কৌতুহল বশত এক পরিচিত আইনজীবিকে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম- মামলা কেন বছরের পর বছর চলে? তিনি জবাব দিলেন- আইন পেশায় নীতি হলো 'অপরাধীর শাস্তি হোক বা না হোক, নিরপরাধ অভিযুক্ত যাতে অবিচারের শিকার না হয়। আর সেজন্যই আমরা চেষ্টা করি যাতে মামলার তারিখ পেছানো যায়।' ভেবে দেখলাম কথাটা মন্দ না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রশাসনিক ব্যবস্থা এ নীতির কতখানি স্বপক্ষে কাজ করে? একজন অভিযুক্ত ( অপরাধী হোক কিংবা নিরপরাধ) ধরা পড়ার পরই তাকে রিমান্ডের নামে যে টর্চার চালানো হয় তাতে গাঁধা ও নাকি নিজেকে ঘোড়া স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তারপর বছরের পর বছর ধরে তাকে আটকে রাখা হয় বিচার চলছে এ হিসেবে। রাজনৈতিক মামলাগুলোর বিচার তো শেষ হয় না। 'দুবছর কারাদণ্ড' এমাত্রার শাস্তি হবে এমন মামলায় যদি কেউ ৩ বছর আটকে থাকে বিচারের অপেক্ষায় তাহলে সেটা কি অবিচারের মধ্যে পড়ে না? তার এ তিন বছর কে ফিরিয়ে দিবে? কিছুদিন আগে মজার স্কুলের যে কয়েকজন উদ্যোক্তা ১ মাস বিনা বিচারে আটক থাকলো এর কি কোন প্রতিবিচার হওয়া দরকার নেই?
যেসব ছোটখাট চুরি, মারামারির ঘটনা গ্রাম্য সালিশে আগে মুরুব্বিরা সমাধান করে দিতেন এক বৈঠকে, সেগুলো যখন মামলার আকারে আদালতে যাচ্ছে, বছরের পর বছর লেগে যাচ্ছে সমাধান হতে। ফলে সামাজিক সম্পর্কের মাঝখানে আদালতি দেয়াল তৈরী হচ্ছে অহরহ।
আদালতি বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের শিখিয়ে গেছে ব্রিটিশ বেনিয়ারা। অথচ তার পূর্বে বাঙলার বিচারব্যবস্থা ছিল কিংবদন্তীতূল্য। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের বিচারের ঘটনা এখনো আমরা বইয়ে পড়ে থাকি। শিকারের উদ্দেশ্যে ছোড়া তীরে ভুলবশত বিধবার সন্তান হত্যার দায়ে নিজের পুত্রকে শাস্তি দিতে তিনি দ্বিধা করেননি। অথচ এখন সত্যিকারের অপরাধীকে বাচানোর জন্য কতই না কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়। ব্রিটিশদের শেখানো আইন পেশার আরেকটি নীতি হলো- অপরাধী যদি অপরাধ করে উকিলের নিকট আসে, তাহলে উকিলের দায়িত্ব তাকে শাস্তি/ বিচারের হাত থেকে রক্ষা করা( যদি তিনি নিশ্চিতও থাকেন যে অপরাধী সে-ই) । এই নীতি কতটা বিবেকসম্মত আমার মাথায় আসে না।
মামলার জটের কী অবস্থা সেটা কিছুদিন পূর্বে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন। উচ্চ আদালতেই ঝুলে আছে প্রায় ৩ লাখ মামলা। এসব মামলার সাথে যারা জড়িত তাদের পরিবার এসব আইনী জটিলতা থেকে কবে মুক্তি পাবে সেটা অনিশ্চিত। বিচারের রায়ে শাস্তি পাবার আগে যারা (অপরাধী বা নিরপরাধ অভিযুক্ত) মানসিক শাস্তির কারাগারে থাকে সেটার সমাধান কী হবে?
আগের দিনে গ্রাম্য সমাজে কেউ কোন বড় ধরনের অপরাধ করলে তাকে একঘরে করা হতো। তাতে সে কারো সাথে মিশতে পারতো না, নিজের ঘরে অন্তরীণ থাকতো। নিজের যা আছে তা দিয়ে খাওয়া দাওয়া করতো। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। একান্তই তার ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজন তার সাথে দেখা করতো। এতে সে মানসিকভাবে সংশোধন হবার সুযোগ পেতো। কিন্তু বর্তমান আদালতি ব্যবস্থায় অপরাধীর খাবার, চিকিৎসা সহ অন্যান্য খরচ চলছে আমাদের সাধারণ জনগনের ট্যাক্সের টাকায়! আর কারাগারে তার আত্মীয়স্বজন, অমুক তমুক, দলের লোক সবাই দেখা করছে। কারারক্ষীদের সাথে বিশেষ সম্পর্ক থাকলেতো সে জমিদারি হালে থাকে! সেখানে তার সংশোধন তো দূরের কথা আত্মপর্যালোচনার পরিবেশই তো তৈরী হচ্ছে না।
তাই আবহমান বাঙলার বিচার ব্যবস্থার ঐতিহ্যের আলোকে বর্তমান বিচার ব্যবস্থার প্রায়োগিক, বাস্তবসম্মত এবং বিবেকসম্মত সংস্কার প্রয়োজন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:৩৪