সামহোয়্যারইন ব্লগের সাথে আমার পরিচয় ২০০৮ সালে। তখন মোবাইল ফোনের নেটে বা পিসিতে সামু পড়তাম প্রায় নিয়মিত। এই প্লাটফর্মে ব্লগিং তখন তুমুল জনপ্রিয় ছিল বাংলাদেশী নেটিজেনদের কাছে। কারণ চ্যাটিং এর পরবর্তী নতুনত্ব ছিল ব্লগিং। আর বাংলায় কথা বলার লেখার সুযোগ পেয়ে যার যা খুশি লিখতো ব্লগে। ফেসবুক তখনও এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। অনেকে হাই ফাইভ/ গুগল প্লাস ব্যবহার করতো। তবে সে সময়ে ব্লগিং করতে কয়েকবার আগ্রহী হলেও শুরু করা হয়ে ওঠেনি। একবার রেজিস্ট্রেশন করে দেখলাম নিক নাম ভুল হয়েছে। পরে সম্ভবত পাসওয়ার্ডও ভুলে গিয়েছিলাম। তখন পিসি কিংবা মোবাইলে বাংলা লেখাটাও এখনকার মত সহজসাধ্য ছিলনা। আরেকটা কারণ আছে। সামুর তখনকার পরিবেশ আমার দৃষ্টিতে ভালো ছিলনা। প্রচুর পরিমাণে বিশ্রী গালিগালাজ আর ১৮+এর নামে অশ্লীল পোস্ট আসতো ভিডিও সহ। আমার মনে হয়ে সেসব পোস্টদাতাগণ এখন ফেসবুককে রঞ্জিত(!) করছেন। বর্তমানে যারা সামুতে আছেন তারা আগের ব্লগারদের তূলনায় অনেক মার্জিত রুচির। আগে মিনিটে মিনিটে পোস্ট জন্ম নিতো। এখন অনেকসময় ঘণ্টা পেরিয়ে যায় পোস্ট আসে না। তবে সে সময় অজস্র মানহীন পোস্টের সাথে মানসম্পন্ন পোস্টও আসতো। সেসব পোস্টদাতাবৃন্দ এখন হয়তো ব্যস্ত পেশায় বা ফেসবুকে। আমি আসলে বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে ব্লগ বিষয়ে বলতে গিয়ে একটু স্মৃতিচারণ করে নিলাম।
আমার কাছে সামুকে বিকল্প গণমাধ্যম বলে মনে হয়না। আমি মনেও করিনা এটি হওয়ার প্রয়োজন আছে। সামুর আলাদা স্বাতন্ত্র্য আছে। যেমন-
১. গণমাধ্যম একটি নির্দিষ্ট চিন্তার আলোকে তার সব সংবাদ/কনটেন্ট প্রকাশ করে। সেটা সম্পাদকের চিন্তা হোক আর ব্যবসায়ী মালিকেরই হোক কিংবা নির্দিষ্ট মতবাদেরই হোক। সেদিক থেকে সামু তুলনামূলক নিরপেক্ষ জায়গা।
২. গণমাধ্যমের সাংবাদিকবৃন্দ পেটের দায়ে লেখেন। সামুর ব্লগারবৃন্দ কিসের দায়ে লেখেন, তারাই ভালো জানেন!( একেকজন একেক কারণে লেখেন, তবে বেশিরভাগ ব্লগ এবং ব্লগারদের ভালবেসে লেখেন)
৩. গণমাধ্যমের জনপ্রিয়তা বিবেচিত হয় সার্কুলেশন কিংবা টিআরপি দেখে। আর সামুর, ভিজিটর সংখ্যা দেখে। এক্ষেত্রে কথা হলো সংবাদপত্রের কোন সংবাদের বা টিভি চ্যানেলের কোন সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা সহজ নয়। কারণ এখানে মন্তব্য, প্রতিমন্তব্যের সুযোগ নেই। যা সামুতে আছে।
৪. গণমাধ্যমের নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে থাকতে হয়। সামুতে মুক্ত মাধ্যম। কবিতা হোক আর গল্প হোক দেদারসে লিখে যাচ্ছেন ব্লগারবৃন্দ। পাঠক যা বুঝেন তার উপরই মন্তব্য করে যাচ্ছেন। এতে ব্লগার উৎসাহিত হবার সুযোগ পাচ্ছেন। গণমাধ্যমে এক ক্লিকেই প্রথম পাতায়!- অসম্ভব।
৫. ব্লগের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিকনেম। এটি খুবই মজার। হতে পারে, দুজন দুজনকে চিনেন। কিন্তু নিক নেমের কারণে বছরের পর বছর ব্লগে অপরিচিত থেকে যাচ্ছেন। আবার উল্টোটিও ঘটতে পারে। ব্লগে কত আপন। বাস্তবে দেখা হলো, কথা হলো না!!
৬. ব্লগ হচ্ছে অনেকটা রাফ খাতার মতো। যা খুশি লেখা যায়, কাটাছেড়া করা যায়। এখান থেকেই তৈরী হবে কবি-সাহিত্যিক সাংবাদিক। তারা গণমাধ্যমে/ সাহিত্য অঙ্গণে আপন দক্ষতার বিকাশ ঘটাবে।
৭. ব্লগারের কোন বয়স নেই। ঠিক যেমন জ্ঞান অর্জনের কোন বয়স নেই। স্কুল লেভেল থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ ব্যক্তিও এখানে লিখে যাচ্ছেন। পড়ছেন, মন্তব্য করছেন।পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের এক সুন্দর উদাহরণ হলো সামু। হাতে গোনা কয়েকজন ব্যতীত প্রায় সবাই পরস্পরকে গঠনমূলক সমালোচনা করেন। বয়স যা-ই হোক সবাই যেন ভাই-বোন। কেউ কারো পোস্ট আটকে দেয় না, যেটা গণমাধ্যমে হয়।
৮. ব্লগে অফুরন্ত জায়গা। এখানে কলামের কিংবা চাংকের সীমাবদ্ধতা নেই। যতখুশি লিখুন।
৯. সামুকে সামাজিক সেবার প্লাটফর্ম করে নিয়েছেন কেউ কেউ। বিশেষ করে রক্তদান, কোন ব্লগারের অসুস্থতায় সহযোগিতা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ব্লগার আমিনুর রহমান সম্ভবত অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। গণমাধ্যমে মিথস্ক্রিয়তার সুযোগ কম থাকায় এভাবে সম্ভব হয় না।
তবে বর্তমানে সামুর ভিজিটর সংখ্যা কমে যাবার কারণ- আমার দৃষ্টিতে:
১. ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয়তা: লাইক শেয়ারের যথেষ্ট সুযোগ এবং প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণে এ দেশের নেটিজেনরা এতে আসক্ত। এ ছাড়া ব্লগে লিখতে গেলে ন্যুনতম জ্ঞান লাগে, যা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে বা কমেন্ট করতে লাগে না। ব্যক্তিত্বহীনতা এবং অনর্থক উন্মাদনার সহজ সুযোগ রয়েছে, যা আমাদের আবেগসিক্ত সাধারণ জনগনকে মজিয়ে রেখেছে( সব ফেসবুকারের কথা বলছি না)। সামু ব্লগ হলো তুলনামূলকভাবে একটি মানসম্মত জায়গা।
২. সাধারণের মধ্যে এক ধরণের ভীতি/ আকর্ষণহীনতা: বিশেষ করে শাহবাগ পরবর্তী ব্লগার হত্যা নিয়ে গণমাধ্যমের তৈরী করা নেতিবাচক প্রচারণার কারণে সাধারণ মানুষ ব্লগার বলতে নাস্তিক বা এলিয়েন টাইপের কিছু ভাবে। এর চাইতে তো ফেসবুক, টুইটার নিরাপদ!!
৩. মানসম্পন্ন পোস্টের অভাব: সামুতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং মান সম্পন্ন পোস্ট আসে। তবে এই অনেক এর পরিমাণটা অনেক কম। ব্লগারবৃন্দ যদি আরো আন্তরিক হন তাহলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে।
৪. সামুর টেকনিক্যাল স্থবিরতা: গত প্রায় ৪/৫ বছর ধরে সামু একই ধরণের লুক নিয়ে আছে। এর কোন অ্যাপ আছে বলে আমার জানা নেই। মোবাইল ভার্সনে সব কাজ করা যায় না। ছবি/ লিংক/ ভিডিও লোড করা কিছুটা জটিল প্রক্রিয়ার। মন্তব্যের নোটিফিকেশন কেন দেখায় না বুঝতে পারি না। এটা কি এনালগ সিস্টেমে হয় কিনা জানিনা। এটা কি এমন যে, কেউ পোস্ট দেখে দেখে সাধারণ স্টেডিয়ামের স্কোরবোর্ডের মত ডিজিট পাল্টায়!!! সম্ভবত আর্থিক সীমাবদ্ধতাও এর টেকনিক্যাল উন্নয়ন না হবার পেছনে একটি বড় কারণ।
তবে সামগ্রিকভাবে বলতে চাই, সামু অনন্য একটি বাংলা অনলাইন জ্ঞানচর্চা ও সামাজিক মতবিনিময়ের মাধ্যম। সামু টিকে থাকুক স্বগৌরবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নতুন ব্লগার জন্ম নিক। সমৃদ্ধ হোক লেখনী, মুক্ত হোক জ্ঞান। সামু ব্লগের সাথে জড়িত সবাইকে জানাই ফুলেল শুভেচ্ছা।
আলো ঝলমল দিনের আশায় সূর্যমুখী দিলাম....
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:৩৭