এক
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
ঢাকা, ১২ঃ৫৪ , রাত
আবহাওয়া ভাল না । বৃষ্টি পড়ছে গুড়ি গুড়ি । মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । বাতাসের কোন আগামাথা নেই, এই ধুলো উড়াচ্ছে, এই আবার গুমোট । শহরের এক অভিজাত পাড়ার এক নয়তলা বিল্ডিং এর ছাদের উপর এই বাজে আবহাওয়া মাথায় নিয়ে একটা মানুষ বসে আছে । নাক , মুখ ঢাকা একটা মেটাল মাস্কে । স্কিন টাইট কালো রঙ এর পোষাক পরনে । হুড উঠানো মাথার উপর । এক কথায়, একে এই মুহূর্তে আইডেন্টিফাই করা প্রায় অসম্ভব । শুধু তার পোষাকের বুকের উপর শিকারী বাজের চিহ্ন টা বাদে ।
এই চিহ্নটা ঢাকা শহরের এক আরবান লেজেন্ড হয়ে উঠেছে । রাস্তার ছিচকে মাস্তান গুলো আজরাইলের মত ডরায় এই চিহ্নকে । এই চিহ্ন অলা লোকটা থেকে বাচতে তারা পুলিশের কাছে ধরা দিতেও রাজী । ঢাকার সন্ত্রাসী মহলে এর পরিচয় গিরিবাজ ।
কয়েকটা ক্রাইম ম্যাগাজিনে গিরিবাজ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে – একজন একাকী ক্রাইম ফাইটার, একজন মুখোশধারী , একজন প্রেডাটর ক্রিমিন্যাল – বিভিন্ন ভাবেই গিরিবাজ কে বিশ্লেষণ করা হয় । যদিও প্রধান ধারার মিডিয়া এবং পুলিশ এটাকে একটা গুজব বলেই উড়িয়ে দিয়ে আসছে ।
গিরিবাজের পাশে একটা স্ট্র্যাপ ব্যাগ – মাত্রই খুলেছে পিঠ থেকে । হাতে একটা নাইট ভিশন বিনকিউলার । তাক করে রাখা রাস্তার উলটো সাইডের তিনতলার দিকে । তিনতলায় এই মুহূর্তে ফুর্তি করছে আরমান খান । আরমান খান ঢাকা শহরের নামকরা ব্যবসায়ীদের একজন, আর গিরিবাজের মতে – ঢাকার গডফাদারদের ভিতর একজন । গিরিবাজ সন্ধ্যা হলেই রাস্তায় বের হয় – ছ্যাচড়া মাস্তান দের পিটিয়ে বেড়ায় । কিন্তু আরমান খান অন্য ব্যাপার । এরকম শিক্ষিত, স্মার্ট , এবং বুদ্ধিমান ক্রিমিনাল গিরিবাজ এর আগে দেখেনি । বেশ কিছুদিন ধরেই সে লেগে আছে আরমান খানের পিছনে, কিন্তু ব্যাটাকে ফাঁসানোর মত কিছু পাচ্ছে না । একটু আগে আরমান খানের গাড়িতে একটা পিচ্চি ডিভাইস সেট করে এসেছে গিরিবাজ । একটা ট্র্যাকার – সেই সাথে একটা নির্দিষ্ট সীমার ভিতর সাউন্ড ট্রান্সমিটার । ডিভাইসটা অনেক ধরাধরি করে , খুব ঝামেলা করে এক আমেরিকান ধনকুবেরের কাছ থেকে জোগাড় করেছে গিরিবাজ । গিরিবাজ যতটুকু জানে সেই ধনকুবেরও সন্ধ্যা হলে নিজ শহরে ক্রিমিনাল পিটিয়ে বেড়ায় । ভিজিলান্টিজমে একজন গুরু-বিশেষ সেই ভদ্রলোক । দেখা যাক – যন্ত্রখানা কতটুকু কাজের ।
আরমান খান বেড়িয়ে এলো । এতক্ষণ ড্রিংক পার্টিতে ছিল ঠিকই, কিন্তু মাতাল হয়নি । লোকটা নিজের লিমিটেশন জানে! সবচে অবাক হয় গিরিবাজ এই ভেবে যে এত বড় একজন ক্রিমিন্যাল গডফাদার – তার কোন বডিগারড নেই! শুধু ওই ড্রাইভার ব্যাটা – ওটাই কি আরমান খানের বডিগারড নাকি! ইশ! ভাবল গিরিবাজ, ড্রাইভারের ব্যাকগ্রাউন্ড চেকে আরো একটু মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল! এমন কাঁচা ডিটেক্টিভ ওয়ার্ক দিয়ে এই লাইনে কাজ হবে না । হঠাত রিং হল ফোনে, গিরিবাজের না, আরমান খানের । গাড়িতে উঠে কল রিসিভ করে দরজা লাগিয়ে দিল । কানে লাগানো ইয়ার পিসে স্পষ্ট শুনল গিরিবাজ – আরমান খান বলছে ড্রাইভার কে “ চল” ।
লাফ দিয়ে উঠে দাড়াল গিরিবাজ । স্ট্র্যাপ ব্যাগটা বেধে নিল পিঠে । টাইট স্ট্র্যাপ – হাজার দৌড়াদৌড়ি করলেও ওটা সেঁটে থাকবে গায়ের সাথে । এখন দৌড়ানোর সময় । আরমান খান রেঞ্জের বাইরে চলে গেলে আর কথা শোনা যাবে না । আরমান খান কথা বলে চলেছে –
“হ্যালো, হ্যা চন্দ্রনাথ বল...”
নয়তলা থেকে নামতে হবে, সারভেইল্যান্স এর সময় শেষ!!
“কি হয়েছে চিটাগাং এ?”
বিল্ডিং এর বাঁ পাশে আগে থেকেই বেঁধে রাখা নাইলনের দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল গিরিবাজ । হাতে মোটা লেদারের গ্লাভস থাকায় ব্যাথা পাচ্ছে না, পিছলে নেমে আসছে দ্রুত...
“বুঝতেই পারছ খুব বেশি ইমারজেন্সি না হলে আমি এখন ঢাকা ছাড়তে পারিনা , তাছাড়া...” --- কথা অস্পষ্ট হয়ে আসছে দূরত্বের কারণে ।
গিরিবাজ এর পা মাটি ছুতে আরো একতলা বাকি । দড়ি ছেড়ে দিয়ে লাফ দিল ও । এক গড়ান দিয়েই সোজা হয়ে দাড়াল , এরপর দৌড় শুরু হল – পরের বিল্ডিং এর সামনে লাইটপোস্টের নীচে ওর বাইক খানা পার্ক করা ।
এদিকে গলির মোড়ে গাড়ি স্লো হওয়ায় আবার ফিরে এল শব্দ তরঙ্গ “...... কাল ভোরে টিকেট বুক কর । আসছি আমি । সব কিছু রাংগামাটিতে সরিয়ে নিয়ে যাও । ”
বাইক স্টার্ট হল – কিন্ত গিরিবাজ আর ফলো করল না । যা জানার জেনে গেছে সে । রাঙ্গামাটি ।
দুই
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
ঢাকা, ৭ঃ০০, সকাল
জাহিদ কায়সার । কর্মক্ষেত্রে পরিচয় এজেন্ট কায়সার । এসবি’র একজন ফার্স্ট ক্লাস এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে সে দুই বছর হল । আজ একটা ইমারজেন্সী এবং কিছুটা গোপন ডাক পেয়ে পুরোনো অফিসে এসেছে সে । কচুখেতের ডিজিএফআই হেড অফিস । ডিজিএফআই এর ডিরেক্টর জেনারেল হায়দার দস্তগীর ডেকে পাঠিয়েছেন ।
ডিজি’র অফিস রুমে ঢুকল কায়সার । ডিজির সেক্রেটারি ঢুকতে বলেছে বলেই ঢুকেছে – কিন্তু ডিজি তার চেম্বারে নেই । চেম্বারের ডান দিনে আরেকটা দরজা – আধখোলা – ওপাশে অন্ধকার । তাতে হঠাত হঠাত আলোর খেলা চলছে, যেন কেউ ঘর অন্ধকার করে সিনেমা দেখছে । ওদিকে যাবে নাকি বুঝতে পারছে না কায়সার । হঠাত ডিজির গলা শোনা গেল, “জাহিদ এসেছ??”
“জি স্যার”, গলা পরিষ্কার করে নিয়ে জবাব দিল কায়সার ।
“ভেতরে এসো”, আবার শোনা গেল ডিজি দস্তগীরের কন্ঠ । আর দেরী করল না জাহিদ কায়সার । ঢুকে পড়ল অন্ধকার ঘরটায় ।
ভেতরে একটা প্রজেক্টর চলছে । এর আলোই দেখছিল সে বাইরে থেকে । আর কোন লোক নেই । ডিজি একা বসে আছেন । প্রজেক্টরের আলোর রিফ্লেকশন দেখা যাচ্ছে তার চকচকে টাকে, আর তার চোখের চশমার লেন্সে । আবছা আলোতেও দেখতে পাচ্ছে কায়সার, ডিজির কপালে অনেকগুলো ভাঁজ , বয়স নয়, দুশ্চিন্তাই এর কারণ । ডিজি চিন্তিত ।
ঘরে আরেকটা চেয়ার আছে, কিন্তু ডিজি বসতে বলছেন না । স্ক্রীনের দিকে তাকাল কায়সার – বেশ কিছু পেপার কাটিং আর ছবি দেখা যাচ্ছে । সবগুলাই ভেতরের পাতায় বা পেছনের পাতায় প্রকাশিত খবর । হেডলাইন গুলায় চোখ বুলাল কায়সার ।
‘ছিনতাই ঠেকাল অচেনা মুখোশধারী’
‘ অপহৃত বাচ্চা উদ্ধার ঃ অচেনা মুখোশধারীর বীরত্ব’
‘সন্ত্রাসীদের নতুন ভয় ঃ গিরিবাজ’
‘পুলিশকে পেটাল গিরিবাজ!’
“গিরিবাজ এর নাম কানে এসেছে তোমার?” হঠাত জিজ্ঞেস করলেন হায়দার দস্তগীর । স্ক্রীন থেকে চোখ সরিয়ে ডিজির দিকে তাকাল কায়সার । বলল, “শুনেছি অল্প সল্প । তেমন ডিটেইল জানি না।”
“জেনে ফেল,” বললেন ডিজি, একটা চুরুট নিলেন হাতে, “কারণ গিরিবাজ হতে যাচ্ছে তোমার নেক্সট এসাইনমেন্ট ।”
“স্যার?” অবাক কায়সার, “আমি যতটুকু জানি গিরিবাজ একটা রাস্তার গুন্ডা পেটানো ‘ওয়ানা-বি’ হিরো – কোন চ্যাংড়া ছেলে পেলে হবে হয়ত! তাকে ধরতে...” কথা শেষ করল না এজেন্ট জাহিদ কায়সার । তাকে ধরতে কায়সার কে এসবি’র ডিউটি থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, ওর কাছে জিনিসটা অপমানজনক লাগছে । কিন্তু ডিজিকে তো আর সেটা বলা যাবে না! তবে ডিজি বুঝবেন সেটা ।
বুঝলেন ডিজি, বললেন, “গিরিবাজ কোন লোকাল চ্যাংড়া ছেলে নয় জাহিদ । মিডিয়াতে সব আসেনা । গিরিবাজ গত মাসে এক এমপির সাথে বার কাউন্সিলের এক এডভোকেটের ফোন রেকর্ডিং ফাস করে দিয়েছে – ট্রায়াল চলছে তার – সংসদ সদস্য পদ বাতিল হতে পারে । সরকারি দলের এমপি । উপর থেকে চাপ আছে । এছাড়া গত তিন মাসে অন্তত চার পাচটা বড় বড় গ্রুপের টেন্ডার বাতিল করে দিয়েছে লোকটা – কিভাবে করেছে সেটা এখোনো নিশ্চিত না আমরা । কিন্ত যাদেরকে সে খেপিয়েছে – সবগুলাই গভীর পানির মাছ – এদের টাকা সরকার বিরোধী দল সবাই খায় । আমাদের উপর এই মুহূর্তে টপ থ্রি প্রায়োরিটির ভিতর একটা হল গিরিবাজ।”
“কিন্তু স্যার,” বলল কায়সার, “শুনে তো মনে হচ্ছে লোকটা একা একাই করাপশনের বিরুদ্ধে ফাইট করছে! আমরা তাকে ধরার জন্য মানহান্ট চালাব কেন?!”
“আই ফিল ইউ মাই সান,” চুরুটে লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন হায়দার দস্তগীর, “কিন্তু আফটার অল, আমরা বাংলাদেশের মত একটা দেশে বাস করি । গিরিবাজ লোকটা সরকার এবং এর ডোনারদের কে বিব্রত করছে । যদি লোকটা একান্তই কোন এসেট হয়, তাহলে তাকে আমাদের আন্ডারেই কাজ করতে হবে । রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে হবে।”
“মনে হয়না, এই লোক কারো আন্ডারে কাজ করতে রাজী হবে।” নিচু গলায় বলল কায়সার ।
“সেক্ষেত্রে”, একরাশ ধোয়া ছাড়ার জন্য একটু থামলেন ডিরেকটর জেনারেল হায়দার দস্তগীর । তারপর কায়সারের চোখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, “তোমার কাজ ওকে নিউট্রালাইজ করে দেয়া।”
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:৫৮