(নারীকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে একক ঈশ্বরের প্রবক্তারা-৩)
মূল কথা ছিল নারীপ্রধান বা মাতৃতান্ত্রিক একটা সমাজ যদি আদিকালে থেকে থাকে তবে সে সমাজে মাতৃমূর্তি বা নারী-ঈশ্বর বা দেবীদের উপাসনা হওয়ারই কথা। এখন আমরা একক ঈশ্বরের ধারণা পৃথিবীতে চালু হওয়া ও তার সাথে মহাদেবী বা নারী-ঈশ্বর পূজার বিরোধের সন্ধান করতে পারি।
বাইবেল ও কোরানে আদম-ইভের যে ঈশ্বরের গল্প আমরা পাই তার বয়স মানুষের চেয়ে অনেক কম। নবী মুহাম্মদকে আদমের ২৫ তম প্রজন্ম ধরে আদম ও তার সন্তানদের বয়সে উদার হাতে গ্রেস দিলেও আদমের স্বর্গপতনের ইতিহাস ৪৫০০ বছরের বেশি পুরনো বানানো যায় না। তবে ইসরাইল-আরবের এই ঈশ্বরের আগেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানবগোষ্ঠীর মধ্যে একক-পুরুষ-ঈশ্বরের যে গল্পকথা শোনা যায় তা প্রায় ১৪ হাজার বছরের পুরনো। অর্থাত্ আদমের ঈশ্বরের চেয়েও সে ঈশ্বর দশ হাজার বছর পুরনো।
কোনো সন্দেহ নেই, ঈশ্বরের ধারণা পৃথিবীর এক বিন্দুতে জন্ম হয়ে পরে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে নি। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আলাদা আলাদা করে তাদের ঈশ্বর কল্পনা করেছে। এতো বিজ্ঞানের সূত্র নয় যে সর্বত্র একই যোগফল হবে। ধর্ম বরং কলা বা মানবিক শাখার মত; বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন ভাবে ছবি আঁকবে বা কবিতা লিখবে, গল্প ফেনাবে। গোল বাঁধিয়েছেন কার্ল মার্কসের দেশি ফাদার উইলহেম স্মিদ। ১৯১২ সালে তিনি বই লিখলেন ‘দি অরিজিন অভ দি আইডিয়া অব গড‘। এতে তিনি তত্ত্ব দিলেন প্রিমিটিভ মনোথিইজমের। যার মোদ্দা কথা হচ্ছে পৃথিবীর সব অঞ্চলের সব আদিবাসীদের ধর্ম শুরু হয়েছে একজন আকাশ-ঈশ্বরের কল্পনা থেকেই। অন্যান্য দেব-দেবী যুক্ত হয়েছে পরে। যদিও স্মিদ, ক্যাথলিক ফাদার ছিলেন, যদিও তিনি বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করতেন না, যদিও তিনি ফ্রয়েডকে গাল-মন্দ করতেন, তবু্ও তার এই তত্ত্ব চার্চ পার হয়ে সমাজবিজ্ঞানের অনেক শাখায় স্থায়ীত্ব পেয়েছে।
http://en.wikipedia.org/wiki/Wilhelm_Schmidt
নৃতাত্ত্বিকরা অনেক আদিবাসী সমাজে গিয়ে দেখতে পেয়েছেন যে তারা দূরবর্তী এক আকাশ-ঈশ্বরের কথা বলে তবে সে ঈশ্বর মানুষের কোনো কাজে সাড়া দেয় না বলে তারা বিভিন্ন শক্তির দেব-দেবী মূর্তি পূজা করতে বাধ্য হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ বিবৃতদাতার তাদের এসব আকাশ-ঈশ্বরের যে বর্ণনা দেয় তাতে পুরুষালী বৈশিষ্ট প্রধান, সুতরাং আদিম ঈশ্বরের একটা পুরুষমত ধারণা আমরা পাই।
http://en.wikipedia.org/wiki/Plutarch
এর বিপরীতে আমরা নারী-ঈশ্বর, মহাদেবীর কিছু কাহিনীও পাই। কিন্তু পুরুষ-প্রধান সমাজ ব্যবস্থায় নারী-ঈশ্বরের কথা কেউ জোরালো কণ্ঠে বলে না। তবু্ও ১০০ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক ঐতিহাসিক প্লুটার্ক মহাদেবী ইসিস-কে চিহ্নিত করেন প্রকৃতির নারী উপাদান হিসেবে। প্লুটার্কের মৃত্যুর সময়কালে আরেক গ্রিক দার্শনিক এপুলিউস ‘দি গোল্ডেন এ্যাস‘ নামে এক বই লেখেন সেখানে দেখা যায় মহাদেবী ইসিস বলছেন:
‘আদিম ফ্রাইজিয়ানরা আমাকে ডাকতো পেসিনানটিকা, দেবতাদের মাতা; এথেন্সবাসী আমাকে ডাকে সেক্রোপিয়ান আর্টেমিস, সাইপ্রাস দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছে আমি পাফিয়ান আফ্রোদিতি, ক্রিটের শিকারীদের কাছে আমি ডিকটায়ানা, ত্রিভাষী সিসিলিয়ানদের কাছে প্রোসারপাইন। কেউ আমাকে চেনে জুনো নামে, কেউ চেনে বেলোনা নামে, কিন্তু ইথিওপিয়ানদের দুই গোত্র আর মিশরবাসী, যারা আদি বিদ্যায় বুত্পত্তি অর্জন করেছিল, ...তারা আমাকে ডাকে আমার আসল নামে, রাণী ইসিস।‘
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নারী-ঈশ্বর,মহাদেবী বা দেবীর পূর্ণাঙ্গ নামের তালিকার জন্য এই ওয়েবসাইটটিতে ঢুঁ মারতে পারেন:
http://www.mothergoddess.com/
অনেকেই অভিযোগ তোলেন, (এই ধারাবাহিক সম্পর্কে মন্তব্যতে সম্ভবত: যূথচারী বলেছিলেন) কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খননেই নারী-ঈশ্বর বা মহাদেবীর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কথাটা অসত্য এবং ভুল তত্ত্বের কারণে বিভ্রান্তিতে সৃষ্ট মতবাদ। প্যালিওলিথিক যুগের খনন কাজে শুধু ইউরোপের ৩ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে প্রায় ১ হাজার নারী মূর্তি বা ছবির সন্ধান পাওয়া গেছে। যেগুলোর কিছু কিছু ২৭,০০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের।
http://en.wikipedia.org/wiki/Marija_Gimbutas
সমস্যা হচ্ছে এসব নারী-মূর্তি বা ছবির ব্যাখ্যায়। কেউ ব্যাখ্যা দিয়েছেন এগুলো কোনো বিশেষ নারীর প্রতিকৃতি, কোনো প্রাচীন সুন্দরী রমণীর ভাষ্কর্য, অথবা গ্রাগৈতিহাসিক পর্ণোগ্রাফি বা ইরোটিকা। আজ থেকে ৩০ হাজার বছর আগের মানুষ ইরোটিকার জন্য নারী-মূর্তি বানাতো এ শুধু পুরুষ প্রত্নতাত্ত্বিকদের পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব। এখানেই প্রমাণ, শুধু ধর্ম নয়, বিজ্ঞানও নারীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, যেহেতু কিছু পুরুষরা এর নেতৃত্বে ছিল বলে। মাত্র বিংশ শতাব্দীতে এসে প্রত্নতাত্ত্বিক মারিয়া গিমবুতাস (১৯২১-১৯৯৪) ব্যাখ্যা দিলেন যে এসব মূর্তি হচ্ছে মিথোলজিক্যাল চরিত্র এবং বিভিন্ন ঋতুতে বা বিভিন্ন মিথকে পুনরানুষ্ঠান করার আশায় এসব মূর্তি ব্যবহৃত হতো। মারিয়া প্রথম ব্যাখ্যা দেন যে, প্রাচীন ইউরোপ ছিল নারী-ঈশ্বর/মহাদেবী কেন্দ্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক। অন্যদিকে ব্রোঞ্জ যুগের ইন্দো-ইউরোপিয়ান সমাজের সংস্কৃতি ছিল পিতৃতান্ত্রিক।বলাবাহুল্য, তার ব্যাখ্যা অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কিন্তু মারিয়া মানুষের ইতিহাসে নারী ও নারী-ঈশ্বরের নতুন অবস্থান তৈরি করে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
এখন অনেকেই মনে করেন যে, এসব নারী-মূর্তির সাথে জমির উর্বরতা প্রার্থনা, নারী দেবীদের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা, ঋতু-উপাসনা এবং মহাদেবী পূজার যোগসূত্র রয়েছে।
নারী-ঈশ্বরকে মাটিচাপা দেয়ার জন্য শুধু পুরোহিতরা নয় প্রত্নতাত্ত্বিকরাও দায়ী
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
১৯৭২-এর স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ২০২৪-এর অর্জন না
৭২-এর রক্তস্নাত সংবিধান বাতিল করে । নিজেদের আদর্শের সংবিধান রচনা করতে চায় এরা‼️বাংলাদেশের পতাকা বদলে দিতে চায়! বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ভালো লাগেনা এদের!জাতিয় শ্লোগানে গায়ে ফোস্কা পরা প্রজন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে.....
প্রতিযোগিতার এই দুনিয়ায় এখন আর কেউ নিজের মতো হতে চাই না, হতে চাই বিশ্ববরেণ্যদের মতো। শিশুকাল থেকেই শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সব ছাত্রদের মাথায় জিপিএ ৫, গোল্ডেন পেতে হবে! সবাইকেই ডাক্তার,... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। এইচএমপিভি
করোনা মহামারির ৫ বছরের মাথায় নতুন একটি ভাইরাসের উত্থান ঘটেছে চীনে। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি নামের নতুন এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে দেশটিতে।চীনের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
পাকিস্তান, আমেরিকা, জামাত-শিবির আমাদেরকে "ব্যর্থ জাতিতে" পরিণত করেছে।
আজকে সময় হয়েছে, আমেরিকান দুতাবাসের সামনে গিয়ে বলার, "তোরা চলে যা, ট্রাম্পের অধীনে ভালো থাক, আমরা যেভাবে পারি নিজের দেশ নিজেরা গড়বো। চলে যাবার আগে তোদের পাকী... ...বাকিটুকু পড়ুন
=হয়তো কখনো আমরা প্রেমে পড়বো=
পোস্ট দিছি ২২/১২/২১
©কাজী ফাতেমা ছবি
কোন এক সময় হয়তো প্রেমে পড়বো আমরা
তখন সময় আমাদের নিয়ে যাবে বুড়ো বেলা,
শরীরের জোর হারিয়ে একে অন্যের প্রেমে না পড়েই বা কী;
তখন সময় আমাদের শেখাবে বিষণ্ণতার... ...বাকিটুকু পড়ুন