বছরটা ২০১৩। ফেসবুকে’র কোন একটা গ্রুপে ছোট একটা পোস্ট দেখে লাইক দিলাম ‘মজার স্কুল’ নামক একটা পেইজে। গিয়ে দেখি একেবারে নতুন বলা যায় আঁতুড়ঘরের ছোট শিশুটি। উদ্যোক্তা আরিফ, সাহাবুদ্দিন, সাহাবুদ্দিন–এর স্ত্রী এবং এমনই আরও কয়েকটি উদ্যমী তরুণ ছেলেপেলে। আঁতুড়ঘরের সংগঠন হলেও ওদের স্বপ্ন বেশ বড়! এই শহরের সুবিধা বঞ্চিত অগণিত পথ শিশুদের জন্য কিছু করতে চায় ওরা। অন্তত সপ্তাহের দুই/তিনটা ওদের বঞ্চিত জীবনে একটু আনন্দ ভরে দিতে চায় ওরা!
তখন অনলাইনে টুকটাক চ্যারিটি করি আমি। অনলাইনে বিশাল আড্ডার জগতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পক্ষে সমাজসেবার কাজ করি। তো এক ঝড়ের দিনে রেসকোর্স গেলাম ওদের সাথে দেখা করতে। খোলা মাঠে মাদুর পেতে ছোট বাচ্চাদের’কে অ, আ শেখাচ্ছে ওরা। পড়া শুরুর আগে সাবান শ্যাম্পু দেয়া হল ওদের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে। পড়া শেষে পেট ভরে সেই বেলার খাবার। এই ছিল ‘মজার স্কুলের’ প্রাথমিক কার্যক্রম।
আরিয়ান বলল, আপু সময় দেন ১দিন করে। রাজি হয়ে গেলাম। সপ্তাহে ১দিন করে ওদের সময় দিই। এদিকে অনলাইন বন্ধুদের ওদের কথা জানাই। কেউ-কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, কেউবা সেবা দিতে। এভাবেই আগাতে থাকে মজার স্কুল। সাহাবুদ্দিন আর তার স্ত্রী পারিবারিক সমস্যার কারনে বিদায় নেন। তারপর একসময় আমারও সময় আসে, প্রত্যক্ষ সেবা দেয়ার কাজ থেকে বিদায় নিতে হয় আমাকে। ক্লাসে যাইনা কিন্তু ওদের সাথে যোগাযোগ রাখি নিয়মিত। টাকা-পয়সার বেশীর ভাগটাই আমরা অনলাইনের কিছু ভাই-বোন মিলে তুলে দিতে থাকি। ধীরে-ধীরে আঁতুড়ঘর থেকে বের হয়ে ‘মজার স্কুল’ বড় হতে থাকে। আমি ব্যক্তিগত কাজে, পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকি ওদের সময় দিতে পারিনা! কিন্তু সময় পেলেই যোগাযোগ করি, সুযোগ পেলে টাকা জোগাড় করে দিতে থাকি। আরিফ বলে আপু দেখা করে যান। আমি সময় পাইনা...।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, অনলাইন/অফলাইন থেকে ২০ সদস্যের দল গঠন করে মাসে ২০০ টাকা চাঁদা ধার্য করা হয়। যে চাঁদা দিয়ে শিশুদের সারা মাসের আটদিন(সপ্তাহে দুইটা ক্লাস) খরচ চালানোর ব্যবস্থা করা হয়। পরে তো নির্দিষ্ট অর্থ যোগান-দাতা আমরাই ঠিক করে দিয়েছিলাম। যাই হোক, অগণিত সুবিধা-বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে ওরা বেশ সুন্দর এগিয়ে চলছিল। বাচ্চাদের জন্য জামা, ব্যাগ, বই-খাতা, রঙ পেন্সিল ইত্যাদি দেয়া হয়। এরপর নানা উৎসবে বাচ্চাদের খাওয়ানো, জামা-কাপড় দেয়া, ঘুরতে নেয়া এসব তো ছিলই। তারপর হঠাৎ গত বছর জানতে পাই, মতের মিল না হওয়ায় সাংগঠনিক বেশ কিছু সদস্য সংগঠন ছেড়ে দিয়েছে। আমিও ব্যক্তিগত বিষয়ে এতোই ব্যস্ত যে খবর নেয়ারও সুযোগ ছিলোনা! কিন্তু গত সপ্তাহে ফেসবুকে ওদের নিয়ে হইচই দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছি!
কমলাপুর থেকে শুরু করে আগারগাঁও পর্যন্ত অগণিত সুবিধা-বঞ্চিত পথ শিশুরা জাকিয়া এবং আরিফ’কে ভালো করেই চিনবে বলে আমার বিশ্বাস। গত বছর চাঁদার টাকা বিষয়ে বেশ কিছু কথা শুনেছি। সেবার হতে পারে চাঁদার কিছু টাকা ওরা নিজের জন্য খরচ করেই ফেলেছে। কিন্তু তাই বলে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিনা যে ওরা শিশু-পাচারকারী! কারন ওরা যা পেরেছে আমি সেটা পারিনি! ওরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচলিত না হয়ে এইসব শিশুদের ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে চেয়েছে।
আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কি করে এমন ন্যাক্কারজনক একটা কাজ করে? ওদের দেখে আর কি কেউ কোন সুবিধা বঞ্চিতের জন্য কাজ করতে এগিয়ে আসবে? আর মিডিয়ার কথা কি বলবো? সঠিক কিছু না জেনে-শুনে-দেখে এবং বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই এই তরুণদের’কে এক মুহূর্তে শিশু পাচারকারী বানিয়ে দেয়া মিডিয়া গুলো’কে নিয়ন্ত্রণ করা যে অতি গুরুত্বপূর্ণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা! আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যেন দ্রুত তদন্ত শেষ করে এবং যথাসম্মানে ওদের মুক্ত করবার ব্যবস্থা করে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৪৮