''শালবৃক্ষের মতো শিনা টান করে সে, মানুষ হয়ে বাঁচতে পীরেন জান দিয়েছে।''
কয়েকদিন আগে শুনা এই গানটা বারবার আমার কানে বাজছে। একটু ঘাটাঘাটি করে জানতে পারলাম গানটা আধিবাসি ব্যান্ড ‘মাদল’ এর। গানটা তারা গেয়েছে ২০০৪ সালে মধুপুর-ভাওয়াল গড়ে আধিবাসি বিক্ষোভ এ শহিদ ‘পীরেন স্লান’ কে উৎসর্গ করে। নিজের ভেতর একটা অপরাধবোধ কাজ করা শুরু করতে লাগলো। টাঙ্গাইলের মানুষ হয়েও পীরেন স্লান অথবা ওইদিনের বিক্ষোভ নিয়ে তেমন কিছুই জানিনা। সেই অপরাধবোধ থেকেই আজকের এই লেখার চেষ্টা।
টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ জেলার মধুপুর গড় এলাকা একসময় ছিলো বিস্তির্ন বনভুমি। শালবনে আচ্ছাদিত এই এলাকায় বাস করতো মাটির সন্তান মান্দি(মান্দাই), কোচ, বর্মনসহ নানা জাতিসত্ত্বার লোকজন। এই শালবন তাদের মায়ের মতো আগলে রেখেছে দিনের পর দিন-যুগের পর যুগ । তাদের বৈচিত্রময় জীবনাচার-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এই শালবনকে কেন্দ্র করে। নিজেরা বনকে রক্ষা করেছে, ভালবেসেছে। নিজেদের অস্তিত্ত্বের সাথে যেন মিশে ছিলো এই শালবন। তারা বিশ্বাস করতো বন তাদের রক্ষাকর্তা। মান্দি সম্প্রদায়ের কাছে শালবন প্রচলিত ছিলো “হা-বিমা” হিশেবে। এই “হা-বিমা” ছিলো তাদের কাছে অনেক পবিত্র। শালবনের প্রত্যেকটা গাছ,পাখি,জীব-জন্তু তাদের কাছে পরম পুজনিয়। বনের সাথে ছিলো তাদের অকৃত্রিম প্রেম। শালবনের নিজস্ব চাষ-পদ্ধতীতে তারা ঘরে তুলতো নানা ধরনের ফসল । বনের ভিতর ছিলো তাদের অবাধ বিচরণ। বন থেকে ফল-মুল অথবা অন্যান্য উপকরন সংগ্রহ করতে কারো অনুমতির প্রয়োজন পরেনি। সারাদিনের পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় মাদলের সুরে নেচে-গেয়ে জীবনটাকে উপভোগ করতো তারা।
কিন্তু দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকেই শালবন থেকে তাদের উচ্ছেদ করার জন্য শুরু হয় নানা আয়োজন। এই শালবনকে বাঁচাতে, নিজেদের অস্তিত্ত্বকে রক্ষা করতে সেই সময় থেকেই নানা প্রতিরোধ-প্রতিবাদ গড়ে তোলে তারা। ২০০৩ সালে ক্ষমতাসীন সরকার আধিবাসিদের সাথে কোন প্রকার আলোচানা ছাড়াই মধুপুর ইকোপার্ক নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা কেউই মেনে নিতে পারেনি তাদের জননীভুমিকে দেয়ালবেষ্টিত করা হবে। তাদের বুকের ভেতর থাকা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি সহসাই জ্বল্ব ওঠে দাও দাও করে। এই প্রতিবাদ এর ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ৩রা জানুয়ারী পুঞ্জিভুত ক্ষোভ তাদের নিয়ে যায় মিছিলে। তাদের অন্নদাত্রী এই বনভুমিকে রক্ষা করতে মিছিলে আসে হাজার হাজার মান্দি, কোচ, গারো, বর্মন জাতিসত্ত্বার মানুষেরা । দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পরে পুরো শালবন জুড়ে। কিন্তু সহস্র আধিবাসির বিপ্লবী চেতনাকে ম্লান করে দিতে সেদিন মিছিলে গুলি চালায় কাপুরুষ বনরক্ষী আর সরকারের পুলিশবাহিনী। সেদিন পুলিশের গুলিতে প্রান দেন মান্দি সম্প্রদায়ের টগবগে প্রতিবাদি যুবক ‘পিরেন স্লান”। আহত হন অসংখ্য মানুষ। নিভু-নিভু হয়ে আসে তাদের আশার প্রদীপ।
যে আধিবাসিরা যুগের পর যুগ ধরে রক্ষা আসছিলো এই বনভূমি । যেই আধিবাসি ছেলেটা সবচেয়ে পবিত্র মনে করতো তাদের এই ‘হা-বিমা’ কে। তাদেরই বুকের রক্ত ঝরিয়ে, তাদেরই বুকের রক্তের উপর রাষ্ট্র নির্মান করলো ইকো-পার্ক। স্রেফ একটা পিকনিক স্পট (!) ।
১৪ বছর আগে এমনি কোন এক দিনে ভোরবেলায় গুলিবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয় পীরেন স্লান’কে। আহত মানুষ গুলোর অনেকেই সেদিন পংগুত্ব বরন করে নিয়েছিলেন। যেমন মেনে নিয়েছিলেন পীরেন এর পরিবার, তার ছোট্ট দুটি শিশু-সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রী। কারন তারা জানেন,
“এই বন যতদুর
ততদূর আমার বাড়ি
আহা ! এই মাটিতেই
পোঁতা আছে আমার নাড়ী
সেই নাড়ী ধরে কারা যেন টান দিয়েছে
তাই রুখতে পীরেন স্লান জান দিয়েছে।“
রাষ্ট্র জননীভূমি থেকে করেছে তাদের উৎখাত। জন্মাধিকার থেকে করেছে তাদের বঞ্চিত। শহিদ পীরেনের বুকের রক্তের উপর তৈরী করেছে প্রমোদকেন্দ্র। থেতো করে দিয়েছেন অসংখ্য জীবন। হয়তো ভেবেছেন নিভিয়ে দিয়েছেন বিদ্রোহের আগুন। একবার পীরেনের সন্তানদের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখবেন। তাদের চোখে যে আগুন জ্বলছে, একদিন ঐ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন আপনি,আমি , আমরা সবাই।
তথ্যঃ ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:১৯