প্রথম পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন
সামনেই পবিত্র রমাদান মাস। রোজা বা সাওম নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক কথা প্রচলিত যা আমরা হাদীস হিসেবে জানি কিন্তু বাস্তবে সেগুলো কোন হাদীস নয়। আজকে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করবঃ
১. সিয়াম বা রোজার নিয়তঃ
আমাদের সমাজে প্রচলিত একটা কমন নিয়ত যেমন.. নাওয়াইতু আন.... আপনারা সকলেই এর সাথে পরিচিত। এ জাতীয় সকল প্রকার নিয়তের কোন ভিত্তি নেই, বানোয়াট কথা। কোন ইবাদতের এরুপ নিয়্যত পাঠ করার কথা কোন হাদীসে বলা হয়নি। এগুলো পরবর্তী যুগের আলিমদের বানানো। রাসূলূল্লাহ (স) এরুপ নিয়্যাত পাঠ করেছেন বা এভাবে নিয়্যত করতে বলেছেন বলে মনে করলে বা দাবি করলে তা ভিত্তিহীন মিথ্যা দাবি হবে।
নিয়্যত অর্থ উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা। উদ্দেশ্যের উপরেই ইবাদতের সাওয়াব নির্ভর করে। নিয়্যত মানুষেল অন্তরের অভ্যন্তরীন সংকল্প বা ইচ্ছা, যা মানুষকে উক্ত কর্মে ইদ্বুদ্ধ বা অনুপ্রাণিত করে। নিয়্যত করতে হয়, বলতে বা পড়তে হয় না। রাসূলূল্লাহ (স) কখনো জীবনে একটি বারের জন্যও ওযু, গোসল, নামায, রোযা ইত্যাদি কোন ইবাদতের জন্য কোন প্রকার নিয়্যত মুখে বলেননি। তাঁর সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ, ইমাম আবু হানীফা (রহ) সহ চার ইমাম বা অন্য কোন ইমাম ও ফকীহ কখনো কোন ইবাদতের নিয়্যত মুখে বলেননি বা বলতে কাউকে নির্দেশ দেননি। পরবর্তী যুগের কোন আলিম এগুলি বানিয়েছেন। তাঁরাও বলেছেন যে, মুখের উচ্ছারণের কোন মূল্য নেই, মনের মধ্যে উপস্থিত নিয়্যতই মূল।১
২. ইফতার, সাহরী ইত্যাদি খানার হিসাব না হওয়া
সমাজে প্রচলিত আছে যে, সাহরী ইত্যাদি খাওয়ার হিসাব নেই। এই অর্থের বানোয়াট হাদীসের মধ্যে রয়েছে:
"তিন ব্যক্তির পানাহারের নেয়ামতের হিসাব গ্রহণ করা হবে না; ইফতার-কারী, সাহরীর খাদ্যগ্রহণকারী ও মেহমান-সহ খাদ্য গ্রহণকারী।"২
এসকল ভিত্তিহীন কথাবার্তার কারণে রমাদান মাসকে আমরা 'নিজে খাওয়ার' মাসে পরিণত করেছি। অথচ রমাদান হলো অন্যকে খাওয়ানোর ও সহমর্মিতার মাস। এছাড়া আমাদের হিসাব হবে কিনা তা বিবেচনা না করে 'সওয়াব বেশি হবে কিনা' তা বিবেচনা করা উচিত।
৩. সাহরীর ফযীলত ও সাহরী ত্যাগের পরিণাম
সাহরী খাওয়ার উৎসাহ প্রদান করে একাধিক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অন্তত এক চুমুক পানি পান করে হলেও সাহরী খেতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সাহরীকে বরকতময় আহার বলা হয়েছে। এ কথাও বলা হয়েছে যে, ইহুদী ও খৃস্টানদের সিয়ামের সাথে আমাদের সিয়ামের পার্থক্য সাহরী খাওয়া।
কিন্তু এসকল সহীহ ও হাসান হাদীসের পাশাপাশি কিছু অতিরন্জিত বানোয়াট হাদীসও প্রচলিত আছে। যেমন: "রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন... সাহরীর আহারের প্রতি লোকমার পরিবর্তে আল্লাহ তা'আলা এক বছরের ইবাদতের সওয়াব দান করবেন।... যে সাহরী খেয়ে রোজা রাখবে সে ইহুদীদের সংখ্যানুপাতে সওয়াব লাভ করবে।... তোমাদের মধ্যে হতে যে ব্যক্তি সাহরী খাওয়া হতে বিরত থাকবে তাহার স্বভাব চরিত্র ইহুদীদের ন্যায় হয়ে যাবে"।...৩
এসকল কথা সবই জাল ও বানোয়াট কথা বলেই প্রতীয়মান হয়।
৪. জুমু'আতুল বিদা বিষয়ক জাল কথা
সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, জুমু'আর দিন বা সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। সূর্যের নীচে এর চেয়ে উত্তম দিন আর নেই।৪ অনুরুপভাবে রমাদানও শ্রেষ্ঠ ও বরকতময় মাস।৫ কাজেই জুমআর দিনটি মর্যাদা হিসেবেই অনুমেয়। মুমনিগণ স্বভাবতই জুমআর দিন নেক আমল বেশী করে করার চেষ্ট্রা করে একইভাবে রমাদান মাসেই প্রত্যেক মুমনিই সাধ্যমত চেষ্ট্রা করে নেক আমল বেশী করে করার জন্য। আর জুমআর দিন উভয়প্রকার চেষ্ট্রা একত্রিত হয়।
তবে রমাদান মাসের শেষ জুমআর বিশেষ কোন ফযীলত সম্পর্কে কোন সহীহ বা যয়ীফ হাদীস বর্ণিত হয়নি। বিদায়ী জুমআ বলে কিছূ নেই। জুমু'আতুল বিদা বিষয়ক যত ফযিলত বর্ণনা আছে সেগুলোর হাদীস হিসেব কোন স্বীকৃতি নেই। তবে কেউ কেউ নেম্নোক্ত জাল কথাটিকে
হাদীস হিসেবে চালিয়ে দেন:
"যদি কোন ব্যক্তি রমাদান মাসের শেষ জুম'আর দিনে এক ওয়াক্ত (অন্য জাল বর্ণনায় ৫ ওয়াক্ত) কাযা সালাত আদায় করে তবে ৭০ বছর পর্যন্ত তার সকল কাযা সালাতের ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে।"
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই কথাটি জাল বা মিথ্যা।৬
১. এহইয়াউস সুনান, পৃ ১০৬
২. সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ ১২১; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/১৬৬; তাহের ফাতানী, তাযকিরা, পৃ ৭০; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৪।
৩. মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ ৩৩-৩৪
৪.মুসলিম, আস সহীহ ২/৫৮৯; ইবনু খুযাইমা, আস সহীহ ৩/১১৫; ইবনু হিব্বান আস-সহীহ ৩/১৯১।
৫. বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৩/৩১৪,৩৫৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৪০।
৬. মোল্লা কারী, আ-আসরার পৃ ২৪২; আল-মাসনূ, পৃ.১৫৬-১৫৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ, ১/৭৯।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ৯:৩৮