পাতা গুলো ঝরে যাচ্ছিল এক একঘেয়ে ছন্দে । প্রায় নিঃশব্দে । মৃদু মচ মচ আওয়াজ ।
একা আমি দাড়িয়ে আছি বনের শেষ প্রান্তে , পাহাড়ের ঠিক কিনারায় । মনে হচ্ছিল নুবিয়া’র কথা । আগে আমরা প্রায়ই হেটে হেটে আসতাম এখানে । অনেক কথা হত আমাদের । বেশিরভাগ কথাই অপ্রয়োজনীয় । কিন্তু অনেক ভাল লাগত । এসবই যুদ্ধের আগের কথা ।
মাত্র এক বছরের ভিতর একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেল ।
সব কিছু আবার আগের মত হয়ে গেছে , হয়ত আসলে আগের চাইতেও ভাল । তবে তা কারো কারো কাছে । আমার কাছে আগের সময়টাই ভাল ছিল । তবে এটা আসলে স্বার্থপর চিন্তা ভাবনা । আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে যেই যুদ্ধটায় আমরা জিতেছি সেটা আমাদের সবার জন্যেই ভাল । কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা আমার মত নীতিবান যোদ্ধাকেও কাপুরুষ আর স্বার্থপর বানিয়ে দেয় । নুবিয়া’র ব্যাপারটা আমার জন্য ঠিক সেই রকম একটা ব্যাপার ।
ঘটনাটা খুব অল্প কথায় বলি , আমার হাতে সময় খুব বেশি নাই ।
প্রাচীন কাল থেকে রোবট নিয়ে মানবজাতি যেই ভয়টা করে এসেছে , সেটাই সত্যি হয়ে উঠেছিল । রোবটদের আমরা মানবিক করে তুলেছিলাম আমাদের নির্দেশ ভালমত আত্মস্থ করার জন্য । তাদের মাঝে বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও সংযোজন করা হয়েছিল আবেগ , যেন তারা তাদের মানব প্রভু’র আবেগ কে বুঝতে পারে । তারা দেখতেও ছিল মানুষের মত । সব কিছু করা হয়েছিল আমাদের , মানে মানবজাতি’র কথা ভেবে । কিন্তু কখনো ভাবা হয়নি যে একটা আবেগসম্পন্ন বুদ্ধিমান সত্ত্বা, সে রোবট হলেও, একটা ন্যূনতম সম্মান আশা করে । একটু সহমর্মিতা চায় । হয়ত একটু ভালবাসাও চায় । কিন্তু মানুষ নিজেদের মাঝেই সহমর্মিতা, সম্মান, ভালবাসা সব শেষ করে ফেলে সব সময় । অবশ্য স্বজাতি‘র প্রতি মানুষ আসলে কতটা সহনশীল তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু আমি সেদিকে যাব না । আসল ব্যাপার হল মানুষ রোবট কে একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছু কখনই ভাবতে পারে নি । তাই যা হবার তাই হল । রোবটরা বিদ্রোহ করল । তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হল মানুষকে ।
আমি নিজেও সেই যোদ্ধা দের একজন । গত দশ মাসে কতগুলো রোবট মেরেছি তার হিসাব রাখিনি । একটু ভুল হল । রোবটকে মারা যায় না, তারা তো আর জীবিত নয় । বড়জোর ধ্বংস করা যায় । যেই মানুষ তাদের সৃষ্টি করেছিল , সে মানুষই নিজের হাতে ধ্বংস করেছে তাদের । মানুষ ও মরেছে অনেক । মানুষের রক্ত আর রোবটের গ্রীজ মাখামাখি হয়ে ছিল শহরের পর শহর । আর সেই সময়ই... হায় নুবিয়া !!
নুবিয়া ছিল আমার সবচে আপনজন । আমি ভালবাসতাম তাকে । সেও ছিল আমার জন্য পাগল । আমাকে সবসময় শাসন করত , “এটা কর না - ওটা কর না - ঠিক মত হাট - সুন্দর করে দাড়াও” আরও কত কি ! আমার মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগত । কিন্তু কখনো কিছু বলতাম না, কি জানি! আবার যদি কষ্ট পায়!!
যুদ্ধের একদম প্রথম দিকে, আমি তখনও যাই নি । যাব যাব করছি । তখন শেষ বারের মত আমরা এসেছিলাম এই জায়গায় । অনেক নিচু স্বরে ও বলেছিল, “ জানি তুমি যাবেই । যাও । কিন্তু যদি ফিরে এসে না পাও আমায় তবে একটা কথা জেনে রেখ, আমার ভালবাসা ভান ছিলনা কখনো । আমার ভালবাসা কৃত্রিম নয়।”
আমি জানতাম সেটা ।
আমি তাকে নিরাপদে রেখে যেতে চেয়েছিলাম । এই বনের মাঝেই একটা গোপন পুরনো কেবিন আছে । সেখানে রেখে গিয়েছিলাম ওকে । যাবার আগে বলেছিলাম, “তুমি অপেক্ষা কর । আমি মরব না । শুধু তোমার জন্য বেচে থাকব । দশ বছর পর হলেও ফিরে আসব এখানে, তোমার কাছে, তোমার অকৃত্রিম ভালবাসার কাছে ।” নুবিয়া শুধু হেসেছিল ।
দশ বছর নয় , আমি দশ মাস পরেই ফিরে এসেছি ।
কিন্তু... আমার নুবিয়া... সে এই কেবিনেই ছিল । কোথাও যায় নি । আস্থা রেখেছিল আমার উপর । কিন্তু অন্য মানুষেরা তাকে বাঁচতে দেয় নি । তার একটাই দোষ ছিল ।
সে যে একটা রোবট!
নুবিয়া স্বাধীনতা চায় নি । সে চেয়েছিল সারাটা জীবন আমার অধীন থাকতে । আমিও তাকে ভালবেসেছিলাম রোবট হওয়া সত্তেও । রোবট মেয়েরা মানব মেয়েদের মত স্বার্থপর নয় । তারা শুধু ভালবাসার প্রতিদান দিতেই ভালবাসে । তারা হয়ত কৃত্রিম , কিন্তু আমি জানি আমার নুবিয়া’র ভালবাসা কৃত্রিম ছিলনা ।
মানুষ মারা গেলে তো মৃত্যুর ওপারের জগতে চলে যায় । রোবট রাও কি যায়? আমি জানি না । শুধু জানি নুবিয়া নামে একজন ছিল যে আমার বেচে থাকার সমস্ত অনুপ্রেরণা সাথে করে চলে গেছে । কোথায় গেছে আমি জানি না । কিন্তু যেখানে নুবিয়া একদিন ছিল, এখন নেই, সেখানে আমি কিভাবে থাকি!
পাতাগুলো ঝরছে এখনো । সেই একঘেয়ে মৃদু মচ মচ শব্দ । আমি এগিয়ে গেলাম বনের একেবারে প্রান্তে । এখানে শেষ হয়েছে পাহাড়ের ধার । ওপাশ টা অনেক নিচু, স্পষ্ট দেখা যায় না । আমার পরবর্তী গন্তব্যের মতই অস্পষ্ট ।