তখনকার সময়ে ফসল আর মাছ ছিলো অর্থনীতির মূল ভিত্তি, তাই সব শাসকদের মেইন ফোকাস থাকতো জেলে আর কৃষক উৎপাদন কাজের সাথে জড়িত নিম্নবরণের প্রজাদেরকে কিভাবে হাতের মধ্যে রাখা যায়। তার জন্যে বিভিন্ন শাসক অনুসরন করতো বিভিন্ন রকম পদ্ধতি। দেওরাজের পদ্ধতিটা ছিলো এরকম, সে প্রতি বছর পূজার সময়ে একজন মানুষকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলী দিতো। সেই পূজা কোন সময় হবে বা কি ধরণের বলী দেয়া হবে সেটা নির্ধারন করা হতো গণনার মাধ্যমে।
ধর্মের নামে কতকিছুই তো জায়েজ করা হয় এযুগেও। তখন সেটা হতো আরো ব্যপকভাবে। তাই এভাবে ভালোই চলছিলো সবকিছু। প্রজারাও তা মেনে নিয়েছিলো, পুজা-পার্বন তো আর প্রতিদিন হয় না, আর একটা মাত্র মানুষই তো মরবে। তাই প্রতিবার পূজার ঘোষনা কানে যেতেই শিউরে উঠতো প্রতিটি প্রজার অন্তরাত্না। ঢেরা পিটিয়ে শুরু হতো বলীর উপযুক্ত নরের অন্বেষন। তারপর তাদের মধ্যে থেকে একজনকে মনোনীত করা হতো। এই প্রক্রিয়াটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে হাঁপ ছেড়ে বাচতো সবাই। কে জানে হয়তো নাম ঘোষনার সাথে সাথেই মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করতো অনেকে। যাক আপদ বিদায় হলো, আরো কিছুদিন সবাই মিলে নিরাপদে থাকা যাবে। শুধু কান্নার রোল উঠতো একটা পরিবারে...
এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটলো। সেসময় এর তাৎপর্য হয়তো কেউ সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি, কিন্তু এখন আমরা বুঝি এই সামান্য ঘটনা কতটা সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছিলো এই জনপদে। একবার পূজার আগে বলীর জন্য সাব্যস্ত হলো নাপিত পরিবারের এক ছেলের নাম। তাকে বলী দেয়া হলো সেইবার। এরপর যখন আবার পুজার ক্ষণ এলো, দেখা গেলো এবারও গণনায় তোলা হয়েছে সেই একই ঘরের মেজো ছেলেকে। সেবার সেই পরিবারের প্রতিক্রিয়া কি ছিলো বা তারা প্রতিবাদ করেছিলো কিনা জানা তা আমাদের জানা নেই, তবে এটা জানা আছে যে সে বছরেও কোনো বিঘ্ন ছাড়াই সুসম্পন্ন হয়েছিলো পূজা ও নরবলী। এভাবেই চলে আসলো পরবর্তী পুজার ক্ষণ। আমাদের সম্ভাব্যতার অংক কি বলে? সেই পরিবারের কারো আবার বলীর শিকার হওয়ার সম্ভাব্যতা কি খুব বেশী? না। কিন্তু পরের বছর দেখা গেলো এবারও বলীর উপযুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে সেই একই নাপিত বাড়ীর তিন ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট এবং তাদের শেষ সন্তানটি কে।
পরপর দুই ছেলেকে বলীর যুপকাষ্ঠে তুলে দেয়ার পর শেষ সন্তানকে বলীর জন্য সাব্যস্ত হতে দেখে পিতার মনের ভেতর জ্বলে ওঠে বিক্ষোভের ছাই চাপা আগুন। বলী দেয়ার দিন যতই সামনে আসতে থাকে, সে ছটফট করতে থাকে যদি কোনো ভাবে এই ছেলেটিকে পিশাচ রাজার হাত থেকে বাঁচানো যায়। কিন্তু একজন প্রবল প্রতাপশালী শাসকের বিরুদ্ধে সামান্য এক দরিদ্র নাপিত কিই বা করতে পারে?
সে জানতো ততদিনে দিল্লীতে মোঘল শাসনের পত্তন হয়েছে, আরবের কন্টকাকীর্ণ শুষ্ক জমি পেরিয়ে মুসলিম শাসকরা ক্রমে এগিয়ে আসছে ভারতের উর্বর মাটির দিকে। হিন্দু রাজারা তা নিয়ে বিলক্ষণ দুঃচিন্তায় ছিলো। একমাত্র মুসলিম বাহিনীকে যদি কোনোভাবে এই দেওরাজের ভূমিতে আনা যায়, বলী অনুষ্ঠানের আগেই, একমাত্র তাহলেই হয়তো বাঁচানো যাবে তার শেষ সন্তানকে। এই আশার ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে রাখতেই অতি গোপনে সে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলো এক মুসলিম সাধকের সাথে। তার কানে গিয়েছিলো , এই সাধক অত্যন্ত দয়ালু মানুষ। তার কাছে যদি এই অত্যাচারের কাহিনীটা সে খুলে বলতে পারে, তাহলে তিনি নিশ্চই কোনো মুসলিম রাজার দরবারে তা পৌছে দিবেন।
এই ভেবেই যোগাযোগ করে সে কোনো ভাবে পৌছে গেলো মুখঢাকা সেই সাধকের দরবারে, তুরকান শাহ হত্যাকান্ডের পর মুসলিম শাসকদের নজর কেন্দ্রীভূত হয়েছে মহাকাল গড়ের দিকে। সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের বিশেষ দায়িত্ব নিয়েই বর্তমান বাঘা উপজেলায় আস্তানা গেড়েছিলেন ছদ্মবেশী সেই মুসলিম সাধক। নাপিতের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন তিনি। ঠিক হলো সন্ধ্যায় পদ্মার তীরে আসবেন তিনি, সেখানেই বিস্তারিত কথা বলবেন সেই নাপিতের সাথে। এরপর যা করার তা করা হবে।
কথা বলে নাপিত কিছুটা আশস্ত হয়ে ফিরে আসলেন সেই দরবার থেকে, তবুও মনের ভেতর দুঃচিন্তার মেঘ। কারণ ঠিক পরের দিন সকালেই যে বলীর অনুষ্ঠান!
সেদিন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই এক নিঃসহায় পরিবারকে দেখা গেলো উদ্ভ্রান্ত চেহারায় পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে। কখন সেই সাধক আসবেন, উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন তাদেরকে। ক্ষণে ক্ষণে চকচক করে উঠে নাপিত পিতার চোখ, আবার পরক্ষণেই চেহারা মিইয়ে যায় দুঃচিন্তায়। কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে অনেক রাত তো হলো, কোথায় সেই সাধক?
অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর নাপিত বুঝতে পারলো আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বৃথা। কেউ আসবে না তাদেরকে বাঁচাতে। যা করার নিজেকেই করতে হবে। হয় পুরো পরিবার নিয়ে পালিয়ে যেতে হবে, ধরা পড়লে সপরিবারে মরতে হবে, আর নাহলে নিজেরাই নিজেদেরকে শেষ করে দিতে হবে। অন্তত আর কোনো ছেলেকে বলীর যন্ত্রে তুলে দেয়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।
হতাশ, নিরুপায়, বিব্রত সেই নাপিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাড়ালো। মনস্থিত করলো সপরিবারে পদ্মার নদীতে ঝাপ দেবে তারা। স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ক্রমশ এগিয়ে যেতে লাগলো উত্তাল পদ্মার স্রোতের অভিমুখে।
কোমর থেকে গলা পানি পর্যন্ত এগিয়েছে তারা, ঠিক এমন সময় সে সামনে থেকে একটা ডাক শুনতে পেলো। “ভয় নাই! ভয় নাই!” হঠাৎ ডাক শুনে চমকে উঠে ঝট করে সামনে তাকালো লোকটি।
আজকের মতো কাহিনীটা এই পর্যন্তই থাকুক। কালের আবর্তনে প্রবল প্রতাপশালী সেই দেওরাজের পতন হয়েছে, মহাকাল গড়ের বিধ্বস্ত রাজ্যের উপর পত্তন হয়েছে রাজশাহী শহরের। তবে ইতিহাস অনেক কিছুই মনে রাখেনি, আমরা বিস্মৃত হয়েছি সেই পরিবর্তনের ঝান্ডা তুলে ধরা সেই নাপিতের নামধাম পরিচয়। (এই নাপিতের কথা মোটমাট দুইবার এসেছে ইতিহাসে, তবে কোথাও তার নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি, ১৮৩৮ সালে লেখা এক দলিলে বলা হয়েছে তার উত্তরপুরুষরা এই নরসুন্দর পেশার সাথেই যুক্ত ছিলো এবং সেই আস্তানাটি নাপিতদের এলাকা হিসেবে চিনহিত ছিলো তখনো) কিন্তু সব কিছু হারিয়ে গেলেও কালের সাক্ষী হিসেবে থেকে গেছে দেওরাজের নরবলী দেয়ার সেই যুপকাষ্ঠটি। যদিও এর আরও অনেক কলকব্জা ছিলো, তবে মূল ফ্রেমটা বর্তমানে সংরক্ষণ করা হয়েছে সেই মুসলিম সাধক, শাহ মখদুম (রহ) এর মাজারে।
মাজারের সাথে সংশ্লিষ্টদের মুখে যা শুনলাম, তাদের ভাষায়, যখন সব যন্ত্রপাতী সহকারে একটা মানুষকে এখানে বাঁধা হতো তার একটা পেশী নাড়ানোর ক্ষমতাও থাকতো না।
(শেষকথা: যুপকাষ্ঠের বলী হয়েছিলেন রাজশাহীতে ইসলাম প্রচারে আসা প্রথম দলটি। তার প্রেক্ষিতে এখানে প্রেরন করা হয় তুরকান শাহ রহ কে। সেইবার বলী দিতে ব্যর্থ হলেও তাকে সদলবলে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলো দেওরাজার বাহিনী। তবে আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না, সেটা আবার আরেক লম্বা কাহিনী।)
সংশোধনীঃ
এই কাহিনীটা লেখার সূত্রেই এ সংক্রান্ত তথ্যনির্ভর একটা বই হাতে পেলাম। তাই পুরো পোস্টটা আবার রিভিশন দিতে হলো। সেখানে একটা ব্যাপার ভুল হয়েছিলো, সেটা হলো, বলী দেয়া হয়েছিলো এক নাপিত পরিবারের দুই ছেলেকে, জেলে পরিবার না। তবে মূল কাহিনীটা ঠিক সেভাবেই উল্লেখ আছে মূল দলিলে। আরও কিছু তথ্যসহ পোস্ট আপডেট করে দিলাম। যারা গতকাল রাতে পড়েছিলেন তাদেরকে অনুরোধ করছি আর একবার এই পোস্টটা পড়ার জন্য
--
আরও পড়ুনঃ
মুসলিম বিশ্বে ব্লাসফেমি: ধর্মের মুখোমুখি প্রগতি ও বাকস্বাধীনতা?
আরাদিয়া, মধ্যযুগের ডাইনীরা ও তাদের ধর্মবিশ্বাস