পাঠকের কাছে একটা প্রশ্ন রেখে লেখাটা শুরু করি।
‘'এই ঈদে মুক্তির জন্য যে ছবিগুলো লড়ছে, এর মধ্যে অন্তত দুটি ছবির নাম বলতে হবে আপনাকে। পারবেন?’'
প্রশ্নের ধরণ দেখে অনেকে বিরক্ত হচ্ছেন, এটা নিশ্চিত। মুখ দিয়ে দু-একটা কটূ বাক্য বের হয়ে আসলেও সেটা দোষের হবে না। কারণ, লেখকের কাছে পাঠক নতুন নতুন তথ্য জানতে চান। পাল্টা ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখি হলে পাঠক বিরক্ত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
তবে লেখকের কোনো কিছুই ফেলনা না। এই অবান্তর প্রশ্নটারও কোনো না কোনো মাজেজা আছে। মাজেজাটা হলো, এই একটা প্রশ্নের মধ্যেই ঈদ কেন্দ্রিক ঢাকাই ছবির ইতিহাস লুকিয়ে আছে। যারা ছবির ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন বা এই বিষয়টা নিয়ে যারা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন, এই দুই দলের বাইরে খুব কম লোকই এই ছবিগুলোর নাম জানেন। তার মানে দাঁড়ালো, ঈদের ছবি নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ এখন নেই বললেই চলে। কী ছবি মুক্তি পেল, কোনটা পেল না, কেন পেল না? কোনটা মুক্তি পেলে ভালো হতো, সেই চর্চাটা এখন সোনালি অতীত।
অথচ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার আগ মুহূর্তটাও কিন্তু বেশ জ্বলজ্বলে ছিল। বলছি নব্বইয়ের কথা। স্কুল পেরুনো কিশোর তখনো। পাড়ার সেলুনে সেলুনে হামলে পড়তাম ‘ইত্তেফাক’ পড়ার জন্য। পড়া আর কী! সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখাটাই ছিল গোপন উদ্দেশ্য। ছয় মাস পর কোন ছবিটা মুক্তি পাবে, তার বিজ্ঞাপনও আসত সেসময়। একদিকে জসিম-আলমগীর-কাঞ্চন-রুবেল, অন্যদিকে সালমান-ওমরসানি-নাঈম-আমিন খানদের ছবির বিজ্ঞাপন। কোনটা রেখে কোনটা দেখি অবস্থা। ছবিগুলোর কোনটাতে দিলদার আছে আর কোনটাতে নেই, বিজ্ঞাপনের এক কোনায় সেটাও দেখে নেওয়া যেত। ‘তোমাকে চাই’ ছবিটা ঈদে আসার কথা থাকলেও কেন আসছে না, বন্ধুদের সাথে সেটা নিয়ে এক চোট গসিপও হয়ে যেত। গসিপের যোগান আসত পাক্ষিক কিছু পত্রিকা আর চিত্রালীর ভাণ্ডার থেকে। বন্ধুরা এমনভাবে সে সব গসিপ করত, যেন ঘটনার সময় সে নিজে উপস্থিত ছিল। মৌসুমী-শাবনূররা তাদের বন্ধুস্থানীয় কেউ, অবসর সময়ে এসে তাদের এইসব গল্প শুনিয়ে গেছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি একটা অবস্থা তৈরি হতো আমাদের মনে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস দূরে ঠেলে দিয়ে আমরা সেসব কথায় ‘মজা’ খুঁজে নিতাম। ভেতরে ভেতরে সিনেমা হলে যাওয়ার আগ্রহটাও বেড়ে যেত। স্কুল পালিয়ে, সাইকেল ভাড়া করে চলে যেতাম জেলা সদরে। রিয়ার স্টলে ছারপোকার কামড় খেয়ে চুলকাতে চুলকাতে যখন ঘরে ফিরতাম, দেখতাম লাঠি হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে অভিভাবকদের কেউ একজন। মার খাওয়ার ঘটনাও আছে। তবে সেসবও ভুলে যেতাম। রাতে যখন স্বপ্নের রাজ্যে নায়ক-নায়িকারা হানা দেয়, অভিভাবকদের লাঠিও তখন আর ঘরে আটকে রাখতে পারে না। আশি-নব্বই দশকের সব কিশোরের সিনেমা দেখা আর ‘সিনেমা দর্শন’ বলতে গেলে এরকমই। অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো।
আর এখন? পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের কথাই যদি ধরি, বলতে হবে ইত্তেফাকের সেই সোনালি চর ডুবে গেছে। প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, সমকালের তীরেও নতুন চর জাগতে দেয়নি। চলতি সপ্তাহে হলে যে ছবি চলছে, তার বিজ্ঞাপনও দেখা যায় না এখনকার পত্রিকাগুলোতে। সিনেমাওয়ালারা বলেন ‘ব্যবসা’ নাই। বিজ্ঞাপন দিয়ে লসের খাত বাড়িয়ে কী লাভ?
আর এখনকার কিশোরেরা বাসায় বসে কম্পিউটারে ভিডিও গেমসে মত্ত। ফেসবুক, টুইটার যেভাবে তাদের টানে সিনেমা হল ঠিক ততটাই বিপরীত মেরুতে দূরে ঠেলে দেয়। খুব পছন্দের কোনো ভালো ছবি এলে ঘরে বসেই দেখে নেওয়া যায়। স্কুল পালিয়ে, সাইকেল ভাড়া করে সিনেমা দেখার মধ্যে যে রোমান্টিসিজম, এখনকার কিশোররা তা কল্পনাও করতে চাইবে না।
তবুও প্রতি বছর ঈদ আসে ঈদের নিয়মে। ছবি মুক্তি পায় হল ঘরের নিয়মে। বরং এখনকার ঈদে গণ্ডায় গণ্ডায় ছবি মুক্তি পায়। কিন্তু সে ছবিগুলোর নাম মুখে আনতে এখন অনেকেই লজ্জাবোধ করেন। নাম কিন্তু খারাপ না। ইংরেজি ছবির নাম '‘রিভেঞ্জ'’ হলে ভালো, বাংলা ছবির নাম ‘'প্রতিশোধ'’ হলেই খারাপ। আমাদের মনোভাব অনেকটা এরকমই। ছবি দেখাটা মানুষ এখন ‘'ফাতরা'মি’ মনে করে। কেউ বাংলা ছবি দেখে, এটা শুনলেই আশপাশের অনেকে ভ্রু কুঁচকে নাকে রুমাল চেপে তাকায়। যারা ছবি দেখেন, তারা লুকিয়েই দেখেন। এখন আর ঢোল পিটিয়ে সিনেমা নিয়ে কাউকে আড্ডায় সরগরম হতে সচরাচর দেখা যায় না।
সত্তরের দশক থেকেই ঈদের ছবি নিয়ে আগ্রহ বেড়ে যেত দর্শকের। যারা আগে সেন্সর করিয়ে প্রিন্ট করাতে পারতেন, তারাই নিজেদের ছবি মুক্তি দিতেন। প্রথম দিকে প্রতি ঈদেই দুটি করে ছবি মুক্তি পেত। এর পর দেখা গেল নির্মাতাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ঈদে ছবি মুক্তি দেওয়া মানেই বাড়তি ব্যবসা। এই মনোভাব থেকেই আশির দশকে ঈদের ছবি ২ থেকে ৪ সংখ্যায় উত্তীর্ণ হয়। তাও ঢাকা ও তার আশপাশে মুক্তি পেত দুটি, ঢাকার বাইরে মফস্বল এলাকায় মুক্তি পেত বাকি দুটি। ছবির প্রিন্ট করানো হলে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন হতো, ধূপবাতি জ্বালাতেন কেউ কেউ। এফডিসি পরিণত হতো মেলায়। চারদিকে একটা উৎসব উৎসব ভাব ছড়িয়ে থাকত। নব্বইয়ের দশকে এসে ঈদের ছবি নিয়ে এক ধরনের জুয়া খেলা শুরু হলো। নির্মাতারা মনে করতেন ঈদে ছবি মুক্তি পেলেই গায়ে আভিজাত্যের তকমা সেঁটে যায়। শুরু হলো অদ্ভুত সব খেলা। ৯৬ সালে মুক্তি পেল ৬টি ছবি। ব্যবসাসফল মাত্র ২টি। এর পরের বছরই এক ঈদে মুক্তি পেল ১৩ টি ছবি। ধরা খেল সবগুলো ছবি। তবু থামেনি সেই জোয়ার। ৯, ৮, ৭ পরের ঈদগুলোতে মুক্তি পাওয়া ছবির সংখ্যা এই ঘরেই ওঠানামা করল। ব্যবসা এবং দর্শক থমকে গেল। দর্শক কোন ছবি দেখবে কেন দেখবে, সেটা স্থির করতে না পারাই ব্যবসায়িক ভরাডুবির কারণ। এই দশকের শুরুতে কালচার এলো টেলিভিশনে ছবির মুক্তি দেওয়ার। বাকি সর্বনাশ হলো টিভিতে এসেই। ৯৮ সালের ‘হঠাৎ বৃষ্টি’র উদাহরণ দিয়ে প্রতিবছরই কিছু নির্মাতাদের জোর করে পথে বসিয়ে দেওয়া হয়। অথচ অনেকেই বোঝেন না, ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ তার নামের মতোই ‘অনিশ্চিত’। এই অনিশ্চয়তায় এ বছরও আমরা পা রাখছি। ‘হঠাৎ সেদিন’ ও ‘আÍদান’ নামের দুটি ছবি দেখানো হবে টেলিভিশনে। শাকিব খান অভিনীত চারটি ছবি মুক্তির জন্য প্রস্তুত। প্রস্তুত নিরব-নিপুণের ‘তুমি আসবে বলে ভালোবাসবে বলে’। মূলত সিনেমা হলে শাকিব খান তাঁর নিজের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করবেন। বিগত চার বছর তিনি তাই করে আসছেন। তবে এবারের বিষয়টা ভিন্ন। প্রযোজকরা ভয় পাচ্ছেন, এটাই হয়ত তারকা শাকিবের শেষ ঈদ। তাই কোনো প্রযোজকই ঝুঁকিটা নিতে চাইলেন না। শেষ ব্যবসাটা যদি তিনি করতে পারেন, তাহলে তো পোয়াবারো।
সবশেষে বিনীতভাবে বলি, ‘গরিবের আবার ঈদ কি?’ চলচ্চিত্রে যে সামগ্রিক পচন ধরেছে, সে পচনের দাওয়াই না পেলে শেষ রক্তবিন্দুও হয়ত মাটি হয়ে যাবে। পচা মস্তিস্কগুলো দূরে ঠেলে দিয়ে নতুন তরতাজা মস্তিস্ক আমদানি করতে হবে। তখন দেখবেন, ঈদের আনন্দ কিভাবে দ্বিগুণ হয়ে ওঠে।
সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন, পছন্দের বই হচ্ছে পঠনশীল সাহিত্য। একটা সময় আসবে যখন মানুষ পড়ার সময় পাবে না, সাহিত্য দেখবে পর্দায়। সেই সাহিত্য দর্শন থেকে আমরা দূরে চলে এসেছে, সরে যাচ্ছি। কারণটাও পরিস্কার, আমাদের এখানে পর্দায় যা দেখা যায়, তার সঙ্গে সাহিত্যের কোনো সম্পর্ক নেই। ইশ্বর জানেন, কী আছে এই ফাঁকা মস্তিস্কের জনসমুদ্রের ভাগ্যে!
[একটি ঈদ ম্যাগাজিনের জন্য লিখেছিলাম]