গ্র, ঋ, তৃ, লৃ। আমি ঋ। আমরা সবাই খুব ভালো বন্ধু। চারজন একসাথে ঘুরি ফিরি আড্ডা মারি। আমার আর তৃ এর ধারণা, গ্র আর লৃ এর মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে। লোকে বলে আমার সাথে তৃ এর অ্যাফেয়ার। আমি জানি, সবাই একসাথে অসম্ভব ভালো সময় কাটে আমাদের। তবে, তৃএর সাথে আমার বন্ধুত্ব অতি আদি।
তৃ আমার জন্যে ঈদের শার্ট কিনতে আমাকে নিয়ে বের হবে, আমার সময় নেই। অ্যাসাইন্টমেন্ট জমা পরশু। তৃ একাই চলে গেল।
সেদিন লৃ এল। বলল, গ্রও মার্কেটিং এ গেছে। আমাকে নিতে চেয়েছিল।
তুমি যাও নি কেন?
মার্কেটে ঘোরাঘুরি একদম পছন্দ না। গ্রকে তাই তৃএর সাথে পাঠিয়ে দিয়েছি - লৃ বলল।
ভালো করেছো। দুই মার্কেটখোর এক হলে মার্কেটিং আরো এফিশিয়েন্ট হবে, কি বল?
ঠিক!
মার্কেটে ঘোরাঘুরি আমারও পছন্দ না, আমি বললাম।
তাই বলেছো তৃ-কে?
নাহ্, তা না। আমার একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে।
লৃ সাথে সাথে বলল, তাহলে তুমি অ্যাসাইনমেন্ট করো। ডিস্টার্ব করবো না।
আমি বললাম, ডিস্টার্ব কিছু না। সারাদিন পড়ে আছে।
তা ঠিক, লৃ হেসে বলল।
আমরা দুই অলস আড্ডাবাজ ফাঁকি মারতে সফল হয়েছি, বলে লৃ তৃপ্তিতে আবার হাসল। যেন স্বয়ং প্রকৃতিকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে সে।
লৃ প্রচণ্ড অশান্ত প্রকৃতির, ছটফটে। প্রকৃতির সাথে অসম্ভব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকে সে প্রতিদিন। প্রচণ্ড প্রাণশক্তি তার ভেতরে। কোন কিছু নিয়ে আগ্রহ তৈরি হলে সেই আগ্রহকে আগলে ধরে রেখে জীবনকে প্রচণ্ড অনুভব করতে চেষ্টা করে। আর নিজের ইচ্ছে মত কোন কিছু করতে পারলে পরমানন্দ লাভ করে সে। যেন প্রকৃতির বলবিদ্যা এখন তার করায়ত্ত হয়েছে।
অনেক গল্প হল লৃএর সাথে সেদিন। খুব ভালো লাগলো গল্প করতে। সারাদিন কেটে গেল। অ্যাসাইনমেন্টে আর হাত পড়লো না। গল্প করতে করতে আমি হঠাৎ তার হাত চাইলাম, একটুও সংকোচ হল না। লৃ বলল কেন? আমি বললাম, অলওয়েজ রিমেইন অ্যাস মাই ফ্রেন্ড, লৃ। লৃ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বুঝতে পারছি না, সে আমার কথা শুনে অবাক হলো, নাকি হাত ধরতে চাইলাম দেখে অবাক হলো। কিন্তু আমি নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে তাকিয়ে আছি তার দিকে। সারাদিন এমন অসম্ভব সুন্দর সময় কাটার পর এ যেন অবশ্যম্ভাবী। লৃ হাতটা বাড়িয়ে আমার হাতের উপর রেখে বললো, আই উইল অলওয়েজ রিমেইন, ঋ। আমি জানতে পারি নি, তার বিস্ময়ের অংশ জুড়ে কোন কারণটি কাজ করেছিল, কিন্তু সে বিস্ময়ের নিশ্চিত অবসান ঘটেছিল।
আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। লৃকে এই প্রথম শান্ত মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে পলক পড়ছে লৃর। তার চোখে স্থির আনন্দ।
তৃ আর গ্র এসেছে। আমি আর লৃ পরস্পরের হাত ছেড়ে তাদের দিকে ফিরলাম। বলতে গেলাম, কি কিনে- . . . দেখি, তৃ ভীষণ স্তম্ভিত হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গ্রয়ের মুখটাও বিস্ময়ে বেদনায় ভরা। নিজেকে সামলাতে চাচ্ছে সে।
কি, মার্কেটে কিছু খুঁজে পাও নি? আমি বললাম।
গ্র বলল, আমি লৃ এর জন্য একটা জিনিস কিনেছি।
আমি তৃ এর দিকে তাকালাম।
তৃ ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমার অ্যাসাইনমেন্ট শেষ? নাকি এখনো শেষ হয় নি?
ওহ্, অ্যাসাইন্টমেন্ট করতে তো বসাই হল না, তার আগেই লৃ এল, আমরা আড্ডা জুড়ে দিলাম . . .
হাত ধরেও আড্ডা হয় নাকি? তৃ বলল।
লৃ উঠে দাঁড়ালো। দরজায় গ্র দাঁড়িয়ে। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো লৃ।
গ্র অনুনয় করে লৃকে বলল, আমি কি কিনেছি দেখবে? লৃ উত্তর করলো না।
আমি তৃকে বললাম, এত রাগ করছো কেন?
তৃ বলল, তুমি আমাকে একবার কি কথা দিয়েছিলে মনে আছে?
আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি কি কথা দিয়েছিলাম তৃকে? আমার তো মনে পড়ছে না এমন কিছু বলেছি যা এখন মনে পড়া উচিত ছিল আমার! কিন্তু একথা শুনে লৃ ঘুরে আমার দিকে তাকালো। চোখে মুখে আহত হবার ছাপ। তৃএর কথা শুনে লৃ অন্য কিছু ভাবছে। কিছুক্ষণ লৃ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। পিছে পিছে গেল গ্র।
আমি তৃকে বললাম, তুমি শুধু শুধুই রাগ করছো কিছু না বুঝে-
তৃ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমার এত শখ লৃএর সাথে আলাদা করে বসে 'আড্ডা' মারার, আমাদের বলে দিলেই পারতে। আমরা তোমাদের জন্য 'সু'ব্যবস্থা করেই বের হতাম।
তৃ-
অ্যাসাইনমেন্টের মিথ্যে বলার কি দরকার ছিল?
অ্যাসাইনমেন্ট আমার ছিল তৃ, এখনো আছে। কাল জমা। লৃ আসায় গল্প হয়েছে।
কাল জমা? না পরশু, ঋ?
পরশু লাস্ট ডেট, কিন্তু আমি কালকে জমা দিতে চাই। কাল অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বসতে পারবো না। আর অ্যাসাইনমেন্ট এখনো কিছুই হয় নি। এখন পুরোটাই করতে হবে।
ও, লৃ চলে গেছে, এখন আবার অ্যাসাইনমেন্ট! কবে থেকে তোমার কাছে আগে লৃ, তারপর অ্যাসাইনমেন্ট, তারপর আমি বলতো?
তৃ, এটা কি ধরনের কথা! আগে পরে মানে কি?
গ্র কি মনে করলো বলতো। মানুষ কি বলবে, এই লজ্জাও তোমার হল না? সেদিন চৃ আমাদের বলছিল, আমদের দুজনকে একসাথে কত অসম্ভব ভালো লাগে। তখন তো শুনে আনন্দে হেসেছিলে। আজকের কথা শুনলে চৃএর কি একটা শিক্ষাই না হবে, হাহ্?
গ্র দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলল, লৃ কোথায় না বলে চলে গেছে। মোবাইল বন্ধ।
ধ্বক করে উঠলো আমার।
তৃ বলল, কি হলো ঋ? লৃ কি অ্যাসাইনমেন্টটাও সাথে করে নিয়ে গেছে নাকি?
তৃ! আমাদের বন্ধু হারিয়ে গেছে, আর তোমার উল্টোপাল্টো বলা এখনো শেষ হলো না?
আহ্। আসছে, কি দরদ আমার। ন্যানোসেকেন্ডের স্বপ্নের মধ্যে তার বান্ধবী হারিয়ে যায়! এত দরদ তো যাও না, খুঁজে বের করে আনো না বান্ধবীকে?
গ্র বলল, না মানে, না হারালেও, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না-
আমি হাতের ইশারায় গ্রকে থামতে বললাম। তাকিয়ে থাকলাম তৃএর দিকে।
তৃ আমার চোখ আর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই চেষ্টা করছে, কি বলব আঁচ করতে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তৃএর ঝড়ো চেহারাটা আস্তে আস্তে বদলে গেল। শক্ত হয়ে যাওয়া পেশিগুলো শিথিল হয়ে গেল। মুখে নেমে এল বিধ্বস্ত, হত আশা। মনের গভীরে যে অব্যক্ত ভাষা, তা আমার পড়ে ফেলেছে তৃ। আর নিজের মনের ভাষাটি তখন আমি তৃএর চোখ থেকে পড়ে নিয়েছি।
লৃ হয়তো হারিয়ে যায় নি, কিন্তু আমি তার শূন্যতা অনুভব করছি। মনের ভিতরে এই কথাটি তখন স্পষ্ট শুনতে পেলাম।
তৃ স্থির দাঁড়িয়ে রইল। যেন, প্রকৃতির সমস্ত বল এখন কাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে জেনে গেছে। আমি ঘুরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
কোথায় যাচ্ছ? গ্র জানতে চাইল।
লৃএর কাছে।
তুমি জানো লৃ কোথায়?
হ্যাঁ।
আমি আসবো? . . . না থাক।
আমি পিছে না ফিরে এগিয়ে গেলাম।
(উৎসর্গ - নীলা)