কোনো খারাপ ঘটনা ঘটলেই- "আরে ভাই, আমরা বাঙালি জাতি না! সব ২ নাম্বার, চোরের জাত! কোন কাজটা ভালো করেছে দেখান!" কিংবা কেনা কাটা করতে গেলে- 'এইটা তো দেশী প্রোডাক্ট, ভরসা নাই। বিদেশী কী আছে দেখান'। এভাবেই আমরা প্রতিনিয়ত নিজেকে ছোট করছি, অপমান করছি। দেশকে বা জাতিকে অপমান করে নিজেকে বড় মনে করছি। এক ধরণের নোংরা আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি নিজের শেকড়ের অবমাননা করে। এ মানসিকতা আমাদের ছিল না। যুগে যুগে বিদেশীরা আমাদের শাসন করেছে, শোষণ করেছে, লুট করেছে। তাদের প্রতি আমাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা তৈরী করার চেষ্টা করেছে। অনেক জাতির প্রতি, দেশের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জন্মেছেও। কিন্তু ইংরেজরা সর্বশেষে আমাদের মনে নিজেদের সম্পর্কে হীনম্মন্যতা জাগানোর চেষ্টায় সফল হয়েছে। আমাদের কেরানিগিরির শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে স্যার বলার মাধ্যমে মেকী শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছে। সব ক্ষেত্রে আমাদের জাতিকে শোষণ করে নিজেদের মধ্যে আত্মবিদ্বেষী মনোভাব তৈরী করে রেখে গেছে। তার ফলাফল এখনো আমরা পাচ্ছি। অথচ আমরা সত্যিকারার্থে হীন/ সংকীর্ণ/অসভ্য/দরিদ্র জাতি ছিলাম না কোন কালে। যুগে যুগে খ্যাতনামা পর্যটকবৃন্দ এ দেশের মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন নি। বরং তাদের মন্তব্য পড়লে এখনো আনন্দে বুক ভরে যায়। চলুন আবহমান বাঙালি জাতির কিছু বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করা যাক-
১. নৈতিকতা- আমাদের নৈতিক অবস্থান সর্বকালেই ভালো ছিল। অনেক ব্যখ্যায় না গিয়ে সহজ উদাহরণ হলো বাঙলায় আগমনকারী নবী/ প্রেরিত পুরুষের সংখ্যা খুবই কম বা অজ্ঞাত। কেউ কেউ বুদ্ধ এবং শ্রীকৃষ্ণকে নবী/অবতার বলতে চান। তবে সে ব্যপারেও সুস্পষ্ট প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। অথচ আমরা যাদের ধর্মের দিক থেকে শ্রদ্ধা করি সে আরবরা বহু নবীকে হত্যা করেছে। স্রষ্টা তো অসভ্যদের সভ্য করার জন্যই নবী বা অবতার পাঠান! সুতরাং বলা যেতে পারে সৃষ্টিকর্তা বাঙালির নৈতিক চরিত্রকে পছন্দ করেই বেশি নবী পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করেননি।
২. কৌতুহলী- মাটি কাটুক আর দালানে রঙ করুক, লক্ষ্য করলে দেখবেন কিছু মানুষ খুব আগ্রহ ভরে তাকিয়ে আছে। কীভাবে কাজ করছে ওরা; এটাই তাদের কৌতুহল। আর কৌতুহলী মানুষ মাত্রই মনোযোগী। আর তাই দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই সাধারণ মানুষ অনেক ধরণের কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলে। সে কৌতুহলকে সুবিন্যাস্ত করতে পারলে যোগ্যতা নিপুণ দক্ষতায় পরিণত করা সম্ভব।
৩. পরিবার সংস্কৃতি- পরিবার ব্যবস্থা সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে একটি অনন্য নেয়ামত। পশ্চিমা তথাকথিত সভ্যতা পরিবারকে অস্বীকার করে পাশবিক সমাজে পরিণত হচ্ছে। কে কার বাবা, কে কার মা, কার ভাই বোন কয়জন এটা জানার জন্য এখন ডিএনএ টেস্টের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য মানবিক, সহানভূতিশীল পরিবেশ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে তারা। কিন্তু এখনো বাঙালিরা দেশে হোক আর বিদেশেই হোক ঝগড়া ঝাটি আর খুনসুটির পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ফলে সন্তানের সামাজিক বেড়ে ওঠা এখনো অনেকাংশে অব্যাহত আছে।
৪. সহানুভূতি- আমরা পরস্পরের প্রতি অনেকটাই সহানুভূতিশীল। আত্মীয় স্বজন মারা গেলে কান্না করার জন্য জাপানীদের মত ভাড়া করা লোক আনতে হয় না। পরস্পরের সহযোগিতার হাত বাড়াতে এখনো আমরা বিশ্বাসকেই মূল্য দেই, নিজের লাভ-ক্ষতিকে নয়।
৫. মেধা- আমাদের মেধার প্রমাণ দেখতে গিয়াস লিটন ভাইয়ের পোস্টগুলো পড়লেই হবে। তবে অনেকাংশে বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন দেশে না হওয়ায় বিদেশে এর প্রয়োগ এবং বিকাশ বেশি হচ্ছে।
৬. পরিশ্রমী- সূর্যোদয়ের সাথে ঘুম থেকে উঠে চাষবাসের জন্য পান্তা খেয়ে বেরিয়ে যাওয়া আমাদের দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য। বাঙলা দিনপঞ্জিতেও তারিখ শুরু হয় সূর্যোদয় থেকে। কাজকে ভালো বাসতে পারলে আমরা দীর্ঘ সময় পরিশ্রম করতে পারি। বিদেশে আমাদের শ্রমিকদের চাহিদার একটি বড় কারণ পরিশ্রমপ্রিয়তা।
৭. প্রকৃতির সাথে অন্তরঙ্গ- ষড়ঋতুর পরিবর্তনের সাথে প্রাকৃতির দূর্যোগের নিয়মিত শিকার আমাদের এ আবাসভূমি। যুগে যুগে বাঙালিরা তাই প্রকৃতির বিরুপ আচরণের সাথে যুদ্ধ করে নিজেদের সক্ষমতাকে সমৃদ্ধ করেছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় যাই আসুক আমাদের প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আর নবীনদের উদ্যমের কাছে হার মেনে যায়। সাময়িক ক্ষতি হয় ঠিকই কিন্তু তাতে করে আমাদের জীবন প্রবাহ থেমে থাকেনি কখনো।
৮. উদার অতিথিপরায়ন- আমরা সব যুগেই অতিথিকে সম্মান দিয়ে এসেছি। সভ্যতা আর অনন্য ব্যক্তিত্ববোধের পরিচয় অতিথিপরায়ণতা। এখনো আমরা সে উদারতাকে ধরে রেখেছি। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাথে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরী করতেও আমরা অনেক অগ্রসর।
৯. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি- বাঙালি জাতিসত্ত্বায় হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম যা-ই থাকুক সবার মধ্যে সুন্দর সামাজিক সম্পর্ক বজায় ছিল। সেকারণে কবি নজরুলও বলেছিলেন-
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন মণি হিন্দু তাহার প্রাণ
কিন্তু ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির মাধ্যমে দাঙ্গা-রায়ট লাগানো শুরু হয়। এখনো সে প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে উসকানি দিয়ে যায় দাঙ্গাবাজ গোষ্ঠী।
১০. সাহসী- যেকোন মহৎ কাজ করতে গেলে সাহসের প্রয়োজন হয়। আমাদের জাতি সাহসী জাতি। প্রমাণ চান? বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বারো ভূঁইয়ার ঈসা খাঁর যুদ্ধ, কামানের সামনে বাঁশের কেল্লার তিতুমীরের যুদ্ধ ইত্যাদি। অবাক বিষয় হচ্ছে পুরো ভারতবর্ষ ইংরেজদের শোষণের শিকার হলেও ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল এই বাঙলা। ইংরেজদের নির্মম নির্যাতন আর চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে নির্ভীক বাঙালি প্রতিবাদ করে গেছে অবলীলায়।
এই লেখার উদ্দেশ্য অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে অযৌক্তিক আত্মতৃপ্তিতে ভোগা নয়। বরং নিজের জাতি সম্পর্কে হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে নিঃসঙ্কোচে নিজেদের কর্মপর্যালোচনা করার মানসিকতা তৈরী করা। আমাদের জাতির উত্থানের দাবি এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা। শুধু জাতির দোষারোপ না করে নিজের করণীয়ের দিকে মনোযোগী হলে আমরা আবারো গর্বিত জাতিসত্ত্বার ধারক হতে পারবো। সেজন্য আমাদের প্রয়োজন সত্যিকারের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ উদার রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নির্মোহ প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব।
( সপ্তম বাংলা ব্লগ দিবস সাময়িকীর জন্য তাড়াহুড়ো করে তৈরী তাৎক্ষণিক পোস্ট)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:২৫