'গ্রামের খুব সাধারন গৃহস্থ পরিবারের অতি সাধারন গৃহিণী আমিনা বেগম। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া; বছর-বছর সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে চির রুগ্ন হয়ে যাওয়া আমিনা বেগম। স্বামীর সংসারে কষ্ট বলতে ভাত-কাপড়ের অভাব ছিলনা কখনও বরং সব মিলিয়ে সচ্ছলই ছিল তাঁর সংসার। যুবতী বয়সে দু'হাতে দশজনের কাজ করছেনে। বিধবা শাশুড়িকে আদরে-যত্নে-সম্মানে আগলে রেখেছেন। সুখে-দুঃখে জা-ভাসুর-ননদ-নন্দাই-ভাইয়ে-বোনে মিলে মিশে থাকবার চেষ্টা করেছেন। পারলে কাউকে সাহায্য করেছেন, না পারলে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। তবু এই শেষ বয়সে এসে প্রায়ই তাঁর কোন হিসাবই যেন আর মিলতে চায় না!
ছেলেদের দায়িত্বে এসে আজ তাঁকে আর তাঁর স্বামীকে পদে-পদে অপমান-অপদস্থ হতে হয়! জায়গা-জমি নিয়ে রাগ অভিমান করে ছোট ছেলেটা কথা বলেনা। ছেলের বউ অবশ্য মাঝে-মধ্যে ফোন করে এটা-সেটা খবর নেয়, সাথে আবার দশ কথা শোনাতে বাদ রাখেনা! তাঁদের খবর নেবার থেকে এই কথা শোনানোতেই যেন বউয়ের বেশি আগ্রহ! সেদিনও প্রতিবারের মতোই ছেলের বউকে বললেন ছেলেকে যেন বলে একবার ফোন করতে, কতোদিন ছেলেটার সাথে কথা হয়না! আর অমনি ছেলের বউয়ের উত্তর-বড় ছেলেকে ভালো জায়গাটা দেয়ার সময় এতো আদর কোথায় ছিল আপনার? এখন এতো আদর দেখানোর কি দরকার...?
আমিনা বেগম ভেবে পান না ছেলের বউকে কি উত্তর দেবেন? কোন মাকে নিজের পেটের ছেলেকে আদর দেখানোর প্রশ্ন আসলে তার পক্ষে জবাব দেয়া কি আদৌ সম্ভব? তাই আজ আমিনা বেগমের কতো কথাই যে মনে পড়ে যায়...কয়েকটা সন্তান মৃত জন্মাবার পর আর কয়েকটা জন্মে কিছু বড় হয়ে মরে যাবার পর এই ছেলেটাকে নিয়ে আমিনা বেগমের কতো কষ্ট গেছে! ছেলে ছোট থাকতে আমিনা বেগম কঠিন অসুখে পড়েন। সেই ছেলে আবার একটু বড় হবার পর এতো দুষ্ট হয়েছে যে, আজ তার পা ভাঙ্গে তো কাল তার হাত মচকে যায়! এই ছাড়াও রাজ্যের যতো দুর্বুদ্ধি আর দুষ্টামিতে ওস্তাদ ছিল সে। তবু আমিনা বেগমের চোখের মনি এই ছোট ছেলে। আরও একটু বড় হবার পর ছেলেও যেন মার আঁচল ছাড়তে চায় না! মার আঁচল ধরে মার এটা-সেটা কাজে সাহায্য করেই কাটে তার সারাবেলা! তারপর একদিন ছেলে-মেয়েরা সবাই বড় হল নিজ-নিজ পছন্দে বিয়েও করলো; ছোটটির ক্ষেত্রেও আর ব্যতিক্রম হয়নি। আমিনা বেগম মনে করেন-তা করুক ওরা নিজের পছন্দে বিয়ে, সংসার তো ওরাই করবে!
আজ ছেলে-মেয়েরা সবাই নিজ-নিজ সংসারে ব্যস্ত। এতোবড় বাড়ি-ঘর নিয়ে আমিনা বেগম আর তাঁর স্বামী এখন একলা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রোগে-শোকে একলাই কাটান! সন্তানেরা কেউই তেমন সময়-সুযোগ পায়না বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখবার! অশিক্ষিত গ্রাম্য আমিনা বেগম আর তার স্বামীর ছেলে-বউ মেয়ে-জামাই সবাই দারুণ শিক্ষিত বলে হয়তো গ্রামের ধারও ধারেনা! তাছাড়া জায়গা-জমির ভাগ-বাঁটোয়ারা টাকা-পয়সার হিসাব নিকাশ নিয়ে ওদের কারো সাথে কারো বনিবনা নেই! ছেলেরা বাবা-মার খরচ দেবার আগে অন্যজন কতো দিলো সেই খবর নিয়ে তবে নিজেরটা পাঠায় কিংবা পাঠায় না! আর সেইসব কিছুকে কেন্দ্র করে ছেলের বউদের এমন অপমানজনক কথা-বার্তা এখন সাধারন ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেছে! আমিনা বেগম এখন আর হয়তো কষ্টও পান না। তবু মাঝে-মধ্যেই ভাবেন, সংসার তো তারাও করেছেন। তাদেরও স্বামীরা ভাই-ভাই জায়গা-জমি ভাগ-বাঁটোয়ারা করেই আলাদা হাঁড়িতে সংসার পেতেছেন। শাশুড়ি যেভাবে বলেছেন ছেলেরা সেভাবে ভাগ মেনেছেন। কেউ কম-বেশি পেলেও ছেলের বউরা কেউ অপমানজনক কথা দূরে থাক এতোটুকু উচ্চবাচ্য কেউ করেন নি! কই তাদের তো এমন হয়নি? তাদের স্বামীরা তাদের ভাত কাপড় দিতে যেমন কার্পণ্য করেন নি আবার মায়ের প্রতি ভাইয়ের প্রতি দায়িত্বেও তারা কখনও অবহেলা করেন নি।
এতো জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে মানুষের তবে এমন হল কেন অতোটুকু ভাবার জ্ঞান আমিনা বেগমের নেই। তিনি শুধু ভাবেন পেটের ছেলে কেন এমন হয়, দোষটা কার? তাঁর? তাঁর স্বামীর? তাঁদের ভাগ্যের? এই সময়ের? এক গর্ভ থেকে পৃথিবীতে এসে, এক ছাদের তলায় থেকে, এক থালায় ভাত খেয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে, ভাইয়ে-বোনে কেন এমন হয়? কটা টাকা, ক'বিঘা জমি কম-বেশি, ভালো-মন্দ হবার কারনেই কেন এমন হয়?'
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:২৩