প্রথমে দূরপাল্লার বাস আর ট্রেন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যেন বাইরের শহর থেকে কেউ ঢাকায় আসতে না পারে। এরপর আবাসিক হোটেল থেকে শুরু করে সমস্ত খাবারের দোকান বন্ধ, যাতে করে যারা এসে পড়েছে তারা থাকার অথবা খাওয়ার জায়গা না পায়। এরপর জঙ্গিরা নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে, মন্ত্রীদের এই কথার প্রেক্ষিতে বাড়ী বাড়ী চলেছে তল্লাশি, কারণ যারা হোটেলে জায়গা না পেয়ে পরিচিত জনের বাড়ী যাবে তারা যেন এভাবে ধরা খায়। নির্ধারিত দিনের আগের দিন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে শহরের সমস্ত বাস, এটা করা হয়েছে কারণ যারা এর পরও ঢুকে পড়েছে তারা যেন চট করে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছাতে না পারে।
আর সবশেষে মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে পুলিশ, আদেশ দেয়া হয়েছে সন্দেহভাজন দেখলেই তাড়া করার জন্যে। কিন্তু যদি পুলিশ বিএনপি কর্মীদের চিনতে না পারে, অথবা অ্যাকশনে যেতে আলসেমি করে, তখন?? হ্যাঁ! তার জন্যে সাথে দেয়া হয়েছে লাঠি সমেত ছাত্রলীগ ক্যাডার। যাদের কাজ হলো চিনিয়ে দেয়া, " এই যে এই লোকটা মনে হয় যাচ্ছে সেখানে..." আর সাথে সাথে শুরু হয়ে যাবে অ্যাকশন!
অনুষ্ঠানটা যাতে কেউ সম্প্রচার করতে না পারে তার জন্যে সমস্ত টিভি চ্যানেলকে সান্টিং দেয়া হয়েছে, প্রচার করসো কি মরসো। তারপরও দুই একটা চ্যানেল যে ফাল পাড়ার চেষ্টা করবে সেটা জানতো এই অঘোষিত কারফিউ এর সেনাপতিরা। সেজন্যে এনএসআই কর্মকর্তাদের মজুদ রাখা হয়েছিলো ক্যাবল অপারেটরদের দিয়ে হুমকি ধামকি দিয়ে কিছু সময়ের জন্য চ্যানেল গুলা বন্ধ করে দেয়ার জন্যে। টক শো আর ব্লগে রাজনীতি বিরোধী কথা বলে দৃষ্টি আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে যাতে সরকারের এই সব আরোপিত দুর্ভোগের দায় বিরোধীদলের উপর চাপানো যায়।
কিন্তু...এত কিছুর পরও
কেউ বরযাত্রী সেজে, কেউ শিক্ষা সফরের আড়ালে, কেউবা পিকনিক পার্টির নাম করে, একেকজন একেকভাবে ছল ছুতা করে, মোটের উপর লক্ষাধিক মানুষ নিরাপত্তা বাহিনী আর সরকারি দলের ক্যাডারদের চোখ ফাকি দিয়ে রাতের অন্ধকারে বাইরের শহর থেকে এসেছে, আবাসিক হোটেল না পেলেও তারা থাকার একটা জায়গা ঠিকই খুঁজে নিয়েছে। বাস বন্ধ করে দেয়ার পর পুলিশ, বিজিবি আর ছাত্রলীগের উদ্যত লাঠি পাশ কাটিয়ে ঠিকই এসে উপস্থিত হয়েছে অনুষ্ঠান স্থলে। মাঝ খান থেকে কোটি টাকার লোকসান গুনেছে হোটেল আর বাস ব্যবসায়ীরা, সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে ঘরের (পড়ুন বেডরুমের) ভেতর। অপমানজনক তল্লাশি করা হয়েছে কর্মজীবী মানুষ পথচারী আর ছাত্রদেরকে...
কেন করা হলো এত সব??
কারণ দেশের প্রধান বিরোধীদল নিজ দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমর্থকদের নিয়ে একটা সমাবেশ করবে। তাদের কর্মসূচী শান্তিপূর্ণ হবে সেটা তারা বলেছিলো এবং তারা তা করেছে-ও। যদি এই যুদ্ধটাকে মাথা থেকে সরিয়ে দেই তাহলে বিরোধীদলের এই কর্মসূচিতে আমি জনদূর্ভোগ সৃষ্টি হওয়ার কোনও কারণ-ই দেখছি না। গত তিন চার দিন ধরে দেশে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার পুরোটা দায় সরকারের। এই ধরনের মেন্টালিটির কারণেই তারা দেশ চালাতে বার বার হোঁচট খাচ্ছে। আওয়ামী লীগকেও গণহারে দায়ী করবো না, কামরুল ইসলাম বা মাহবুবুল আলম হানিফ টাইপের ফটফট করা নেতাদের উত্থান-ই সর্বনাশের এই পথে নিয়ে যাচ্ছে তাদের দলকে, দেশকে।
আজকের দিনটাকে আমি যদি গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটা কালো দিন বলি, যদি বলি এই সরকার আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্যাসিবাদের মুকুট মাথায় নিলো তাহলে কথাটা কি খুব ভুল হবে??
লেখা শেষ করার আগে মেজর জলিলের প্রবন্ধ থেকে কয়েক লাইন শেয়ার করছি,
"স্বৈরাচার কে আমাকে কল্পনা করতে হবে না, স্বাধীনতা উত্তর সাড়ে তিন বছরে স্বৈরাচারকে আমি বার বার প্রত্যক্ষ করেছি। স্বৈরাচারকে আমি প্রত্যক্ষ করেছি বাংলার শহরে নগরে গ্রামে গঞ্জে, হাটে ঘাটে মাঠে, ক্ষেত খামার কলকারখানায়, স্কুল কলেজ ভাসিটি তে। এমনকি বাংলার বিভিন্ন কারাগারেও। স্বৈরাচার কে দেখেছি মায়ের রক্তাক্ত শূন্য কোলে। স্বৈরাচার কে দেখেছি তরুণী বিধবা বধূর বুকফাটা আর্তনাদে। অসহায় শিশুর অন্ন শূন্য মাটির বাসনে। আমি স্বৈরাচার দেখেছি বিপ্লবী দেশপ্রেমিক জননেতা সিরাজ শিকদারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। আমি স্বৈরাচার দেখেছি বহুদলীয় গণতন্ত্রের হোতা কর্তৃক আমারই দলের হাজার হাজার মুক্তিকামী তরুণের অকাল পরিণতির মধ্য দিয়ে। সবশেষে, আমি আমি স্বৈরাচার দেখেছি বহুদলীয় গণতন্ত্রের সমাধি রচনার মধ্য দিয়ে একদলীয় শাসনের উত্থানের কলঙ্কময় অধ্যায় থেকে। স্বৈরাচার কে চিনতে আমার কখনো ভুল হয়নি।"
মেজর জলিল তার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই হয়তো বিবেচনা করেছেন সবকিছু। কিন্তু আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে, আজকে, এই সময়ের যারা সচেতন মানুষ আছেন, তাদের কাছে স্বৈরাচারের সংজ্ঞা কি? স্বৈরাচারকে তার কিভাবে দেখছেন?? তারা কি চিনতে পারছেন বাঙ্গালীদের রাজনৈতিক মুক্তির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই জাতশত্রুটাকে??