দিন – ১০ (১৬-০৩-২০১৩)
রাত ১টা। বাসে সবাই ঘুম। আমার কেন যেন ঘুম আসছিল না। অনেক চেষ্টা করলাম ঘুমাতে কিন্তু ঘুমাতে পারছিলাম না। শেষ রাতে ফখরুল তার তোষকটা দিলে ঘুম আসে আমার। দুইটা তোষক একসাথে গায়ে দিয়ে এমন ঘুম দিলাম কবে যে দিল্লী পৌঁছালাম বুঝতেই পারিনি। সকাল ৮টায় বাস থেকে নামলাম। হোটেলে যাওয়ার জন্যে আরেকটা বাসে উঠতে হবে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাস আসল। আরেক যন্ত্রণা! হোটেলে যাওয়ার জন্য বাস থেকে নেমে ১০মিনিটের পথ হাঁটতে হয়। ভারতে আমরা এই ধরণের সমস্যায় অনেকবারই পড়েছি। যদিও আমি নিয়ম মেনে চলার এই সংস্কৃতিটাকে পছন্দ করি। দিল্লীতে আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেটির নাম ছিল “সোনা হোটেল”। মাত্র ৩ঘন্টার জন্য এই হোটেলে উঠা। শুধুমাত্র ফ্রেশ হওয়ার জন্যে।
এক রুমে আমরা ৬জন ছিলাম। আমাদের ৪জনের সাথে নাহিদ ভাই আর আনন্দ ছিল। তিন ঘন্টার মধ্যে ৬জন ফ্রেশ হওয়া, নাস্তা করা, তৈরি হয়ে বের হওয়া অনেক কষ্টকর ব্যাপারই ছিল। আমি আর নাহিদ আগে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হলাম। মানালীতে নাহিদের জুতা ছিড়ে গিয়েছিল। ওর সাথে জুতা কিনতে বের হলাম। ওর জুতা পছন্দ করতে কয়েকটা দোকান ঘুরতে হল। জুতা কিনে আবার হোটেলে ফিরলাম। খোলা আকাশের নিচে নাস্তা করে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম। বাসে উঠার জন্যে আবার ১০মিনিট হাঁটতে হল। এর মধ্যে জুবায়ের পড়ল এক ফটকা ব্যবসায়ীর কবলে। সে ৪০০রুপি দিয়ে ৩২গিবা পেনড্রাইভ কিনল! এত কম দামে পেনড্রাইভ কিনে তো সে মহাখুশি! জুবায়েরের কাছ থেকে দেখে মুহিতও কিনতে গেল। এই ব্যাপারটা খেয়াল করল সোহেল স্যার। স্যার না দেখলে মুহিতের টাকাটাও যে পানি ফেলত তা আর বলার অবকাশ রাখে না। কারণ জুবায়েরের পেনড্রাইভটা কাজ করে না। কিছুক্ষণ পর বাস আসলে আমরা জয়পুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।
দুপুরে রাস্তার পাশে ছোট একটি রেস্টুরেন্টে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে আবার জার্নি শুরু। বিকেলের দিকে গানের আসর বসে বাসে। আমাদের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী সোহেল স্যার জনপ্রিয় কয়েকটা গান গেয়ে শোনান। তার মধ্য উল্লেখযোগ্য গানটির কথা ছিল-
“তিনটা বউ, আমার তিনটা বউ
একটা বউ রান্ধে বারে
আরেক বউয়ে খায়
আরেকটা বউ আইসা দেখে খাওয়ার কিছু নাই।।
তিনটা বউ, আমার তিনটা বউ।“
এর সাথে ছিল আমাদের এমপিথ্রি জুবায়েরের গান। সে গেয়েছিল কাভি আলবিদা না কেহেনা। সে যখন গান গাওয়া শুরু করেছিল তখন সবাই হাসতে হাসতে কান্নাই করে দিয়েছিল। ওর গানের ভিডিওটি দেখলে আজও মন খারাপ হয়।
সন্ধ্যা ০৭:৩০টায় জয়পুর শহরে প্রবেশ করি। জয়পুরকে পিঙ্ক সিটি কি কারণে বলা হয় বুঝতে পারিনি। সবচেয়ে পুলকিত হলাম রাতের জলমহল দেখে। অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিল জলমহলকে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গাড়ি দাঁড়ালো না। আমাদের গাইড বাকী ভাই হোটেলে যাওয়ার রাস্তাটা ভুলে গিয়েছিলেন। সোজা রাস্তা দিয়ে না গিয়ে তিনি আমাদের শহরের অলি-গলি ঘুরিয়ে হোটেলে নিয়ে গেলেন। জয়পুর শহরের অলি-গলি যেন আমাদের পুরান ঢাকার অলি-গলি। অনেক পুরোনো সব বিল্ডিং, সরু রাস্তা মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমাদের দেশের কথা। সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে সেদিন রাতে আমরা বাইরে ঘুরতে বের হব। ঘুরে এসে রাতের খাবার খাব, প্রয়োজন হলে রাতের ১২টায়। হোটেলে পৌঁছালাম ৮টায়। কথা মত ৮:৩০টায় ঘুরতে বের হলাম সবাই।
রাত ৮টার পর থেকে সেখানে সকল শপিং মলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমেই আমরা যায় “সিটি প্লাজা” নামক একটি শপিং মলে। সেখানে দুটি দোকান ছাড়া আর সবই বন্ধ ছিল। সবকিছু যখন বন্ধ দেখলাম তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা ৬জন জলমহল দেখতে যাব। কিন্তু যেতে পারলাম না। গাড়ি ভাড়া ১৫০রুপি শুনে ভেবেছিলাম জলমহল আমাদের হোটেল থেকে অনেক দূরে। কিন্তু পরের দিন যখন গিয়েছিলাম তখন হিসেব করে দেখলাম মাত্র ১৫মিনিটের রাস্তা। রাতের সৌন্দর্য্যটা আর উপভোগ করা হল না।
উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক থাকালাম। দেখলাম সব দোকানই আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটি জুসের দোকান চোখে পড়ল। জুস পাগল বলে ভারতের জুস একটু পরখ করে দেখতে ইচ্ছে হল। ঐ দোকানে গিয়ে দেখলাম অনেক ধরণের ফ্লেভারের জুস আছে। দুই একটা ফলের জুস বাংলাদেশে কখনো খাইনি। সুতরাং ঐসব ফলের জুস খাব বলেই ঠিক করলাম। পছন্দ করলাম আনারসের জুস। শুধু জুস বললে ভুল হবে। আনারসের শেইক নিলাম এক গ্লাস। নকিবও আমার মত আনারসের শেইক নিল আর ফখরুল নিল স্ট্রবেরি শেইক। যদিও ফখরুল পরে আরেক গ্লাস আনারসের শেইক নিয়েছিল। অসাধারণ স্বাদ! আনারসের জুসই কখনো খায়নি। আর এতো শেইক! বাংলাদেশে এসেও ঐ জুসের দোকানটার কথা ভুলতে পারিনা। আমাদের তিনজনকে দেখে নাহিদ ভাই, নাহিদ আর আনন্দও জুস খেল। পরে ভাবলাম স্যারদের জন্য নিয়ে গেলে কেমন হয়? বোতলে করে স্যারদের জন্য নিয়ে গেলাম।
হোটেলে যাওয়ার আগে আরো কিছুক্ষণ শহরটাকে ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হল। তাই জুসের বোতল নিয়েই ঘুরছিলাম। একটি শপিং মলের সামনে খোলা জায়গা দেখে কিছুক্ষণ বসে গল্প করতে চাইলাম। ঐ শপিং মলে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। নাম “খানহা”। ঐ রেস্টুরেন্টে ঢুকতে যাচ্ছিলাম এমন সময় দেখি রবিন স্যার আর সোহেল স্যার সাথে আরো কয়েকজন ছাত্র সেখানে নাস্তা করছে। মাথা ঠান্ডা রেখে হামলা করলাম সেখানে। স্যারদেরকে জুস খেতে দিলাম। প্রথমেই সোহেল স্যার “দোসা” খাওয়ালেন আমাদেরকে। তারপর ভাবী মানে রবিন স্যারের স্ত্রী মাশরুম পিজ্জা খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ বসে আমরা ৬জন বের হয়ে গেলাম। স্যারেরা তখনও ছিলেন। আমরা আরো কিছুক্ষণ ঘুরে হোটেলে ফিরলাম। খাওয়া শেষ করে জীবনের প্রথমবারের মত বারে গেলাম। নাহিদ ভাই বলেছিল অ্যালকোহল মুক্ত পানীয় আছে। মূলত গিয়েছিলাম এই কারণেই। কিন্তু গিয়ে দেখি অ্যালকোহল মুক্ত কোন পানীয় নেই। আনন্দ, নাহিদ, নাহিদ ভাই, আদনান আর সাফি পান করতে বসে পড়ল। আনন্দ গ্লাসে নিয়ে এক চুমুক দিয়েছিল কিন্তু শেষ করতে পারেনি। আমি, ফখরুল আর নকিব বারের নষ্ট গন্ধ সহ্য করতে না পেরে রুমেই ফিরে গেলাম। একটু পর নাহিদরাও রুমে ফিরল। ওরা রুমে আসার পর মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি আসল। বুদ্ধিটাকে কাজে লাগানোর জন্য ছোট একটা পরিকল্পনা করলাম। আক্রমণভাগে থাকবে নাহিদ, সহায়তাকারী হিসেবে থাকবে ফখরুল, ভিডিওগ্রাফার হিসেবে থাকবে আনন্দ আর আমাদের টার্গেট ছিল জুবায়ের। পরিকল্পনা মত জুবায়েরের রুমে গেল ওরা এবং আক্রমণও করল। আক্রমণ করতে না করতেই নাহিদের সাথে যুক্ত হল নাইম ভাই আর মুহিত। এদিকে জুবায়ের তো "আঁই মরি যাইয়্যুম" বলে চিৎকার করছিল। আর এসব ভিডিও করছিল আনন্দ। ভিডিওটা যতবারই দেখি হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসে। এরপর সবাই রুমে ফিরেপরেরদিন খানহা রেস্টুরেন্টে কি কি খাওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করলাম। বলাবাহুল্য, খানহার খাবারের স্বাদ কিন্তু অসাধারণ ছিল। আলোচনা শেষে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে খানহা যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছিল।