তখন আমাদের জন্ম হয়নি। ১৯৭৯ সালের কথা। আম্মুর বিয়ের কথা হচ্ছিল একটা কলেজের প্রফেসরের সাথে, আব্বু ছিল ওয়েটিং লিস্টে। আবার ওই প্রফসর ও ওয়েটিং লিস্টে ছিল কারণ তাঁর বয়স বেশি ছিল। কিন্তু আব্বুর ওয়েটিং লিস্টে থাকার কারণ ছিল আব্বু বাংলাদেশী এবং গায়ের রঙ কালো
নানিরা ইন্ডিয়ান। তাদের ধারণা এ দেশী ছেলেরা দুইটা তিনটা বিয়ে করে এজন্য আব্বু আরো বাদ গেল। অন্যদিকে,প্রসেসর ইন্ডিয়ান
কিন্তু দুইজনেরই সরকারি চাকরি তাই দুইজনের ব্যাপারে সবাই ভাবছিল।
এলাকায় এক মামা আছে তাঁর নাম ছিল আনোয়ার আর মামীর নাম ছিল আনোয়ারা। আমার আব্বুর চাচাতো ভাইয়ের সাথে আনোয়ার মামা চাকরি করতেন। কথা প্রসঙ্গে চাচাজি বললেন আব্বুর কথা। আর আনোয়ার মামাও বললেন আম্মুর কথা। আম্মু তখন খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে বিএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। তারপর নানা নানিকে বলতেই বাড়িতে আসতে বলল। খেতে দিয়েছিল লুচি আর খাসির মাংস। আব্বু প্রথমে এসেই মুগ্ধ হয়ে গেল নানাবাড়ি দেখে। পুরানো বাড়ি ভীষণ গুছানো আর সামনে বিশাল বাগান। আর আম্মুর হ্যান্ড রাইটিং দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল
আব্বু ভীষণ মিশুক। আনোয়ার মামা এবং আনোয়ারা মামির সাথে ভীষণ খাতির হয়ে গেল। তখন নানী বাড়িতে টেলিফোন ছিল না। টেলিফোন ছিল আনোয়ার মামার বাসায়। আব্বু ফোন করে জানিয়ে দিল তার বেশ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু নানীর কথা ছিল আমার আব্বু কালো তাই ঝুলিয়ে রেখেছিল
এদিকে আব্বু আনোয়ার মামার বাসায় প্রায়ই ঘুরতে আসতেন। উনারাও খুব পছন্দ করতেন। এরই মাঝে আব্বু একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো সেটা হলো আম্মু যেই কলেজে পড়ত ওখানে গিয়ে আম্মুকে উঁকি মেরে দেখে আসছিল আর আম্মু সেটা দেখে ফেলেছিল। তারপর আম্মুর সেকি রাগ!
তারপর দিনই আব্বুকে নিয়ে আনোয়ারা মামি নানিবাড়ি বেড়াতে গেল। আম্মু রুমে ঢুকে প্রথমেই আব্বুর দেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে বলল, এই নেন আপনার টাকা!
সেই আমলে পাত্রী দেখাকালীন সময়ে পাত্রপক্ষ পাত্রীকে টাকা দিত। আম্মু এভাবে আব্বুকে ইন্সাল্ট করল। ব্যাপারটা আনোয়ারা মামির মোটেও ভাল লাগলো না। এরই মাঝে আমার মামারা আসলো। ঢাকা ইউনিতে আব্বুর ডিপার্টমেন্ট থেকে আব্বুর জবের সব খোঁজ খবর নিয়ে দেখলো আমার আব্বুর মত ছেলে হয় না
এদিকে আম্মুও রাজি না আবার নানীও না। নানীর কথা সে কালো ছেলের সাথে বিয়ে দিবেই না
আর আম্মুর কথা, কেন সে উঁকি দিয়ে দেখলো? সামনে আসতে পারলো না?
এরই মাঝে একদিন আনোয়ারা মামি আম্মুকে হুমকি দিলেন, বললেন, কেকা তুই শুনে রাখ আমি এই ছেলেকে এই এলাকায় বিয়ে দিবো এবং তোর চোখের সামনেই! আর তুই নিজেকে কি খুব সুন্দরী ভাবিস? তুই অতও সুন্দর না জেনে রাখিস!
আব্বুও একদিন আনোয়ারা মামিকে বলল, ভাবি আমিও দেখতে চাই এই মেয়ে কোথায় বিয়ে করে!
মামারা ভাল মত খোঁজ খবর করার পর আমার নানাজির ছোট ভাই যিনি ডাক্তার হবার কারণে ডাক্তার নানাজি বলতাম, উনিও খুব পজেটিভ হয়ে গেলেন, আর আমার নানা তো শুরু থেকেই পজেটিভ ছিল। আম্মুও ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
কিন্তু এদিকে আমার দাদার খুব মন খারাপ হল। দাদাকে একজন বলল, আপনাকে তো কোন ছেলেই দেখেনা, এই ছেলেটা ভাল তাও সে বিয়ে করছে বিদেশী মেয়ে! কি হবে ভেবে দেখেন!
নানার মন খারাপ হলেও কিছু বললেন না।
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হল। বিয়ের বাজার করার সময় আমার বড় চাচী আব্বুর কাছে অনেক ডিমান্ড করলেন। তার কথা ছিল, আম্মুকে যাযা দিতে হবে, তাকেও তা তা দিতে হবে! নাহলে খবর আছে!
আব্বুর ৭৮ এ চাকরি আর ৭৯ তে বিয়ে। এক বছরে কত কিই বা পারে! তাই চাচির ডিমান্ড ফুল্ফিল করতে পারলো না। চাচিও ভীষণ রেগে গেলেন। আম্মু বাড়ির বড় মেয়ে ছিল তাই বিশাল আয়োজন করেছিল নানাজি। যদিও নানাজি বাংলাদেশে আসার পর অত টাকাও ছিল না। বিশাল বরযাত্রী নিয়ে আব্বু আসল বিয়ে করতে আর চাচী বরযাত্রীতে থাকা গ্রামের মানুষজনকে উস্কানি দিল। এরপর টেবিলে যেই খাবারই আসে। সবই তারা টেবিলের নিচে ফেলে দিচ্ছিল। এমতাবস্থায় বড়মামা কান্নাকাটি শুরু করলো। তারপর আবার রান্না হতে লাগলো। আর মেজ মামা সিস্টেম করে তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়িয়ে আব্বু আম্মুকে পাঠিয়ে দিল আব্বুর বাড়িতে।
অতঃপর তারা সিনেমার মত সুখে জীবন যাপন করতে পারেনি। কারণ এক হল, বড়চাচি ক্যাঁচাল লাগয়ে দিত; আর আব্বু আম্মুর মধ্যে ঝগড়া লাগত রেডিও নিয়ে। আব্বু এক চ্যানেল শুনবে আর আম্মু আরেক চ্যানেল
তবে, বিয়ের পর দাদা আম্মুকে নিয়ে খুব খুশি ছিল। আম্মুকে নিয়ে বলতেন, আমি মারা গেলে আমার ছেলের এই বউকে না দেখিয়ে মাটি দিপ না
আনোয়ার মামা বেঁচে নেই। আনোয়ারা মামির সাথে আমার যতবার দেখা হয় আমি এই গল্প শুনি। বার বার শুনি তাও ভাল লাগে। এমন হ্যাপি কাপল আমার জীবনে দেখা হয়নি
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১৭ রাত ১২:১১