মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কমপক্ষে ২৫৩ ব্র্যান্ডের ওষুধে সয়লাব সারা দেশের বাজার। কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় নির্বিঘ্নে বিক্রি হচ্ছে ছয়টি জেনেরিক নামের এসব ওষুধ। ক্যান্সার ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখায় সাত বছর আগেই ওষুধগুলো নিষিদ্ধ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।
ওষুধগুলোর ক্ষতিকর দিক নিশ্চিত হওয়ার পরও বছরের পর বছর নির্বিকার ছিল কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে দেদারসে এগুলো বিক্রি করেছে ওষুধ কোম্পানির মালিকরা। কিন্তু দেশের বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে ছিলেন সোচ্চার। বিভিন্ন সময়ে ওষুধগুলোর নেতিবাচক দিক তুলে ধরেছেন। মূলত তাদের চাপেই সম্প্রতি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের ‘এডভারস ড্রাগ রিঅ্যাকশন অ্যাডভাইজরি মনিটরিং (এডিআরএম)’ কমিটি ওষুধগুলোর উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে। এ অবস্থায় বুধবার এসব ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে অনুমোদন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। ওষুধগুলোর জেনেরিক নাম হচ্ছে- রোসিগ্লিটাজন, পাইওগ্লিটাজন, সিবুট্রামিন, টেগাসেরড, গ্যাটিফ্লুক্সাসিন এবং ফ্লুপেনথিক্সল-মেলিট্রাসেন।
এসব ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন টিকিয়ে রাখতে জোর তদবির শুরু করেছেন ওষুধ শিল্প মালিকরা। এমন পরিস্থিতিতে তীব্র চাপের মুখে পড়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। এসব কোম্পানির কাছে এমন পরিমাণ কাঁচামাল রয়েছে যে, দেশে এসব ওষুধের চাহিদা অনুযায়ী আরও কয়েক বছর বাজারজাত করতে পারবে। এক্ষেত্রে মানবদেহের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা না করে, মুনাফার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে ওষুধ কোম্পানি। এগুলো নিষিদ্ধের বিষয়ে ‘ধীরে চলো নীতি’ অনুসরণ করছে সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর, ফার্মাকোলজি বিশেষজ্ঞ ও জেনারেল প্র্যাকটিশনার, ওষুধ সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নাল এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব এমএম নিয়াজ উদ্দিন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলে এসব ওষুধের নিবন্ধন অবশ্যই বাতিলযোগ্য। আমি কাগজপত্র খতিয়ে দেখে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
এছাড়া ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন মল্লিক বলেন, ‘ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’ এর বেশি আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জার্নাল থেকে জানা গেছে, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উল্লিখিত ছয় জেনেরিক নামের ওষুধের মধ্যে কোনোটি হৃদরোগ, কোনোটি পায়ুপথ ও মূত্রথলির ক্যান্সার আবার কোনোটি ডায়াবেটিক রোগীর ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণহীন করে দেয়। এছাড়া এসব ওষুধের কোনোটি অন্ত্রনালীর সমস্যা সৃষ্টি ও রক্ত কণিকা দ্রুত ভেঙে দেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সব ওষুধেরই কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তবে যেগুলো বেশি ক্ষতিকর হিসেবে প্রমাণিত, সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ধরনের অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ বাংলাদেশে আছে। ঝুঁকিপূর্ণ এই ৬ ধরনের ওষুধের ব্যাপারে উন্নত বিশ্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরও ৫-৭ বছর আগে। আমরা পিছিয়ে আছি। এই ৬টির ব্যাপারে পদক্ষেপ ‘আই ওপেনার’ হিসেবে কাজ করবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোসিগ্লিটাজন জেনেরিকে ৪০টি ব্র্যান্ড, পাইওগ্লিটাজন জেনেরিকে ৮৭টি, সিবুট্রামিন জেনেরিকে ৮টি, গ্যাটিফ্লুক্সাসিন জেনেরিকে ৪০টি, টেগাসেরড জেনেরিকে ১২টি এবং ফ্লুপেনথিক্সল-মেলিট্রাসেন সমন্বিত (কম্বিনেশন) জেনেরিকে ৬৬টি ব্র্যান্ড নামে উৎপাদন-বিপণনের অনুমোদন আছে। বাজারে এসব ওষুধ পাওয়া যায়। চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন।
অধিদফতর সূত্র বলছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটির পরবর্তী বৈঠকে এসব ওষুধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রসঙ্গটি তোলা হবে। তবে এই কমিটির বৈঠক কবে অনুষ্ঠিত হবে, সেটি নিশ্চিত করেননি সংশ্লিষ্ট কেউ। বুধবার অধিদফতর সূত্র যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে, বিতর্কিত ৬টি জেনেরিক আইটেমের কাঁচামাল আমদানির অনুমতি না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধিদফতরের এ সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি।
এডিআরএম কমিটির সুপারিশের বিষয়ে ঔষধ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে ওষুধগুলোর উৎপাদন, বিপণনের অনুমোদন এবং সর্বোপরি এই আইটেমগুলোর নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। তবে বাজারে থাকা ওষুধগুলো প্রত্যাহারের ব্যাপারে কোনো সুপারিশ করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৮২ সালে ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স জারির সময় জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত ১ হাজার ৭০৭ আইটেম একসঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এরপর থেকে গত ৩২ বছরে দুয়েকটি আইটেম ছাড়া এমন নজির আর নেই।
বিপণন ও ক্ষতিকর দিক : রাজধানীর শাহবাগ ও গ্রিনরোডসহ বিভিন্ন ওষুধ মার্কেটে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলো এই ছয় জেনেরিক নামের ওষুধ উৎপাদন বেশি করে থাকে। অনেকক্ষেত্রে অন্য আরেকটি জেনেরিকের কম্বিনেশন (সমন্বয়) করে ওষুধগুলো বাজারজাত করা হয়েছে। চিকিৎসকরা শীর্ষ কোম্পানির ওষুধ লিখেন। গ্রাহকরা স্বভাবতই প্রথম সারির কোম্পানির ওষুধ সেবনে উৎসাহ বোধ করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোসিগ্লিটাজন ও পাইওগ্লিটাজন জেনেরিক নামের ওষুধগুলো ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। এর মধ্যে রোসিগ্লিটাজন জেনেরিকে স্কয়ার ফার্মার ব্র্যান্ড নাম রেজোলিন, জেনারেল ফার্মার রসিগ্লিট, এরিস্টোফার্মা গ্লুকোরস, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল রোমেরল এবং প্যাসিফিক ফার্মাসিউটিক্যালস রগ্লিট ব্র্যান্ড নামে ওষুধটি বাজারজাত করেছে।
আর পাইওগ্লিটাজন জেনেরিকে বেক্সিমকো ফার্মা ডায়গ্লিট নামে, ইনসেপটা ফার্মা পাইওডার নামে, স্কয়ার ফার্মা টিওএস, প্যাসিফিক ফার্মাসিউটিক্যালস পাইগ্লিট নামে ওষুধটি বাজারজাত করেছে। মঙ্গল ও বুধবার রাজধানীর মিটফোর্ড ওষুধ মার্কেট ও শাহবাগ মার্কেটে বিক্রেতারা জানিয়েছেন, পাইওগ্লিটাজন ওষুধের বিক্রি বেশি।
রোসিগ্লিটাজন ও পাইওগ্লিটাজন সম্পর্কে ইন্টারনেটে প্রদত্ত তথ্যে বলা হয়েছে, এই ওষুধগুলো হৃদরোগ, কোলন ক্যান্সার, মূত্রথলির ক্যান্সারের জন্য দায়ী। ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) ২০১০ সালে এই গোত্রের ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে। ফলে উন্নত বিশ্বে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয় না। প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাংলাদেশে ওষুধটি বিপণন শুরু হয়েছে ৫-৭ বছর আগে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান যুগান্তরকে বলেন, ওষুধগুলো ঠিক কত শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষতি করছে, সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। আন্তর্জাতিকভাবে রোসিগ্লিটাজন, পাইওগ্লিটাজন গোত্রের ওষুধ সেবনে হৃদরোগের ঝুঁকির তথ্য আমরা শুনছি। সমস্যা চিহ্নিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)সহ অনেক দেশ ওষুধগুলো নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের দেশে করলেও সমস্যা হবে না। কারণ ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিকল্প ওষুধের ব্যবস্থা আছে।
সিবুট্রামিন জেনেরিকের ওষুধ অত্যধিক মোটা হওয়া (ওবেসিটি) নিয়ন্ত্রণে রাখে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে ৮টি ব্র্যান্ডের অনুমোদন আছে। এর মধ্যে জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালস উৎপাদন করে ৩টি। ঔষধ প্রশাসনের এডিআরএম কমিটির বৈঠকে সিবুট্রামিন ওষুধের ক্ষতিকর দিক হিসেবে হৃদরোগের কথা বলা হয়েছে। গ্যাটিফ্লুক্সাসিন জেনেরিকের প্রায় ৪০টি ব্র্যান্ড ওষুধের অনুমোদন আছে দেশে। এটি একটি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। ফার্মাকোলজি ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই অ্যান্টিবায়োটিক সেবনকালে ডায়াবেটিক রোগীর ব্লাড সুগার অনিয়ন্ত্রিত হয়। স্কয়ার ফার্মা ‘গ্যাটি’ এবং ইনসেপটা ফার্মা ‘গ্যাটিফ্লক্স’ ব্র্যান্ড নামে ওষুধটি বাজারজাত করছে।
টেগাসেরড জেনেরিকে ১২টি ব্র্যান্ডের অনুমোদন আছে। শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির ওষুধের মধ্যে রয়েছে- টেসোড, বাওডিন, সেরোড, ডোরেসা ইত্যাদি। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে স্কয়ার ফার্মা, জেনারেল ফার্মা, এরিস্টোফার্মা এবং ইনসেপটা ফার্মা।
ফ্লুপেনথিক্সল-মেলিট্রাসেন সমন্বিত জেনেরিকে ৬৬টি ব্র্যান্ড বাজারে আছে। এর মধ্যে ফ্লুপেনথিক্সল এককভাবে আছে ১১টি ব্র্যান্ডে। ওষুধ প্রযুক্তিবিদ ও পাইকার-খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ওষুধটি বাংলাদেশে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কয়েকটি সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে, বিতর্কিত জেনেরিকের মধ্যে এই আইটেমের বাজার সবচেয়ে বড়। এ কারণে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের সুপারিশ থেকে এই আইটেম বাদ দিতে ওষুধ শিল্প মালিকরা ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ওষুধটি সম্পর্কে জানা গেছে, ঘুম কম হওয়া, বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তা দূর করতে জেনারেল প্র্যাকটিশনাররা ফ্লুপেনথিক্সল-মেলিট্রাসেন জেনেরিকের ওষুধ নির্বিচারে লেখেন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের বিশেষজ্ঞরা জানান, এককভাবে ফ্লুপেনথিক্সল মনস্তাত্ত্বিক রোগের চিকিৎসায় কার্যকর। জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের এ ব্যাপারে জানাশোনার ঘাটতি আছে। এই গোত্রের ওষুধ সম্পর্কে ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্যে বলা হয়েছে, এই গোত্রের ওষুধ হৃদযন্ত্রে সমস্যা তৈরি করে, ব্লাড সেল কমায়। অস্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় ওষুধটি নিষিদ্ধ।
দৈনিক যুগান্তর ...........
বদরুদ্দোজা সুমন
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল, ২০১৪