সহীহ হাদীস থেকে আমরা পাই, রাসূল (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যা আরোপ করে সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়। ( সহীহ আল বুখারী, ইলম অধ্যায়)
১. কিছু সময় চিন্তা করা হাজার বছরের ইবাদত থেকে উত্তম
এরকম বানোয়াট হাদীসের মধ্যে রয়েছে:
"এক মুহুর্ত বা কিছু সময় চিন্তা-মুরাকাবা করা এক বছর ইবাদত করা থেকে উত্তম"। কেউ কেউ বাড়িয়ে বলেছেন, ৭০ বছরের ইবাদত থেকে উত্তম। আর কেই আরেকটু বাড়িয়ে বলেছেন, হাজার বছরের ইবাদত থেকে উত্তম।
মুহাদ্দিসগণ হাদীসটি জাল বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলূল্লাহ (স) এর কথা হিসাবে তা মিথ্যা। কথাটি পূর্ববর্তী কোন আলিমের উক্তি মাত্র।১
২. শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কালি উত্তম।
ইলমের ফজিলতে বানানো অন্য একটি জাল হাদীস:
"শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কালি উত্তম"।
সাখাবী, যারকানী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস জানিয়েছেন যে, কথাটি খুব সুন্দর শোনালেও তা রাসূলূল্লাহ (স) এর কথা নয়। যারকাশী বলেছেন: বাক্যটি আসলে হাসান বসরী (রাহ) উক্তি।২
৩. আসরের পর লেখাপড়া না করা
আমাদের দেশে অনেক আলিম ও মাদ্রাসা-ছাত্রের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, আসরের পরে লেখাপড়া করলে চোখের ক্ষতি হয়। একটি বানোয়াট হাদীস থেকে ধারণাটির উৎপত্তি। উক্ত বানোয়াট হাদীসটিতে বলা হয়েছে:
"যে ব্যক্তি তার চক্ষূদ্বয়কে ভালবাসে সে যেন আসরের পর না লেখে।"
কথাটি হাদীস নয়। এর কোন ভিত্তি নেই। কম আলোতে, অন্ধকারে বা আলো-আধাঁরিতে লেখাপড়া করলে চোখের ক্ষতি হতে পারে। ডাক্তারগণ এ বিষয়ে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোন হাদীস নেই।৩
৪. চীনদেশে হলেও জ্ঞান সন্ধান কর।
আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত একটি কথা:
"চীনদেশে হলেও জ্ঞান সন্ধান কর।"
অধিকাংশ মুহাদ্দিস একে জাল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ একে দুর্বল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। সনদ* বিচারে দেখা যায় দুইজন অত্যন্ত দুর্বল রাবী**, যারা মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করতেন শুধুমাত্র তারাই হাদীসটিকে রাসূলূল্লাহ (স) এর কথা বলে চালিয়ে দেয়।৪
৫. রাতের কিছু সময় ইলম চর্চা সারা রাত জেগে ইবাদতের চেয়ে উত্তম
আমাদের দেশের প্রসিদ্ধ একটি গ্রন্থে বলা হয়েছে, "বোখারী শরীফের আরও একটি হাদীসে আছে,
"হযরত (দ) বলেছেন, রাত্রির এক ঘন্টা পরিমাণ (দ্বীনী) এলেম শিক্ষা করা সমস্ত রাত্রির জেগে দাড়িয়ে ইবাদত করার চেয়ে ভাল"।৫
এই কথাটি সহীহ বুখারীতো দূরের কথা অন্য কোন হাদীস গ্রন্থেই রাসূলূল্লাহ (স) এর বাণী হিসাবে সংরক্ষিত হয়নি। ইমাম দারিমী তার সুনান গ্রন্থে অত্যন্ত দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন সনদে সাহাবী ইবনু আব্বাসের (রা) বাণী হিসাবে কথাটি সংকলন করেছেন। রাসূলূল্লাহ (স) এর নামে এ অর্থে যা কিছু বলা হয়েছে সবই জাল ও বানোয়াট।৬
*সনদ: হাদীসের মূল কথাটুকু যে সূত্রে ও যে বর্ণনা পরম্পরা ধারায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌছেছে তাকে ইলমে হাদীসের পরিভাষায় সনদ বলা হয়।
**রাবী: যিনি হাদীস বর্ণনা করেন।
১. মোল্লা কারী, আল-আসরার, ৯৭ পৃ, আলবানী, জয়ীফুল জামিয় ৫৮১ পৃ।
২. সাখাবী, আল-মাকাসিদ, ৩৭৭ পৃ, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ ১৭২পৃ, মুল্লা কারী, আল আসরার, ২০৭পৃ, আল-মাসনূয়, ২৫৫পৃ, শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৩৬৯।
৩. সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩৯৭; মুল্লা কারী, আল- আসরার, পৃ: ২১৬; আল -মাসনূ, পৃ:১৪১; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৭৮।
৪. ইবনু আদী, আল-কামিল ১/২৯২, ইবনুল জাউযী, আল-মাউযূআত ১/১৫৪, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ ৮৩, আলবানী, সিলসিলাতুল যায়ীফা ১/৬০০,নং ৪১৬।
৫. মো. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো'মেনীন পৃ.২৫।
৬.দারিমী, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রাহমান (২৫৫ হি), আস-সুনান ১/৯৪,১৫৭;ইবনু ইরাক, তানযীহ।
আমাদের সমাজে বহুকথা প্রচলিত আছে যা মোটেও হাদীস নয় কিন্তু সেগুলো হাদীস হিসেবে পরিচিত, পর্যায়ক্রমে ইনশাল্লাহ আমি সেগুলো তুলে ধরব। আমি যদি কোন ভুল করি তাহলে সঠিক রেফারেন্স সহ আমাকে জানান আমি ঠিক করে নিব। আপনারা শুনে অবাক হবেন, মাধ্যমিক স্তরের ইসলাম ধর্ম বইগুলোতে জাল হাদীস দেওয়া আছে। যা খুবই দুঃখজনক। ইনশাল্লাহ, পর্যায়ক্রমে আমি তাও তুলে ধরব। মহান আল্লাহ আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ার হাত থেকে হিফাজত করুন এবং সঠিক ইলমে জ্ঞান অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।