এটা সম্ভবত আলেকজান্ডার কিংবা সম্রাট জাহাঙ্গীরের ঘটনা। বাঙলা জয় করতে এসে তিনি একই দিনে জোয়ার ভাটার ফলে নদীতে পানি প্রবাহের বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। তিনি স্বগতোক্তি করলেন - ’যে দেশের নদী একই দিনে বিভিন্ন রুপ নেয়, সে দেশের মানুষের চরিত্রও নিশ্চয়ই বহুরুপী হবে।’ নদীর জোয়ার ভাটার মতই আমাদের আবেগের ওঠা-নামা। জলবায়ুর প্রভাব মানুষের বৈশিষ্ট্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আমাদের ষড়ঋতুতে একই আকাশ-বাতাস, মাটি, গাছপালা যে বৈচিত্র্যময় পরিবর্তনে নিজেকে রাঙায়, আমাদের দেশের মানুষের স্বভাব চরিত্রেও একই রকম বৈচিত্র্য দেখা যায়। সামনে কাউকে স্যালুট করে পেছনে তাকে গালাগাল করতে আমাদের সময় লাগে না। আবেগের মাত্রায় আমরা অনেক অসাধ্য সাধন করে ফেলি আবার অনেক ক্ষেত্রে বেখেয়াল থাকি। যেমন, গানেই বলা আছে-
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম...
কে হবে মেম্বার, কেবা গ্রাম সরকার
আমরা কী তার খবর লইতাম....
আমরা এতটাই শান্তিপ্রিয় আর বেখেয়াল ছিলাম যে আমাদের কারা, কীভাবে শাসন করছে সে বিষয়ে উদাসীন ছিলাম। তাই লর্ড ক্লাইভ নিজেই বলেছিল- পলাশী থেকে কলকাতায় ফেরার পথে যত মানুষ রাস্তার দু ধারে বিজয়ী ইংরেজ বাহিনীকে দেখার জন্য দাড়িয়েছিল, তারা যদি একটি করে ঢিলও ছুড়তো তাহলে ইংরেজ বাহিনী ধ্বংস হয়ে যেতো।
আমরা জাতিগতভাবে প্রচণ্ড আবেগসিক্ত। আর তাই-
১. কামানের সামনে তিতুমীর বাশের কেল্লা বানিয়ে যুদ্ধ করতে পেরেছিলেন।
২. ক্ষুদিরাম তরুণ বয়সে নির্ভয়ে ফাঁসির মঞ্চে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
৩. নারী হয়েও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধে উন্মুখ হয়েছিলেন।
৪. নজরুল তরুণ বয়সে বলতে পেরেছিলেন-
এদেশ ছাড়বি কিনা বল
না হয় কিলের চোটে হাড় করিব জল
৫. আবেগ ছিল বলেই পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ, আশ্রয় না থাকা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। নিছক যুক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ করলে যুদ্ধে যাওয়া হতো না। আর আমরাও স্বাধীন দেশ পেতাম না।
কিন্তু আমাদের এই অনিয়ন্ত্রিত আবেগকে বিপথে পরিচালিত করার ফলে কী হয়? আমরা নিরপেক্ষ হতে পারি না। আমরা যৌক্তিক বোধে উদ্বুদ্ধ হতে পারি না। আমরা বিবেকবান- সচেতন হতে পারি না। শিক্ষিতের হার যতই বাড়ুক এখনো যৌক্তিক সচেতনতার দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। যেমন-
১. ব্রাজিল আর্জেন্টিনার খেলা হয় হাজার হাজার মাইল দূরে। আর আমরা এখানে তাদের পতাকা উড়িয়ে দেশপ্রেমের প্রমাণ দিই! তাদের হারজিত নিয়ে নিজেদের মাথা ফাটাই, খুনোখুনিও করি। নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে খেলা দেখার পেছনে সময়দানের ক্ষেত্রেও আমাদের দেশের লোকজন মনে হয় রেকর্ড করতে পারবে।
২. ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষিত লোককেও বলতে শুনি- ভোটটা পচায়ে কী লাভ! অমুককে দিলে অন্তত বলতে পারবো যে আমার প্রার্থী জিতেছে, কিছু পাই আর না পাই!
৩. গণপিটুনিতে মানুষ মারার ঘটনা জরিপ করলে মনে হয় আমাদের দেশ উপরের সারিতে থাকবে। কেউ একজন ধর ধর বলে চিৎকার করলে জোয়ান-বুড়ো নির্বিচারে ঝাপিয়ে পড়েন শাস্তি কার্যকর করতে। কাকে মারছি, কেন মারছি কোন চিন্তা ভাবনার দরকার নেই।
৪. টিভিতে টকশোর টিআরপি অনেক বেশি। কারণ আমরা টকশোর ঝগড়া দেখতে খুব ভালোবাসি। চ্যানেলগুলোও চেষ্টা করে উৎকৃষ্ট ঝগড়া আয়োজন করে টকশো জমাতে! কিন্তু আমার জানা নেই টিভির টকশোর বুদ্ধিজীবি সংলাপ থেকে গত ১ যুগে কোন জাতীয় সমস্যার সমাধান এসেছে কিনা। তবুও আমরা টকশো দেখি আর বিভ্রান্ত ও উৎসাহিত হয়ে সকল আড্ডাকে রাজনৈতিক টকশোতে পরিণত করি।
৫. আমার নেতা নেত্রী ঠিক বললেন নাকি ভুল বললেন সেটা যাচাই বাছাই না করেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ি। (অধ্যাপক জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে সিলেটে একটি বিক্ষোভ মিছিলের ভিডিও দেখেছিলাম। সেখানে এক উত্তেজিত বিক্ষোভকারীকে জিজ্ঞেস করার পর সে লজ্জিত হয়ে বলেছিল- জাফর ইকবাল কী বলেছেন সেটাই সে জানে না।) অপরপক্ষকে নিরেট শত্রু বিবেচনা করে নির্বিবাদে গালমন্দ করি। সে ভালো কাজ করুক আর খারাপ কাজ করুক তার বিরোধিতা করাটাই কাজ হয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়। রাজনৈতিক কর্মসূচির নাম করে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করি, মানুষের জীবন-সম্পদের বিনাশ করে যাই অবলীলায়। বিপক্ষে কথা বললেই শত্রু ভেবে নিয়ে তাকে গুম/হত্যা করার মত জঘন্য ঘটনাও নতুন নয়।
শেষ কথা হলো- আমাদের সহজ সরল জনগনের হৃদয়ের আবেগকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিপথে পরিচালিত করে জাতীয় দূর্যোগ তৈরী করা খুবই সহজ। আবার একই আবেগকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে জাতীয় উন্নয়নের গতিধারায় নিয়োজিত করতে পারলে এ জাতির পক্ষে অসাধ্য সাধন করে ফেলা সময়ের ব্যপার মাত্র। কিন্তু এ ব্যপারে মূল ভূমিকা জাতীয় নেতৃবৃন্দের। আমাদের আবেগসিক্ত স্বভাবের পরিবর্তনশীলতা এবং বৈচিত্র্যের বিষয়টি তাদের খেয়াল রাখা দরকার।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ২:৫৪