
বাউল গানে আছে, দেহ ঘড়ি চৌদ্দ তলা / তার ভেতরে দশটি নালা / নয়টি খোলা একটি বন্ধ / গোপন একটা তালা আছে....
দেহঘড়ির এ রহস্য নিয়ে শিল্পী থেকে শুরু করে ডাক্তার পর্যন্ত সবারই আগ্রহ রয়েছে। শরীর নিয়ে মানুষের এ আগ্রহ মেটানোর জন্যই বডিস রিভিল্ড প্রদর্শনীর আয়োজন। এ প্রদর্শনী মানব দেহের বেশ কিছু সম্ভার নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায়। প্রদর্শনী দেখে কৌতুল মেটায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে এ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা পর্যন্ত।
কয়দিন আগে এ প্রদর্শনী শুরু হলো বৃটেনের বার্মিংহামে। আমিও মানব দেহের দুর্লভ এ প্রদর্শনী দেখার জন্য বন্ধুদের নিয়ে প্রদর্শনীতে গিয়ে হাজির হলাম।
প্রদর্শনীর শুরুতেই আধো অন্ধকারের ভৌতিক পরিবেশে মানুষের কিছু কঙ্কাল রাখা ছিল। পরে বুঝলাম এ অংশটা মানুষের দেহের হাড্ডি-গুড্ডির ব্যাপারটা (skeletal system) দেখাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই আমি এ জিনিস দেখেছি। তাই তেমন ভয় পেলাম না।
অবশ্য তার পাশে কিছুদূর যেতেই অন্ধকারে স্পটলাইটের আলোয় চোখে পড়লো নিখুতভাবে চামড়া ছাড়ানো এক মানুষ দাড় করিয়ে রাখা আছে। মৃত লোকটার সারা দেহের মাংসগুলো স্পষ্ট। প্রতিটা পেশী অতি সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম…… লোকটার চোখ। মৃতদেহ সংরক্ষণের প্রক্রিয়াটা এরা এতোই নিখুতভাবে করেছে যে দেখে মনে হচ্ছে একেবারে টকটকে টাটকা মাংস দেখছি। লোকটার চোখগুলোও অতি জীবন্তভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। দূর থেকেই দেখলাম কিছুক্ষণ। কাছে গিয়ে দেখলে অনুভূতি কেমন হবে তা নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলাম। পরে আস্তে আস্তে কাছে গেলাম। না, যতোটা ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিলো, ততোটা নয়। অন্তত কাঁচা মাংসের কোনো গন্ধ নাকে আসলো না।

এদের মৃতদেহ সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়াটা নিঃসন্দেহে উন্নত মানের। প্রদর্শনীটাও মানুষের দেহের বিভিন্ন সিস্টেমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্য প্রদর্শনীটি নার্ভাস সিস্টেম, সার্কুলেটরি সিস্টেম, রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
প্রদর্শনীর এক অংশে মানব দেহের পেশীগুলোর (Muscular System) নানান ব্যাপার দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই পেশী দেখানোর জন্য দেহের চামড়াগুলো নিখুতভাবে তুলে ফেলা হয়েছে।

মানুষের নার্ভ পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির কম্পিউটারের চেয়েও দ্রুত। নার্ভাস সিস্টেমের প্রধান অংশ মানুষের মস্তিস্ক প্রতি সেকেন্ডে অসংখ্য তথ্য বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত তৈরি করে এবং অন্যান্য কাজ চালু রাখে। এ জিনিসগুলো দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে নার্ভাস সিস্টেমের অংশে। এখানে আরেকটা জিনিস বেশ অভিনব। মানুষের মস্তিস্ক খুব নিখুতভাবে কেটে ভাগ ভাগ করে রাখা হয়েছে। বার্নিশ করা কাঠের ফার্নিচারে যেমনভাবে কাঠের নকশাগুলো বোঝা যায় ঠিক সেভাবেই মস্তিস্ক মসৃন ভাবে কাটা হয়েছে। মস্তিস্কের ভেতরের প্রতিটা স্তর আলাদা আলাদা ভাবে দেখা যাচ্ছে।

মস্তিস্কের অংশ পার হয়ে গেলাম সার্কুলেটরি সিস্টেম দেখার জন্য। মানুষের সারা দেহে ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত পরিবহনের অসংখ্য নালী। এগুলোর উপস্থাপন দেখানো হয়েছে সার্কুলেটরি সিস্টেমে। মানুষের শরীরের রক্তনালীগুলোর উপস্থাপন নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। প্রদর্শনীর এক পাশে লেখা আছে, কিভাবে মৃতদেহের ভেতরে রাসায়নিক ঢুকিয়ে রক্ত পরিবহন তন্ত্রের অনুলিপি তৈরি করা হয়েছে।

শ্বাসতন্ত্রের প্রদর্শনীতে কয়েকটা ফুসফুস দেখে আগ্রহী হলাম। এখানে অনেকটা ধুমপান বিরোধী প্রচারণাও করা হচ্ছিলো। ক্যান্সারে মারা যাওয়া ধুমপায়ীর ফুসফুসের পাশাপাশি সুস্থ ফুসফুস রাখা ছিল। ধুমপায়ীর কালো রঙের ফুসফুস দেখে পার্থক্যটা সহজেই বোঝা যাচ্ছিলো। এখানে একটা কাচের বাক্স রাখা ছিলো। অনেক ধুমপায়ী এগুলো দেখে তাদের পকেটে থাকা সিগারেট, ম্যাচ, লাইটার ইত্যাদি পাশের কাচের বাক্সে ফেলে দিচ্ছিলেন।
রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম অংশে মানুষের শরীরের যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বংশবৃদ্ধির কাজে লাগে সেগুলো দেখানো হচ্ছিলো।

অনেক আগে দেখেছিলাম সম্ভবত ঢাকা চিড়িয়াখানার প্রাণী জাদুঘরে বিভিন্ন বয়সের মানুষের বাচ্চার ভ্রুন প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে। এখানেও তেমনটা দেখলাম। তবে এখানকার প্রদর্শনীর ঢং, লাইটিং তথ্য প্রদান ইত্যাদি সে তুলনায় আকর্ষণীয়।

সবকিছু দেখার পর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে না পারার দুঃখটা ভুলে গেলাম। প্রদর্শনীতে যাওয়ার পরেই দারোয়ান খুব গুরুত্বের সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছিল যে, ভেতরে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা যাবেনা। আমার কাছে বৃটেনে এটা একটা বেশ অভিনব ব্যাপার। বৃটিশ মিউজিয়ামেও ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে কোনো বারণ নেই। তাই প্রদর্শনীর ছবিগুলো ইন্টারনেট ঘেটে জোগাড় করতে হলো।

প্রদর্শনীটা শুধু কৌতুহল নিবারকই নয়, বেশ কিছু ডাক্তার ও মেডিকেল শিক্ষার্থীর ভিড় দেখে বুঝতে পারলাম এরা শেখার জন্যই প্রদর্শনীতে এসেছে। জানা গেল, এ প্রদর্শনীর জন্য মৃতদেহগুলো প্রধানত জোগাড় করা হয়েছে চীন থেকে। পরবর্তী কালে এ কোম্পানি মূলত চিকিৎসা গবেষণার জন্য সংগ্রীহিত মৃতদেহগুলো বিভিন্ন রাসায়নিক ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রদর্শনীর উপযোগী করে তৈরি করেছে।
স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এ প্রদর্শনী দেখায় কোনো বিধিনিষেধ আছে কিনা এটা নিয়ে আমি একটু চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু মজা পেলাম যখন শুনলাম, এ বিষয়ে কোনোই বিধিনিষেধ নেই। টিভি সাক্ষাৎকারে আয়োজকরা জানাচ্ছিলেন, স্কুলের বাচ্চারা নাকি এ প্রদর্শনী খুবই আগ্রহ নিয়ে দেখে। ভাবছিলাম, তাহলে আমি এতো বড়ো হয়েও এ প্রদর্শনী দেখতে ভয় পাচ্ছিলাম কেন?

