দিন – ২ (০৮-০৩-২০১৩)
যাত্রার শুরু থেকেই প্রচন্ড জ্যামের কবলে পড়েছিলাম আমরা। কুমিল্লায় যখন বিরতি দিল তখন ঘড়িতে বাজে সকাল ৫টা। খাওয়া সেরে আবার বাসে উঠলাম। আমরা তখনো জানতাম না আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছিল। পথে ঢাকা থেকে আমাদের সাথে যোগ দেয় আনন্দ আর হাসিব স্যারের স্ত্রী। সকাল ৯টায় যখন ঢাকার গাবতলী পৌছালাম তখন আমাদের গাইড বাকী ভাই বললেন, বুড়িমারী সীমান্তে পৌছাতে আর ৭ঘন্টা দরকার। উল্লেখ্য যে, ঐ প্রান্তে সীমান্ত খোলা থাকে বিকাল ৫:৩০টা পর্যন্ত। বাংলাদেশের কাস্টম হাউসে রবিন স্যারের পরিচিত লোক থাকায় তারা আমাদের জন্য সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সীমান্ত খোলা রাখবে বলে জানায়। বাকী ভাইয়ের হিসাব অনুযায়ী আমরা এই সময়ের মধ্যে বর্ডারে পৌছানোর কথা ছিল। সময় বাঁচানোর জন্য আমরা সকালের নাস্তা বাদ দিয়েছিলাম। একটা এনার্জি বিস্কুটের প্যাকেট ৬জন ভাগ করে খেয়েছিলাম।
গাড়ি চলছে তো চলছেই। রাস্তা যেন ফুরাবার নয়। বগুড়ায় রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে আমাদেরকে অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হয়েছিল। ভুলটা হল সেখানেই। ড্রাইভার রাস্তা ভুল করে চলে যায় অন্য রাস্তায়। এদিকে ঘড়িতে যখন সন্ধ্যা ৬টা বাজে তখন সবাই বুঝতে পারে আমরা আজ সীমান্ত পাড়ি দিতে পারছি না। অনেকে তখনই বাস থেকে নেমে বাসায় চলে আসতে চেয়েছিল। স্যারদের অনুরোধে সবাই শান্ত হয়। এর মধ্যেও ঘটতে থাকে অনেক মজার ঘটনা। হঠাৎ করে পেট খারাপ হয় জুবায়েরের। সে তো ফিলিং স্টেশনে কোনভাবে কাজ শেষ করল। এরপরই ঘটে আসল ঘটনা। সিটি ক্যাম্পাসের আদনান চাপ ধরে রাখতে না পেরে প্যান্টেই কাজ সেরে দিয়েছিল। ওর বন্ধু ইমন প্যান্টের জন্য আসলে আমরা ভেবেছিলাম ইমনই বোধহয় কাজটা করেছে। কলকাতা আসার আগ পর্যন্ত আমরা ইমনকেই এই কাজের হোতা মনে করেছিলাম। কিন্তু পরে জানতে পারি এই কাজটি আসলে করেছিল আদনান। হাসির এমন কিছু মূহুর্তকে সঙ্গী করে চলতে চলতেই একসময় গাড়ি থামে। তখন ঘড়িতে বাজে রাত ১১:১৫টা।
বুড়িমারী সীমান্তে হোটেল ছিল একটাই। ছোট হোটেল হলেও খারাপ ছিল না হোটেলটা। আমাদের রুমটাই সবচেয়ে বড়। তাই এই রুমে আমরা ৯জন ছিলাম। হোটেলের এই রুমেই পরিচয় হয় আমাদের এক সেমিস্টার সিনিয়র নাইমের সাথে। আমরা তার নাম দিয়েছিলাম চরম। তার প্রতিটি কথায় চরম শব্দটা থাকতই। সবাই হাত-মুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেতে বের হলাম। আমাদের গাইড আগে থেকে জানিয়ে দেওয়ায় খাবার মোটামোটি ভালই ছিল। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার ফরমে পূরণ করতে সবাই বাকী ভাইকে পাসপোর্ট জমা দিয়ে ফরমে স্বাক্ষর করলাম। স্যারসহ সবাই আমাদের রুমে একত্রিত হল। উদ্দেশ্য আমাদের সফরের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা। কারণ বাংলাদেশে থাকতেই শিলিগুড়ি থেকে দিল্লীগামী ট্রেনের টিকেট করা হয়েছিল ৯ই মার্চের জন্য। সীমান্ত খোলা হবে সকাল ৮টায়, সীমান্তের সকল আনুষ্ঠিকতা সারতে সময় লাগবে কমপক্ষে ২ঘন্টা, সীমান্ত থেকে শিলিগুড়ি যেতে সময় লাগে ২ঘন্টা। হিসাব করে দেখা যায়, কোনভাবেই আমরা ট্রেনের সময়ানুযায়ী স্টেশনে পৌছাতে পারব না। আর অন্যদিকে সমস্যা হচ্ছিল কাশ্মীর যাওয়া নিয়ে। একে তো আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুই হচ্ছিল না, তার উপর কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা হিসেবে আসল কাশ্মীরের রাজনৈতিক সহিংসতা। ঐ মিটিংয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সিমলা আর মানালি যাওয়ার ব্যাপারে। মিটিং শেষ করে যে যার রুমে চলে গেল। সকাল সকাল উঠতে হবে শুনে সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল।
দিন – ৩ (০৯-০৩-২০১৩)
সবাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গেলাম। সকালের নাস্তা সেরে রওনা দিলাম বাংলাদেশের কাস্টম অফিসের উদ্দেশ্য। হোটেল থেকে হেঁটে যেতে মাত্র ৫মিনিট সময় লাগে। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে যখন “ নো ম্যান্স ল্যান্ড“-এ পা রাখলাম তখন মনের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি হল। নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাচ্ছি। ঐ দেশের সবকিছুই তো আমার অচেনা। ১৭দিন টিকে থাকতে পারব তো? এমন অনেক প্রশ্ন নিয়ে প্রথমবারের মত পা রাখলাম অন্য কোন দেশের মাটিতে। ভারতীয় বিএসএফ আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে গেল। তারপর ভারতের কাস্টম অফিসে একটা ফরমে স্বাক্ষর করলাম সবাই। এরপর আবার সবাইকে নিজেদের পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হল।
কাস্টমস অফিসের আনুষ্ঠিকতা শেষ করে আমরা মুদ্রা পরিবর্তনের জন্য একটি দোকানে যায়। সবাই ডলার আর টাকাকে রুপিতে রুপান্তরিত করল। Lays চিপস কিনে প্রথমবারের মত রুপি ব্যবহার করলাম। বাকী ভাই আগে থেকেই বাস রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। তাই গাড়ির জন্য আমাদের তেমন কোন সমস্যা হয়নি। সকল কাজ সম্পাদন শেষে বাসে করে রওনা দিলাম শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে। বাসেই প্রথম সোহেল স্যারের কন্ঠে গান শুনি আমরা।
দুপুর ১২:৩০টা। বাস থেকে নামলাম সবাই। শহরটাকে তেমন ভাল লাগল না। অপরিষ্কার শহর। বাস থেকে নামলাম একেবারে হোটেলের সামনেই। হোটেলের নাম ছিল হোটেল স্বস্তিক। এই হোটেলের ২টা ইউনিট। একটা পুরাতন, আরেকটা নতুন। আমরা ৪জন আর সিটি ক্যাম্পাসের ফয়সাল, ইমন, আদনান আর মোর্শেদ নতুন হোটেলে উঠলাম। ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেতে গেলাম ইউনিট–১ এ। আমরা ৪জন ছাড়া অন্যরা সবাই উপস্থিত ছিল। নতুন খাবার খেতে ভালই লাগছিল। অন্যরকম স্বাদ। বাকী ভাই জানালেন একটু দূরে মহানন্দ পার্ক নামে একটি পার্ক আছে, এর কিছুদূর পর বিধান মার্কেট আর কসমস মার্কেট নামে দুইটা মার্কেট আছে। যেকেউ চাইলে যেন ঘুরে আসে। বাকী ভাই আর স্যারেরা যাবেন দিল্লীগামী ট্রেনের টিকেট করতে। তাই আমাদেরকে একা একাই ঘুরতে বলা হল।
দুপুরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ঘুরতে বের হলাম। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ সবকিছু মিলিয়ে রোমাঞ্চ খেলা করছিল মনে। আমরা ৪জন কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটলাম। এরপর মনে হল সিম তো কেনা হল না। ভারতে বড় এক সমস্যা এই সিম। আমাদের দেশে তো সিমের মেলাও হয়। সিম কিনতে গেলাম দাম দিল ২৫০ রুপি। উল্লেখ্য যে, মুহিত আর জুবায়ের ২০০ রুপি দিয়ে আইডিয়ার সিম কিনেছিল। আমরা ২০০ রুপি পর্যন্ত বললাম। কিন্তু দোকানদার তার দাম থেকে নড়ে না। আরো কয়েকটা দোকান ঘুরে দেখলাম। আইডিয়ার সিমের দাম হল ৮০ রুপি। কিন্তু এই সিম চালু হতে সময় লাগবে ৩ থেকে ৫দিন। কারণ ভারতে প্রি-অ্যাক্টিভ সিম বিক্রয় করা নিষেধ। আর যে দোকানদার ২৫০ রুপি দাম দিয়েছিল তার সিমগুলো আগে থেকেই অ্যাক্টিভ ছিল। তাই সে এত দামে সিম বিক্রি করছে। এমন অবস্থা দেখে আর সিমই কিনলাম না।
রাস্তা পার হয়ে বিধান মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বিধান মার্কেট দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এ তো আমাদের রিয়াজউদ্দিন মার্কেটের মতই। তবে আরো খারাপ অবস্থা। ঘাটের পয়সা খরচ করে যখন গেলামই তখন একটু ঘুরে দেখাটাকেই দায়িত্ব মনে হল। কিছুক্ষণ ঘুরে দেখার পর কসমস মার্কেট যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে এলাম। একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে বসে পেস্টি কেক খেলাম। এই কেক খেয়ে বুঝলাম বাংলাদেশের পেস্টি কেক অনেক মজা। ভারতীয় পেস্টি কেকের স্বাদ নেই বললেই চলে।
কসমস মার্কেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব এমন সময় দেখা হল সাইফুল্লাহ ভাই, মোশারফ, মুহিত ও জুবায়েরের সাথে। ভারতে লোকাল অটো ট্যাক্সিতে উঠতে লাইনে দাঁড়াতে হয়। কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর একটাতে আমরা ৮জন উঠলাম। মনে মনে শঙ্কিত ছিলাম এই ভেবে যে, কসমস মার্কেটের অবস্থা বিধান মার্কেটের চেয়ে খারাপ কিনা। ভাবতে ভাবতে চলে এলাম গন্তব্যে। নাহ, কসমস মার্কেট আর বিধান মার্কেটে অনেক ফারাক। শিলিগুড়ির বসুন্ধরা মার্কেট বলা যায়। অনেকক্ষণ ঘুরলাম এই মার্কেটে। আশ্চর্য হলাম ইলেক্ট্রিক্যাল জিনিসপত্রের দাম দেখে। ক্যামেরা, মোবাইল সবকিছুর দাম অনেক অনেক কম। কসমস মার্কেটের বাইরের দিকটা আড্ডা দেওয়ার জন্যে সুন্দর একটি জায়গা। অনেকক্ষণ বসে গল্প করছিলাম সবাই। হঠাৎ নকিব বলে উঠে আমার মোবাইল কোথায়? ভারতে গিয়ে প্রথমদিনেই মোবাইল হারালো নকিব। মোবাইল আর পাওয়া গেল না।
হোটেলে ফিরে যাওয়ার পথে একটা দোকান থেকে সিম কিনলাম। আগে থেকেই অ্যাক্টিভ করা ছিল বিধায় ২০০ রুপি দিয়েই কিনতে হল। সিম কিনে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরে গেলাম। রুমে না গিয়ে সরাসরি রেস্টুরেন্টে চলে গেলাম। ক্ষুধায় পেটের খুব করুণ অবস্থা। গিয়ে দেখি খাওয়ার টেবিলে সবাই মিটিং করছে। আমরা ৮জন ছাড়া অন্য সবার খাওয়া শেষ। রাতের খাবার খেতে খেতে কয়েকজনের কাছ থেকে মহানন্দ পার্কের গল্প শুনলাম। পার্কটা নাকি অনেক সুন্দর। আমার আফসোস হচ্ছিল কেন যে আমরা গেলাম না। আফসোস দিয়েই দিনটার সমাপ্তি ঘটল।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ৯:০৬