রফিকের লাশ নিয়ে বেশ ঝামেলা শুরু হয়েছে। রফিক মারা গেছে চার ঘন্টা আগে। চার ঘন্টা আগেও সে লাশ ছিলো না। সকাল বেলা দিব্যি সে ভাত খেয়েছে। গ্রামের পথে হেঁটেছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে চা সিগারেট খেয়েছে। আড্ডা দিয়েছে।
সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল। মৃত্যুটাও স্বাভাবিক ব্যাপার তবু মেনে নিতে কষ্ট হয়। অস্বাভাবিক লাগে।
রফিকের লাশ চার ঘন্টা ধরে তার বাড়ির উঠানে পড়ে আছে। রফিকের মা নেই। বোনের বিয়ে হয়েছে। বাবা বেঁচে আছেন। ছেলে হারানোর শোক বাবা নিতে পারছেন না। বাজান গো বাজান গো বলে চিৎকার করে কাঁদছেন। কান্নার শব্দ আর হাহাকার আরো জোড়ালো হয়েছে যখন তিনি জানতে পারলেন এলাকাবাসী রফিকের দাফন জানাজা কিছুই করতে দিবে না।
মজনু মিয়া, তোমার পোলা তো ধর্মের ধারে কাছেও যায় নাই। উল্টা পেছনে লেগেছিল। আজেবাজে কথা বলতো, ধর্মের নামে।আল্লার নামে, নবী রাসুলের নামে। তুমিও তো তোমার পোলারে কিছুই বলো নাই। বলবা কি! তোমারেও তো জুম্মাবার ছাড়া মসজিদে দেখি নাই। তোমার পোলা চায়ের দোকানে কইছে তার যেন জানাজা না হয়, কব্বর না হয়। সে নাকি তার দেহখান দান কইরা যাইবো। আমরা তোমার পোলার দাফন এই গ্রামে হইতে দিবো না । তুমি তোমার পোলার দেহদানের ব্যবস্থা করো।
পোলাপান মানুষ রাগের মাথায় কোইছে। মাথা গরম পোলা আমার। কোন খারাপ কাজ করে নাই।কোন আজেবাজে নেশা নাই। কারোর কোন ক্ষতির মইধ্যে নাই। আপনারা পোলার দাফনের ব্যবস্থা করেন। গোর খোড়ার ব্যবস্থা করেন। এই ভাবে লাশ পইড়া থাকলে তো শিয়াল কুকুর খাইবো।
আল্লা খোদা মানে না এর চেয়ে খারাপ কাজ আর হইতে পারে? তোমার সাথে এই নিয়া আর কথা বলবো না। আমার এক কথা এই গ্রামের তোমার ছেলের দাফন হবে না।
এলাকার মানুষ তাতে সায় দিলো। কেউ কেউ আল্লাহ আকবার তাকবীর দিলো। মসজিদের ইমাম মাওলানা ফরিদ আহমেদ কিছু বলতে গেছিলো। তাঁকে থামিয়ে দেয়া হলো।
রফিকের লাশ ছয় ঘন্টা ধরে পড়ে আছে তাদের উঠানে। আষাঢ় মাস চলছে। বেশ গরম। বৃষ্টি হলেও এই গরম কমে না। এই গরমে লাশ কতক্ষণ টিকবে জানা নেই। আকাশে মেঘ জমছে। মাগরিবের আজান হয়ে গেল। যে যার বাড়িতে ফিরছে। মুসল্লীরা মসজিদে চলেছে। এখানে তামাশা দেখার আর কিছু নেই। মজনু মিয়া বাজান গো বাজান গো বলে চিৎকার করছে। সেই চিৎকার বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।
রফিক কে গোসল করাতে কোন অসুবিধা হলো না। আষাঢ়ের প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই বৃষ্টিতে গোসল করাচ্ছেন মসজিদের ইমাম মাওলানা ফরিদ আহমেদ। তাঁকে সাহায্য করছে মসজিদের দুই মুসুল্লী। মসজিদ থেকে কাফনের কাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবই করা হচ্ছে মানুষের অগোচরে। দাফনের বিষয় নিয়ে অনেক মিথ্যা বলতে হবে তবে সেই পাপের চেয়ে অনেক পুণ্যের কাজ করছেন মাওলানা ফরিদ আহমেদ। তাঁর তেমনটাই ধারণা। জানাজানি হলে তাঁকে শাস্তি পোহাতে হতে পারে। তবে দুনিয়ার শাস্তিকে মাওলানা সাহেব পরোয়া করেন না। মাঠের একপাশে রফিকের গোড় খুড়ছে মজনু মিয়া। বৃষ্টির মধ্যে গোড় খুড়তে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:২২