্ট করলে সাধারণ মানুষ আর ঐসব জিনিষ ব্যবহার করতে পারবেন না, তারা কৌশলে একটা বিষয়কে এড়িয়ে যান আর তা হলো, এই সব জিনিস পেটেন্ট না করলে বিদেশী কেউ তা পেটেন্ট করে ফেলবে, তখন নিজের জিনিস বিদেশীদের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনতে হবে। আমাদের নিম, আমাদের হলুদ গাছ বা জামদানী নিয়ে মোটামুটি একই ধরনের সমস্যা নিয়ে আমরা অবগত।
মেনে নিচ্ছি আমরা ছোট দেশ, আমাদের নানান রকম সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা বড় বড় শিল্প কারখানা স্থাপন করতে অপারগ, বড় বড় গবেষণা করার মতো তহবিল আমাদের নাই, কিন্তু আমরা আমাদের ছোট ছোট কাজগুলোকে সমন্বিত করতে পারি তবে আমাদের অর্জন হতে পারে বিরাট। চারদিকে কেবল "নাই, নাই রব"- কিন্তু এর বাহিরে ও সামান্য যা কিছু আছে, তা কেবল সামান্য একটু পরিশ্রম করে পেটেন্ট করার ঝামেলার অজুহাতে নষ্ট করে দিব?
প্রাসঙ্গিক একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র ছিলাম [১৯৯৬-২০০১], ভারতীয় লেখকদের লেখা আইনের বই ছাড়া পড়ার জন্য অন্য কোন বই ছিলও না, বা কেউ চিন্তা ও করত না [রাজশাহী আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষকের বই ব্যাতিক্রম]। এরপর আসল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আইন বিভাগের জন্য তেমন কোন বিনিয়োগ লাগে না [সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছাড়া; আর মানসম্পন্ন শিক্ষক তো সকল বিষয়ের জন্যই প্রযোজ্য], কিন্তু ভবিষ্যত ভালো, এইজন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগটি খুলল। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরূণ এবং উদ্যোমী হাতে গোণা দু-একজন সহ [যেহেতু অন্যরা ফুলটাইম রাজনীতি করেন] এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুরূ করলেন লেখালেখি [হয়তঃ নিজের আগ্রহে, নয়ত প্রমোশনের জন্য বা যাই হোক। তাঁদের লেখা বই কম মানসম্পন্ন বলে অনেক তারকা আইনজীবি, তারকা আইন গবেষক (!!!) নাক উঁচুতে তুলেছেন বা এখনো তুলতে পারেন। কিন্তু এইসব শিক্ষকদের এইসব ছোট ছোট কাজের ফলাফল কি হলো জানেন? বর্তমানে এমন কোন বিষয় পাওয়া যাবে না, যেখানে বাংলাদেশী লেখকের লেখা আইনের বই নাই। আবার ও বলছি মান যাই হোক না কেন, এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে এখন বাজারে ভারতীয় আইনের বই নাই বললেই চলে [ব্যতিক্রম কেবল রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহারের জন্য বা তারকাদের ব্যবহারের জন্য কিছু ভারতীয় বই ব্যতীত]। একজন হুমায়ুন আহমেদ যেভা্বে ভারতীয় বাংলা লেখকদের বিরূদ্ধে তার নিম্নমানের [তারকা লেখকদের ভাষায় !!!] লেখা দিয়ে একা লড়ে বাজার থেকে ভারতীয় বই দুর করেছিলেন, আমাদের কম শিক্ষিত (!!!) আইনের শিক্ষকরা ও মোটামুটি নিরবে একই ধরনের কাজ করে গেছেন এবং অসম্ভব সফল হয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের জন্য রইল আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। একই ঘটনা এখানে ও ঘটতে পারে। তাই আপনার আবিস্কার যত ছোটই হোক না কেন, দয়া করে পেটেন্ট করূন।
পরিশেষে, বাংলাদেশের সরকারী অফিসের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই [পেটেন্ট করার নানান প্রশাসনিক ঝামেলা], যদি কষ্ট করে আপনার আবিস্কারকে পেটেন্ট করে ফেলেন, এর সুদূর প্রসারী লাভ আপনি, ও আপনার মাধ্যমে অন্যরা ভোগ করতে পারবে। সর্বোপরী লাভবান হবে আমাদের সোনার বাংলাদেশ।
শুভকামনা সবার জন্য।