somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্ষুধা

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রতিদিনের মতো সান্ধ্য ভ্রমণ শুরু করার আগে আমি বৃদ্ধ মহিলার কাছে গেলাম। তাঁর হাতে কেকের প্যাকেট দুটি দিয়ে বললাম, ‘চা খাবেন?’ বৃদ্ধা আগ্রহ নিয়ে মাথা নাড়েন। আশপাশে ছাপরা ঘরের চায়ের দোকানগুলো নেই। আমি আমিন সেন্টারের ভেতরে ঢুকলাম। সবই তো প্যান্ট-শার্টের দোকান, এখানে চা কোথায় পাই! একটা ফাস্টফুডের দোকান। ফাস্টফুডের দোকান থেকে প্লাস্টিকের কাপে এক কাপ কফি এনে বৃদ্ধাকে বললাম, ‘খান’। বৃদ্ধা কেক দুটি এক হাতে নিয়ে নিশ্চল বসে আছেন।
বৃদ্ধ মহিলাকে আমি প্রথম আবিষ্কার করি গত বছরের রমজান মাসে। তিনি বাঁ পায়ে ভর দিয়ে, টেনেহিঁচড়ে অনেক কষ্টে হাঁটছেন দেখে বুঝতে পারলাম, তাঁর ডান পা সম্ভবত অকেজো। আমি একটা ইফতারির প্যাকেট বৃদ্ধাকে দিয়ে বললাম, ‘খাবেন?’ বৃদ্ধা শূন্য চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বাঁ হাতে থলেটি উঁচিয়ে ধরেন। আমি থলের ভেতর প্যাকেটটা ফেলে দিলাম। বৃদ্ধার ডান পাশটি প্যারালাইসিস বা অন্য কোনো কারণে অসাড় হয়ে আছে। দীর্ঘ এই দেড় বছরে আমি বৃদ্ধাকে কখনো কথা বলতে দেখিনি। হয়তো একই কারণে তিনি তাঁর কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়েছেন।
লালখানবাজার মোড়ে আমিন সেন্টারের সামনে বসে থাকা এই বৃদ্ধার অস্তিত্ব আমি ভুলে থাকার চেষ্টা করি সব সময়। যখন বাসায় ফেরার জন্য লালখানবাজার মোড়ে আসি, প্রতিদিন দেখতে পাই, বৃদ্ধা আমিন সেন্টারের সিঁড়িতে অসহায়ভাবে বসে আছেন। বন্ধ মার্কেটের সামনে বসে থাকা নিঃসঙ্গ বৃদ্ধাকে অতিপ্রাকৃত গল্প থেকে উঠে আসা কোনো চরিত্র বলে মনে হয়। আমি মাথা নিচু করে পরাজিত মানুষের মতো হেঁটে আসি। আমি বৃদ্ধার দিকে তাকাই না। বৃদ্ধা আমার প্রচণ্ড মন খারাপ করিয়ে দেন। আমি বৃদ্ধাকে ভুলতে চাইলেও বৃদ্ধা তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে আমাকে লজ্জায় ডুবিয়ে দেন।
কয়েক দিন আগে আমিন সেন্টারের সিঁড়িতে বসে থাকা বৃদ্ধা আবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বৃদ্ধার মুখে অসহায় ভাব নেই। কেউ একজন তাঁকে এক প্যাকেট পাউরুটি এবং এক কাপ চা দিয়ে গেছে। তিনি খুব আনন্দ নিয়ে পাউরুটি চায়ে ভিজিয়ে খাচ্ছেন। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি। সুন্দর একটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে একটি বাচ্চা ছেলে বৃদ্ধার কোলে একটি চকচকে নতুন পাঁচ টাকার নোট ফেলে যায়। বৃদ্ধা টাকার দিকে ফিরেও তাকান না। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, টাকা বৃদ্ধার মনোযোগ বিন্দুমাত্রও আকর্ষণ করতে পারেনি। আমার মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। কেউ যদি টান মেরে পাউরুটির প্যাকেটটা নিয়েও যায়, তাহলে কিছুই করতে পারবেন না এই শক্তিহীন বৃদ্ধা। আমি দাঁড়িয়ে বৃদ্ধাকে পাহারা দিতে থাকি।
এই বৃদ্ধার কোনো সন্তান আছে কি না, জানি না। ওই বৃদ্ধা প্রতিদিন একই জায়গায় কেন বসে থাকেন, তা-ও জানি না। হয়তো বা এই জায়গাতেই তাঁর সন্তানেরা তাঁকে ফেলে রেখে গেছে। বৃদ্ধা হয়তো মনের কোণে এক টুকরা আশা জ্বালিয়ে রাখেন, তাঁর সন্তানেরা একদিন এসে তাঁকে এখানেই খুঁজবে কিংবা চলনশক্তিহীন, থুত্থুড়ে এই বৃদ্ধা স্বপ্ন দেখেন, একদিন পরম করুণাময় নেমে আসবেন তাঁর কাছে। গভীর মমতায় হাত ধরবেন এই মুমূর্ষু মহিলার। বৃদ্ধা চলে যাবেন কোনো অনন্ত শান্তির দেশে।
বৃদ্ধা একটি নতুন পাঁচ টাকার নোট অত্যন্ত অবহেলায় কোলে ফেলে রেখে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকেন এক হাতে। আমি প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে বৃদ্ধার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি।
জুয়েল দেব
চট্টগ্রাম।
প্রথম আলো, ছুটির দিনে'তে প্রকাশিত ৪/২/২০১২,
মূল লেখার লিংক

**আমি যদ্দুর পারি, আমার সাধ্যমত করছি। চট্টগ্রামের কেউ যদি এই লেখাটা পড়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে একটা অনুরোধ, কিছু করতে না পারলেও, দয়া করে অন্তত একবার লালখান বাজার এসে দেখে যাবেন কিছু মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে। এটাকে আদৌ বেঁচে থাকা বলে কিনা!
১২টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পুতুল নাচের মাঝের গল্প : ওয়াকার বনাম ইউনূস !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:০৯


বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান অবস্থা দেখে একজন সাধারণ নাগরিক কি ভাবছেন? তাদের ভাবনার আদৌতে গুরুত্ব আছে কোনো ? দেশে ইন্টেরিম সরকার ক্ষমতায় থেকে টেনেটুনে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেশে নির্বাচন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে...

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:৪৪


পঞ্চগড় সদর উপজেলার পানিমাছপুকুরি এলাকায় তাওহীদ মডেল মাদরাসার এক শিক্ষার্থী (সুমনা)’র রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের দাবি, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

নিহতের বড় বোন আমেনা খাতুন জানান, কিছুদিন আগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুউব ইচ্ছে করে

লিখেছেন মাসুদ রানা শাহীন, ২৩ শে মে, ২০২৫ সকাল ৭:০১


হ্নদয়ের অমিত প্রাচুর্য পেশিতে ধারন করে আমার খুউব দৌড়াতে ইচ্ছে করে
খুনের এই জনপদ ছেড়ে শান্তি সম্মান স্বস্তির
ওয়ান ওয়ে টিকিট কাটতে ইচ্ছে করে।

হ্নদয়ের অনিরুদ্ধ তেজ ঠোঁটে মেখে আমার খুউব
গলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওরা সাতজন - বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে প্রধান অন্তরায় !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে মে, ২০২৫ দুপুর ১:২৬


সংকট ঘনীভূত; ড. ইউনূস কে ঘিরে একটি চক্র সক্রিয়-শিরোনামে মানবজমিন পত্রিকা একটা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট করেছে। ড.ইউনূস কে ব্যবহার করে ইন্টেরিম সরকারের ভিতরে চারজন ও বাইরে তিনজন এক... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি - জুলাই বিপ্লবের বিশ্বাসঘাতক

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৩ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৩:০১



ডক্টর ইউনুস এই দেশের ক্ষমতায় আর থাকতে চাচ্ছেন না। তবে এর দায় ভারতের নয়, পলাতক স্বৈরাচারী আওয়ামিলীগেরও নয়। এই দায় সম্পুর্নভাবে এই দেশের বৃহত্তম রাজনৈ্তিক দল বিএনপির। অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×