কিশোর বেলার এক দুপুরে একটা অসাধ্য সাধন করে ফেলেছিলাম।
পূর্ব পাড়ার পুকুর পাড়ে একটা পেয়ারা, ২টা জামরুল গাছ আবিস্কার করে ফেলেছিলাম। গাছে পেয়ারা পেকে একেবারে হলুদ হয়ে আছে। জামরুলও ধরে আছে থোকা থোকা। দু-একটা ফলে কেবল পাখির ঠোঁটের অবয়ব। এই জায়গাটায় কেউ আসে না। কাছের বন্ধু-বান্ধব কাউকেই এই গুপ্তধনের সংবাদ জানাইনি। পাখিদের খাবারে আমি একাই ভাগ বসাতাম।
এভাবে ক্লাস বন্ধের দুপুরগুলোতে আমাকে খুজেঁ পাওয়া যেত না। হাফপ্যান্টের পকেটে ভরে কিছু পেয়ারা আর জামরুল নিয়ে বের হতাম। বন্ধুরা খুব অবাক হতো। এক বন্ধু রটিয়ে দিল, আমাকে নাকি পরী আছর করেছে। সুন্দরী পরী দুপুরবেলায় আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়, তারপর ফলসমেত পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়। আমি তাদের ভুল ভাঙ্গাতাম না। এতে বন্ধু মহলে কদরটা বেড়ে গিয়েছিল ভীষণ।
একদিন পেয়ারা গাছের ডালে বসে খেয়াল করলাম পুকুরে বড় বড় কৈ মাছ ছোটাছুটি করছে। বড়শি দিয়ে মাছ ধরার নেশা আগে থেকেই ছিল। নারিকেল গাছে উঠতে পারে, এমন এক বন্ধুকে দিয়ে লাল পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করলাম। আমার সংগে মাছ ধরতে যাওয়ার বায়না ধরেছিল বন্ধুটি। সাফ জানিয়ে দিলাম, তোমার পথে তুমি যাও।
গুপ্ত জায়গায় বড়শি ফেললাম। প্রতিবারে একটা করে কই আটকাতে থাকল বড়শিতে। লাল রঙের বিশাল সাইজের কৈ দেখে আনন্দে আর লোভে আমার চোখগুলো প্রায় বেরিয়ে আসছিলো। মাছের জন্যও মায়া হতে লাগল। এই মাছগুলো কত্ত বোকা! অথচ পশ্চিম পাড়ার পুকুরের মাছগুলো অনেক চালাক। সহজে বড়শিতে ধরা দেয় না। বড়শি খেয়ে অভ্যাস নেই বলেই হয়ত ওরা চালাকিটা ধরতে পারছে না। প্রথম দিনে প্রায় ২০০ কৈ নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলাম।
আমার ছোট চাচা তো অবাক! এটা কি করে সম্ভব? কথা প্রসঙ্গে অন্য কথা বলি, কৈ মাছ আমি একেবারেই পছন্দ করি না। জোর করেও কেউ আমাকে কৈ মাছ খাওয়াতে পারেনি। কিন্ত মাছ ধরার আনন্দের কাছে খাওয়া না খাওয়া খুবই তুচ্ছ।
পরদিন আবারো গেলাম। পেয়ে বসল অন্য নেশা। পাশের গাছেই একটা পাখির বাচ্চা কিচির মিচির করে ডাকছে। বড়শি ফেলে উঠলাম ছোট্ট গাছটাতে। পাখির বাসায় হাত রাখব এমন সময় দেখি একটা বিষাক্ত সাপ ফনা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করছে। পাখির বাসাতেই বসে আছে সাপটি। আমার আত্মা আর যথাস্থানে নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পড়ে গেলাম গাছ থেকে।
স্বপ্নটাও ভেঙ্গে গেল। গত রাতের স্বপ্ন এটা। তবে সত্যি বলছি, এই স্বপ্নের এক বর্ণও মিথ্যে নয়। আমার কৈশোর এভাবেই কেটেছিল।
এখনো গ্রামের বাড়ি যাই। সেই জঙ্গলময় জায়গাটা এখন লোকে লোকারণ্য। ঘর উঠেছে মোট তিনটা। গতবারও যখন বাড়ি গিয়েছিলাম, সেদিকে তাকিয়ে মনের ভেতরে একটা দীর্ঘশ্বাস টের পেয়েছিলাম।
এভাবেই এই দেশে সব মানুষের কৈশোর চুরি হয়ে যায়। গড়ে ওঠে নতুন সভ্যতা।