দাউদ হোসাইন রনি
ছবির নাম : দুর্ধর্ষ প্রেমিক
পরিচালক : এমবি মানিক
অভিনয়ে : শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, মিশা সওদাগর, উজ্জল,
সাদেক বাচ্চু, ইলিয়াস কেবরা, শিবা শানু, সুব্রত প্রমুখ
মুক্তির তারিখ : ২১ সেপ্টেম্বর
রেটিং : ১/৫
'অথিধি' নামের একটা তেলেগু ছবির হাস্যকর কপি 'দুর্ধর্ষ প্রেমিক'। স্টার গোল্ড, জি সিনেমা বা ইউটিভি অ্যাকশন চ্যানেলের কল্যাণে অনেকেই তেলেগু ছবিটা দেখে থাকবেন। হিন্দিতে ডাবিং করে ছবিটা দেখানো হয় 'ইন্টারন্যাশনাল খিলাড়ি : দ্য আয়রনম্যান' নাম দিয়ে। কাহিনী নকলের খবরে আমরা এখন আর বিচলিত হই না। এমন তো অহরহই ঘটে। হোক নকল গল্প, নির্মাণে কারিশমা দেখাতে পারলে তবু তৃপ্তি পাওয়া যায়। অনেকেই নকল করাকে প্রশ্রয় দিয়ে পাল্টা আক্রমন করে বলেন, যত দোষ নন্দ ঘোষ! কেবল আমরাই নকল করি? বলিউড যে একের পর এক তামিল ছবি রিমেক করছে সেটা কি চোখে পড়ছে না? হ্যাঁ, চোখে পড়ে। কিন্তু তারা হিপোক্রেসি করে না, আমরা করি। 'ওয়ান্টেড', 'গজিনি', 'দাবাঙ', 'সিংহম', 'রাওডি রাঠোর' টাইপের ছবিগুলো মুক্তির আগে বাংলাদেশের সিনেমা রসিকরাও জেনে ফেলেন, কোন তামিল বা তেলেগু ছবির রিমেক এই ছবিগুলো। আর আমরা কি করি? ওদের চিত্রনাট্য মেরে দিয়ে নিজেদের নাম বসিয়ে দেই। এই ছবিটার কথাই ধরুন না, চিত্রনাট্যের ক্রেডিট গেছে আব্দুল্লাহ জহির বাবুর পকেটে। আরেকজনের গল্প নিজের বলে চালিয়ে দেওয়ার মধ্যে বাহাদুরিটা কোথায়? আর পরিচালক তো মিডিয়ায় বলে বেড়ান, 'নতুন কিছু দেখতে পাবেন এই ছবিতে।' এদের কে বোঝাবে, স্যাটেলাইটের এই যুগে নকল জিনিস কখনো 'নতুন' থাকে না। যে দর্শকদের টার্গেট করে এই ছবিগুলো বানানো হয়, হলে বসে তারাই গালিগালাজ করেন। পাশের সিটে বসা এক গার্মেন্টকর্মীর কথা শুনে রীতিমতো কানে আঙুল দিতে হয়েছিল। ইস্, পরিচালক ভদ্রলোক যদি দর্শকের এই গালিভরা সংগীত শুনতে পেতেন!
ভারতের পক্ষ নিয়ে কথা বলার প্রশ্নই আসে না। তবুও বলতে হয়। তামিল বা তেলেগু ছবি তারা নকল করে না, রিমেক করে। বলিউডের 'ওয়ান্টেড' আর তামিল 'পক্কিরি' ছবির গল্প এক হলেও দেখবেন, মেকিংয়ে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আর তামিল বা তেলেগু ভাষার একটা ছবি ভারতের অন্য রাজ্যের ভিন্ন ভাষার দর্শকদের নিজের ভাষায় দেখার অধিকার থাকে। কারণ, দেশটা তাদেরই। তাহলে আমরা কারা? রাজনৈতিকভাবে আমরা বরাবরই ভারতবিদ্বেষী। তবে আমাদের ফিল্ম মেকাররা কেন ভারতের প্রাদেশিক রাজ্যের নির্মাতাদের মতো আচরণ করছেন?
ছবিতে ব্যবহৃত আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের একটি গান বাদে সবগুলো গানই বিভিন্ন তেলেগু ছবির নকল। 'আই লাভ ইউ' শিরোনামের একটি গানের সুর তেলেগু 'আরিয়া ২' ছবির একটি গানের হুবহু কপি। শুধু গান নয়, কোরিওগ্রাফি এবং ড্যান্স স্টেপও কপি করেছেন খুবই দুর্বল তরিকায়। এই গানের দেশীয় স্রষ্ট্রার নাম আলী আকরাম শুভ।
সেদিন একজন সিনিয়র চলচ্চিত্র নির্মাতা ফোন করে বললেন, ভাই এভাবে দেশের ছবি নিয়ে লিখবেন না। নকল করে যদি ভালো কিছু হয়, তাহলে কিছুটা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ছবিটা দেখে বের হওয়ার সময় একবার এই পরিচালককে ফোন দেওয়ার ইচ্ছে হলো। বলতে ইচ্ছে করছিলো, একবার এসে সচক্ষে দেখে যান। আপনাদের আমলে আপনারা যখন 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' বা 'স্বজন' বানিয়েছিলেন, কপিরাইট এনেই করেছিলেন। কেউ আঙুল তুলে কথা বলেনি। এখন তবে এসব করতে হচ্ছে কেন? ক্ষোভটা কপিরাইট নেওয়া না নেওয়া নিয়েও নেই। ক্ষোভটা ডাকাতি করা নিয়ে। ছবির বিশাল একটি অংশ পরিচালক সাজিয়েছেন তেলেগু ছবিটার ফুটেজ ডাকাতি করে। অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। এই পরিচালকই করেছেন। তবে এবার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছেন। যে দৃশ্যগুলোর শুটিং করতে পারবেন না, সেগুলো 'অথিধি' ছবি থেকে কেটে বসিয়ে দিয়েছেন। প্রতি ৫ মিনিটে গড়ে প্রায় দুটি করে ফুটেজ ডাকাতি করেছেন। নিতান্ত অপ্রয়োজনেও করেছেন। দুই সেকেণ্ডের একটা দৃশ্য, একটা দোলনা দুলছে। এই দৃশ্যটির শুটিং করা খুব কি খরচান্ত ব্যাপার! এখানে তো শাকিব খানের ডেট না পাওয়ার অভিযোগও করা যাবে না। ছবির সবগুলো মারামারির দৃশ্য সরাসরি ডাকাতি করা। দু-একটি দৃশ্যে তো তেলেগু ছবির নায়ক মহেশ বাবুকেও দেখা গেছে! ভিলেনদের মার খেয়ে প্রায় আধমরা মহেশ বাবু। পরের শটেই ক্যামেরায় শাকিব খান একই ডিজাইনের শার্ট পরিহিত। মজার বিষয় হচ্ছে শাকিবের শার্টটি নতুন ঝকঝকে এবং আয়রন করা। কি দরকার ছিল এত ঝামেলা করার। তেলেগু ছবিটা বাংলায় ডাবিং করে রিলিজ দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। সেন্সর বোর্ডে যারা ছবি দেখেন, তারা কি ঝাপসা এই দৃশ্যগুলো দেখে কিছুই বুঝেন না! একটা বাচ্চা ছেলেও এই দৃশ্য গুলো দেখে বলে দিতে পারবে, এটি একটি নকল ছবি এবং বিদেশি ছবির ফুটেজ চুরি করা। আমার জানা নেই, হয়ত সেন্সরবোর্ড নীতিমালায় এই অপকর্মগুলো 'জায়েজ'। ছবিটি দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে মনে হয়েছে এটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নয়, একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চৌর্যচিত্র।
দেশে ভারতীয় ছবির আমদানি বন্ধে আমাদের অনেকেই সোচ্চার। রাস্তায় নেমেছেন পরিচালকদের অনেকেই। যে ভারতীয় সিনেমা আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস করে দেবে বলে ধারণা, তাদের ঘরে এভাবে চুরি করা কতটা নৈতিকতার মধ্যে পড়ে? নাকি দর্শক ভারতীয় ছবি দেখতে না পেলে আপনাদের সুবিধা হয়? ইচ্ছে মতো ডাকাতি করার সুবিধা। যারা ভারতীয় ছবি না আনার পক্ষে রায় দিয়েছেন, একই সঙ্গে এটা কি তাদের সঙ্গে প্রতারণা নয়? এভাবে চলতে থাকলে হবে না। চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির কফিনে একের পর এক পেরেক ঠুকে চলেছেন আমাদের নির্মাতারা। নারায়ণ ঘোষ মিতা, জহির রায়হান, আমজাদ হোসেন, শহিদুল ইসলাম খোকনরা কি মৌলিক ছবি বানায়নি? কই, তখন তো কেউ ভারতীয় ছবি আমদানির পক্ষে রায় দেয়নি।
'দুর্ধর্ষ প্রেমিক' ছবির কাহিনী আর বলছি না। চট্রগ্রাম আর ঢাকা দেখানো হয়েছে ছবির গল্পে। নায়ক-নায়িকা যখন চট্রগ্রামে তখন যে লোকেশন দেখানো হয়েছে, ঢাকায়ও সেই একই লোকেশন! আর এই দুইটি জেলার শুটিং হয়েছে ব্যাংকক, এফডিসি ও ওয়ান্ডারল্যান্ডে। ব্যাংকক শহরকে ঢাকা ও চট্রগ্রাম বলে চালানো হয়েছে পুরো ছবিতে। সায়েন্স ফিকশন ছবি হলে ধরে নেওয়া যেত, কোনো এক সময় হয়ত ঢাকা-চট্রগ্রামের চেহারা এমন হতেও পারে। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় 'থাই' ভাষার পোস্টার, সাইনবোর্ড দেখলে ভয় লাগে। ভবিষ্যতে কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা 'থাই' ভাষায় রূপ নিবে? ঢাকার ওয়ান্ডারল্যান্ডকে ব্যবহার করা হয়েছে ঘরবাড়ির মতো। অসুবিধা নাই। কিন্তু কোনো লজিকও নাই। ঢাকায় যখন শুটিং হয়, ক্যামেরায় দেখা যায় লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুটিং দেখে। ব্যাংককে যখন শুটিং হয়, দেখা যায় একদল অর্ধনগ্ন সাদা চামড়ার বুড়ো শাকিব-অপুর নাচ দেখছেন। এর একটা লজিক হয়ত আছে, ব্যাংককের রাস্তায় বা বিচে এ রকম অদ্ভুত নাচ তারা আগে কখনো দেখেনি। তাই চোখ বের করে মজা লুটছেন। ছবিতে যত ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে এর বেশিরভাগই আপনি এই বঙ্গদেশে পাবেন না। পাবেন মহাভারতের অর্জুন-ভীম বা অন্যান্য হিন্দু দেবতাদের হাতে, আর পাবেন তামিল-তেলেগু ছবিতে। এই ছবির ভালো দিক হলো, গানের দৃশ্যগুলো মোটামুটি ভালো। চোখে আরাম দেয়।
[আজকের এ লেখাটিকে প্রচলিত অর্থে চলচ্চিত্র সমালোচনা বলব না। সমালোচনা পাওয়ার জন্যও কিছু যোগ্যতা লাগে, এ ছবিটার সেটিও নেই। লেখাটিকে প্রাসঙ্গিক ভাবনা বললেও দোষের হবে না।]
মূল লেখা এখানে
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১:৫৪