হুট করে ঘটনাটা ঘটে যাবে ভাবতেই পারেনি সিয়াম।
আজ থেকে ঠিক ন’দিন আগে পা পড়েছে এই শহরের মানচিত্রে। শহরে নতুন, তাই বলে অপরিচিত নয় শহরটা।
কতদিন থাকতে হবে সেটা অনিশ্চিত। নতুন চাকরির স্বাধ পেতেই, নোঙর ফেলেছে স্থানীয় একটি মেসে।
অফিস শেষে প্রতিদিন ঘোরা একটা রুটিনে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রথমে যায় নদীর ধারে তারপর পার্কে।
পার্কে যাওয়ার আলাদা একটা কারণ আছে।
প্রথম যেদিন, সে পার্কের গেট ক্রস করতে যাচ্ছিল তখন দেখেছিল এক অপ্সরীকে এগিয়ে আসতে। যার চলার ছন্দ ছিল রাজহংসীর মত। প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল, সুন্দরীর রূপে গোধুলীর সুর্যটাও যেন; লজ্জ্বায় লাল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে পশ্চিমাকাশে। সিয়ামের জীবনে এই প্রথম, কোন মেয়েকে দেখে মনের ভিতর ইমনের সুর বেজে উঠেছিল।
কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করেছে মেয়েটি পার্কের পুরো এলাকা ৫ বার ঘুরে এসে দোলনায় দোল খায়। তবে একটা বিষয়; যা সিয়ামকে কৌতুহলী করেছে, অন্যসব দোলনা ফাঁকা থাকলেও নির্দিষ্ট দোলনাতেই আসে প্রতিদিন। তাই সিয়াম ইচ্ছা করেই আগে থেকে দোলনাটা দখল করে আছে।
মেয়েটি এসেছে কিন্তু কিছু বলছে না, একটু পরপর ঘড়ি দেখছে। এদিক সেদিক পায়চারি করছে আর ফিরে আসছে। অবশেষে মেয়েটি বলেই ফেললো, ভাইয়া পাঁচ মিনিটের জন্য কি দোলনাটা ছেড়ে দেয়া যায়? শুধু পাঁচ মিনিট।
মেয়েটির কন্ঠ, বলার ভঙ্গি এবং উচ্চারণ এত চমৎকার যে মুগ্ধ হয়ে কোন কথা না বলেই দোলনাটা ছেড়ে দিল। দোলনা পেয়ে মেয়েটি খুব সুন্দর করে ধন্যবাদ জানালো। সিয়ামও স্বাগত জানালো কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকা শোভন নয় ভেবে, একটু দুরে চলে গেল।
এদিক সেদিক ঘুরে যখন দোলনার কাছে আসছে, তখন দুর থেকেই দেখে মেয়েটির সাথে কিছু ছেলের তর্কাতর্কি হচ্ছে। মনের মধ্যে একটা হিরো ভাব নিয়ে দ্রুতপায়ে মেয়েটির কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? মেয়েটি বললো এই চারজন খুব বিরক্ত করছে।
সিয়াম বলে ঠিক আছে আপনি যান, আমি দেখছি। মেয়েটি ইতস্ততঃভাবে আড়াল হতেই সিয়াম কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই শুরু হলো তার উপর বর্ষণ। হাত-পা দিয়ে মারার পাশাপাশি পড়ে থাকা ইট দিয়ে মুখে ও মাথায় আঘাত করেছে। এত মার সিয়াম তার বাপের জীবনে খায়নি। মেয়েটি আড়াল হলেও পরবর্তী ঘটনা দেখার জন্য পিছন ফিরে তাকিয়েছিল। দেখলো চারজন মিলে একজনকে মারছে। মেয়েটি আশেপাশের লোকজনকে ডাকতে ডাকতে সিয়ামের পাশে চলে আসে কিন্তু ততক্ষণে সিয়াম অজ্ঞান। আর চারজন পার্কের প্রাচীর টপকে ওপারে পালিয়ে যায়।
এখনও দিনের আলো ফোটেনি। সূর্যিমামার হয়তো এখনো নাওয়া খাওয়া হয়নি। কিন্তু সিয়ামের যে সময় যাচ্ছে না!! তার উপর সারা শরীর ব্যথা। মাথাটা থেকে থেকেই প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। তখন আর তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না, কিছু ভাবতেও ভাল লাগছে না। বিষয়টা লক্ষ্য করেছে এখন থেকে ৩ ঘন্টা আগে, দ্বিতীয়বার জ্ঞান ফিরার পর থেকে।
সরকারি হাসপাতালে সারিবদ্ধ সাদা বেড। গতরাতে রোগী বেশী থাকায় তার জায়গা হয়েছে ফ্লোরে। সিয়ামের অফিস কলিগরা ইউ সেপে দাঁড়িয়ে আছে বেডের সামনে। মুখসহ মাথা ব্যান্ডেজ থাকায় কথা বলতে পারছে না। শুধু ঈশারাতেই যেটুকু চালানো যায়।
চুপচাপ থাকার কারণে একটা বিষয় লক্ষ্য করলো, কলিগরা সিয়ামকে দেখতে এসেছে কিন্তু গল্পটা সিয়ামকে নিয়ে নয়, গল্প চলছে অফিসের কোন ফাইলে কত......। এই ক’দিনের পরিচয়ে, এর চেয়ে বেশী আর কিইবা আশা করা যায়! সবাই অপেক্ষা করছে বাড়ীর লোক কখন আসবে।
বাড়ীর লোক খবর পেলে তো আসবে, কেউ কি খবর দিয়েছে ? নিজের মনেই বিড়বিড় করে সিয়াম। এমন সময় ইউ সেপের পেট ফুটো করে বেরিয়ে এলো গতকালের অপ্সরী।
স্যরি জানিয়ে, নিজের নাম বললো আদ্রিতা, জিজ্ঞেস করলো, কেমন লাগছে ? গতরাতে উপস্থিত লোকজনের সাহায্য নিয়ে সিয়ামকে হাসপাতালে ভর্তি করে বাসায় যেতে হয়েছিল আদ্রিতাকে।
রিপোর্ট পেপার দেখে দ্রুত বের হয়ে গেল আদ্রিতা এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে কলিগদের একজন কে বললো একটা বেড ম্যানেজ করতে পেরেছি আপনারা ওখানে নিয়ে যান আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি।
মুহুর্তের মধ্যেই যেন সিয়ামের চারপাশের অবস্থা চেঞ্জ হতে লাগলো। এখন কলিগদের মনে একটাই প্রশ্ন মেয়েটি কে ? সিয়ামকে জিজ্ঞেস করে, সে ঈশারায় বলে জানি না। এমন সময় দেখতে পায় আদ্রিতা আসছে, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় মুখের যে ছবি রেখে গিয়েছিল, এখনকার মুখের সাথে রেখে যাওয়া ছবির মিল নেই। আদ্রিতার মুখ দেখে বুঝতে পারে তার অবস্থা খুব একটা ভাল না। আদ্রিতা এক কলিগের সাথে নিচুস্বরে আলোচনা করছে। সিয়াম শুধু এতটুকু শুনলো এক ঘন্টা পর অপারেশন। সিয়াম ভাবছে, যাদের কিছু করার কথা ছিল তারা সবাই নিরব দর্শক; অথচ অপরিচিত এই মেয়েটি অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে।
হাসপাতালে বয় এসেছে সিয়ামকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে। অথচ সিয়ামের চোখদুটো চারদিকে খুঁজে ফিরছে আদ্রিতাকে। যাওয়ার আগে কি একবারও দেখা হবে না ?
অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার ঠিক আগ মুহুর্তে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো আদ্রিতা, সিয়ামের হাত ধরে ওর চোখে চোখ রেখে ভরসা দিয়ে বললো সব ঠিক হয়ে যাবে।
সিয়ামের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। মুখের না বলা ভাষাগুলো চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। তার মনে হতে লাগলো, কাউকে চাইলে অবশ্যই পাওয়া যায় তবে সেজন্য অনেকটাই ত্যাগ করতে হয়।
অপারেশন বেডে সিয়াম আর কিছু ভাবতে পারছে না। আজ কেন যেন পুরানো অতীতগুলো একের পর এক ভেসে আসছে। চারদিকের আলো কমতে কমতে এখন শুধুই অন্ধকার। এই অন্ধকারের মাঝে তার চোখের মনিতে জলছাপের মত ছাপা হয়ে গেল গোধূলী মেয়ের মুখ।
ছবিঃ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:৫৬