এটি একটি সিরিজ লেখা, প্রথম পর্বটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
আজকে প্রথমেই আলোচনা করব সুন্নাত নিয়ে এবং তারপর হাদীসের উৎস নিয়ে আলোচনা করব।
সুন্নাত কাকে বলে?
হাদীসের অপর নাম হচ্ছে, "সুন্নাত"। 'সুন্নাত' শব্দের অর্থ হল চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি।
'সুন্নাতুন্নবী' বলতে সে পথ ও রীতি পদ্ধতি বুঝায় যা নবী (স) বাছাই করে নিতেন ও অবলম্বন করতেন। সুন্নাতকে কখনও হাদীস শব্দের সমার্থকরূপে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং সুন্নাত অর্থ নির্ধারণও আমরা বলতে পারি।
'সুন্নাত' শব্দটি সম্পূর্ণরূপে ও সর্বতোভাবে 'হাদীস' শব্দের সমান নয়। কেননা 'সুন্নাত' হলো রাসূল (স) এর বাস্তব কর্মনীতি, আর 'হাদীস' বলতে রাসূল (স) এর কাজ ছাড়াও কথা ও সমর্থন বুঝায়।
হাদীসের উৎস কি?
হাদীসের মূল উৎস অহী। অহীর আভিধানিক অর্থ গোপন ইশারা। আর এই ইশারা ইংগিত কথার মাধ্যমে হতে পারে। আবার কখনো রূপবিহীন শুধু শব্দও হতে পারে। আবার হতে পারে কোন অংগ বা লিখনীর ইশারায়।
আবু ইসহাক সুখাভী লিখেছেন:
গোপনে অভিহিত করা। সকল আভিধানে অহীর এ অর্থ করা হয়েছে।
শেখ আব্দুল্লাহ সরকাভী বলেন:
অহীর অর্থ গোপনে জানিয়ে দেয়া। আর শরীয়তের পরিভাষায় কথা বলে বা ফেরেশতা পাঠিয়ে কিংবা স্বপ্নযোগে অথবা ইলহামের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীদেরকে কোন বিষয় সম্পর্কে অভিহিত করা। কখনো নির্দেশ দান অর্থে অহী ব্যবহৃত হয়।
রাসূল (স) এর কাছে অবতীর্ণ আল্লাহর অহী দুই প্রকার। অহীয়ে মাতলু বা পঠিতব্য অহী। জিব্রাইল (আ) আল্লাহর যে বাণী রাসূলের কাছে নিয়ে আসতেন সেগুলো শব্দ ও বাক্যে হুবহু তিনি পাঠ করে হেফাজত করতেন। এই পঠিতব্য হুবহু অহীই আল-কুরআন। দ্বিতীয় প্রকার অহীকে গায়রে মাতলু বলা হয়, এই অহী দ্বারা প্রাপ্ত মুলভাব রাসূল (স) নিজের ভাষায় প্রকাশ করতেন। এ সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানের নাম হাদীস আর এ অর্থে হাদীসকে অহীয়ে গায়রে মাতলু বলা হয়।
মুহাম্মদ (স) বিশ্বনবী বা রাসূল হওয়ার সাথে সাথে তিনি ছিলেন মানুষও। কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে-
অর্থ: "আমি তোমাদের মত মানুষ; তবে আমরা কাছে অহী আসে"।
কুরআনে আরো বলা হয়েছে-
"অর্থাৎ নবী নিজের ইচ্ছায় কোন কথা বলেন না, যা বলেন তা অবতীর্ণ অহী ছাড়া আর কিছুই নয়।" (কুরআন ৫৩: ৩-৪)
এ দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর কার্যাবলীকে নবীসূলভ ও মানবসূলভ এ দু'ভাগে ভাগ করা যায়। নবী সূলভ কার্যাবলীর মধ্যে আছে পরকাল, উর্ধ্বজগত, ইবাদত, সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম শৃংখলা, জকল্যাণকর নীতি, আমল-আখলাক সম্পর্কিত বিষয়বস্তু। এগুলোর উৎস অহীর সমমর্যাদা সম্পন্ন।***(নীচে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে)
মানবসুলভ কার্যাবলীর মধ্যে আছে চাষাবাদ, চিকিৎসা, বস্তুর গুণাগুণ, অভ্যাস কিংবা সংকল্প ব্যতীত ঘটনাক্রম কার্য, প্রচলিত কাহিনীমূলক, সাময়িক কল্যাণ মূলক এবং বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ক। এগুলোর উৎস রাসূল (স) এর অভীজ্ঞতা, ধারণা, অভ্যাস আঞ্চলিক প্রথা ও স্বাক্ষ্য প্রমাণ।***(নীচে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে)
অহী ও ইজতিহাদের সূত্রে প্রাপ্ত হাদীসের অনুসরণ প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। আর দ্বিতীয় প্রকারের সূত্রে বর্ণিত হাদীসের যেগুলো রাসূল (স) পছন্দ করতেন সেগুলোর আমাদের অনুকরণীয় আবশ্যিক নয়।
এ সম্পর্কে ইমাম নববী শরহে মুসলিমে বলেন:
"আলেমগণ বলেন: নবীর এ ধরনের কথা (মানব সুলভ) হাদীসের পার্যায়ে ছিল না। বরং ধারণামাত্র ছিল যা এ ধরনের রেওয়েত সমূহে উল্লেখ হয়েছে। তাঁরা আরো বলেছেন: বৈষয়িক ব্যাপারে রাসূল (স) এর ধারণা অন্যান্য মানুষের ধারণার মতই। সুতরাং এরূপ ঘটনা ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয় এবং তাতে দোষও নেই।
রাসূল (স) বলেছেন:
আমি একজন মানুষ। তোমাদের দ্বীন(জীবন ব্যবস্থা) সম্পর্কে যখন আমি তোমাদরেকে কোন কিছুর আদেশ করি তখন তা গ্রহণ কর, আর যখন আমার নিজ রায় থেকে কোন কিছুর আদেশ করি তখন মনে রেখো আমি একজন মানুষ মাত্র।
মোটকথা হলো, দৈনন্দিন জীবনের বৈষয়িক ও ব্যবহারিক ব্যাপারে রাসূল (স) এর কথা সাধারণ মানুষের মতই। এরূপ সব কথাই সত্য প্রমাণিত হওয়া অপরিহার্য নয়। মদীনায় খেজুর গাছ সম্পর্কে আরবদের নিয়ম সম্পর্কে যে নিষেধবাণী করেছিলেন তা এ পর্যায়ের ছিল।
***জাগতিক বিষয়গুলো মানুষ অভিজ্ঞতা ও গবেষণার মাধ্যমে জানতে পারে। কিভাবে চাষ করলে বেশি ফল ফসল হবে, কিভাবে বাড়ি বানালে বেশি টেকশই হবে, কিভাবে গাড়ি বানালে দ্রুত চলবে, কিভাবে রান্না করলে খাদ্যমানের বেশী সাশ্রয় হবে ইত্যাদি বিষয় মানবীয় অভিজ্ঞতা, গবেষণা, যুক্তি ও চিন্তার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত ব্রেইন খাঁটিয়ে জানতে পারে। কিন্তু আল্লাহর আদেশ কিভাবে মানতে হয়, আল্লাহ কি কি কাজ করতে আমাদের আদেশ করেছেন আর কি কি করতে নিষেধ করেছেন, কিভাবে দেশ-রাষ্ট্র আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী চালানো যায়, কোন অপরাধ বিষয়ে আল্লাহর আইন কি, কিভাবে হালাল ব্যবসা করা যায়, কিভাবে কাজ করলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন ইত্যকার এইসব নিয়মগুলো মানুষ নিজস্ব চিন্তার মাধ্যমে জানতে পারে না, এর জন্য কুরআন ও রাসূল (স) সুন্নাহ'র দারস্থ হতে হয়।
এর পরবর্তী পোস্টে হাদীসের শ্রেণীবিভাগ নিয়ে আলোচনা করব, ইনশাল্লাহ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১১:৪৭