একবার আমাদের এক নতুন স্যার নিয়োগ দেওয়া হল। স্যার আমাদের ট্যাক্সেশন পড়ানো শুরু করলেন। এমন না যে ক্লাসের ছেলেপেলেরা খুবই পাকনা। কিন্তু একটু এদিক সেদিক করে প্রশ্ন করলেই স্যার কনফিউজড হয়ে যেতেন। তারপর হেসে হেসে বলতেন, শুনেন এই কোর্সটা পড়াতে হলে খুবই আপডেটেড থাকতে হয়। অন্যান্য কোর্সের ক্ষেত্রে যেভাবে পড়ানো যায় এটা সেভাবে পড়ানো যায় না আমি চেক করে দেখবো ব্যাপারটা।
আমরা তখন মনে মনে বলতাম, আপনি কেন এত ব্যাক্টেডেট!
আবার মাঝেমাঝে ক্লাস করাতে করাতেই রেগে যেতেন আর বলতেন, শুনেন আপনাদের এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই যে আমি টিচিং প্রফেশনে একেবারেই নতুন! টিচিং-এ আমার ছয়মাসের এক্সপেরিয়েন্স আছে। আমি এর আগে ২ মাস একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতেতে এবং ৪ মাস আরেকটা পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছি সো বুঝতেই পারছেন!
আমি তখন খুবই অসুস্থ ছিলাম। ওষুধ চলছিল। আমার ডাক্তার আমাকে মিষ্টি আর মাংস খেতে মানা করে দিয়েছিলেন। আমি পড়ালেখা ঠিক করে করতে পারছিলাম না। হলে থাকতে হচ্ছিল একা।
স্যারের অকারণে এই রাগ দেখানো দেখে আমরা মাঝেমাঝে হাসিখুশি হয়ে যেতাম। ওই সময় স্যারের এক ফ্রেন্ডের সাথে আমার কথা হত। আমি উনার সাথে চূড়ান্ত বিটলামি করতাম। উনিই বললেন যে উনার ফ্রেন্ড আমাদের শিক্ষক হয়েছেন। শুনে আমি স্যারের অনেক প্রশংসা করলাম। উনি এটা শুনে বললেন, তুমি ঠিক চিনেছ! ও আসলেই ভীষণ ভাল ছেলে!
এরই মাঝে স্যারের ফ্রেন্ড আমার সাথে একদিন ফোনে কথা বলতে চাইলেন। আমি তো কথা বললামই না বরং তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার সাথে কিসের কথা?
তারপর ক্লাসে স্যার লেকচারের বাইরে যা বলতেন তার সাথে স্যারের বন্ধুর কথাবার্তা হুবুহু মিলে যেত। তখন আমার মনে হত এই লোক স্যারের ক্লোজ ফ্রেন্ড। এর ফলে আমি আতংকিত হয়ে স্যারের বন্ধুকে ব্লক করে দেই
যাই হোক, এরপরে কি হয়ে গেল বুঝলাম না। আমি ক্লাসের অত্যন্ত সাধারণ এবং নিরীহ স্টুডেন্ট। খুব দ্রুত কোর্স শেষ হবে এবং তারপরেই ফাইনাল হবে। আমি অসুস্থ থেকে খেয়ে না খেয়ে সব পরীক্ষা এটেন্ড করলাম। হঠাত একদিন মার্কস দিলেন এবং দেখা গেল আমাকে একটা পরীক্ষায় এবসেন্ট দেখাচ্ছে! স্যারকে বলতেই বললেন, আপনার খাতাটা আমি পেয়েছি কিন্তু আপনি এটেন্ডেন্স শিটে ওই পরীক্ষায় সাইন করেননি তাই আপনাকে আমি মার্কস দিতে পারছি না! আমার তখন আর কি করা! আমি স্যারকে অনেক সুন্দর করে স্যরি বলে বললাম, স্যার মার্কসটা না পেলে গ্রেড খুব খারাপ আসবে
পরে উনি আমার প্রতি খুব দয়া করলেন ভাব নিয়ে মার্কস দিলেন!
এরপরের সেমিস্টারে স্যারকে একটা মহা ফালতু কোর্স দেওয়া হল। সেখানে একটা রিপোর্ট আর কয়েকটা এসাইনমেন্ট ছাড়া পরীক্ষার জন্য তেমন পড়ালেখা ছিল না। স্যার ছিলেন মহা বিরক্ত। কেন তাকে এত ফালতু কোর্স দেওয়া হল! আমি আমার রিপোর্টটা খুব ভাল করে তৈরি করলাম। কারো সাথে যাতে না মিলে এজন্য মেজ বোন যে ব্যাংকে কাজ করে ওখান থেকে একটা প্রোপোজাল নিয়ে সেটা অনেক যত্ন সহকারে বিজনেস প্ল্যান আকারে প্রেজেন্ট করলাম। স্যার ডিজাইন খুবই পছন্দ করেন এজন্য ডিজাইনও করলাম ছবি টবি দিয়ে
কিন্তু যেদিন প্রেজেন্টেশন ছিল ওইদিন আমার যখনই বলার সময় আসলো তখন হঠাত প্রোজেক্টর অফ হয়ে গেল। তারপর পোলাপান গুতাগুতি করে সেটা ঠিক করল। এরপর যেই না বলতে গিয়েছি তখন স্যার বললেন, ইউ হ্যাভ টু মিনিটস রিমেইনিং!
আমি একটু অবাকই হলাম। ক্লাসের সবাই অবাক! ৫ মিনিটের প্রেজেন্টেশনে প্রোজেক্টর নষ্ট হওয়ায় তিন মিনিট কেটে নিলেন। এমন তো না প্রোজেক্টর আমি নষ্ট করেছি যে আমার থেকে সময় কেটে নিতে হবে! আমি ২ মিনিটেই কোন রকমভাবে প্ল্যান সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়েও ভাল করে দিতে পারলাম না তার আগেই স্যার বলে উঠলেন, স্টপ স্টপ!
আমি কোন রিকোয়েস্ট করলাম না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখিত হলাম। আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করেছিলাম। স্যারকে অত্যন্ত আনন্দিত মনে হচ্ছিল ওইদিনকার সেশনে। আমি ছাড়াও কয়েকজন নীরিহ স্টুডেন্টকে আচ্ছা মত সাইজ দিয়ে তৃপ্তির হাসি ছিল চোখে মুখে।
ধারণা করেছিলাম ইনকোর্সে আমাকে হয়ত আমাকে খুব খারাপ একটা মার্কস দিবেন। কিন্তু দেখলাম না, উনি আমাকে ৪৬ দিয়েছেন যেখানে হাইয়েস্ট ৫০
কিন্তু প্রেজেন্টেশনে লোয়েস্ট মার্কসটা আমাকে দেওয়া হয়েছিল তবে পোলাপান খুব বিরক্ত ছিল। সবাই ভেবেছিল তারা অনেক বেশি বেশি পাবে অথচ স্যার তাদের সেভাবে মার্কস দেননি। কিন্তু প্রেজেন্টেশনের ওই ঘটনার পর আমার মনে হত স্যার আমাকে একদমই দেখতে পারেন না। যেমন পরীক্ষার সময় যেখানে আমি দেখাদেখিই করিনা, সেখানে আমি নকল করছি টাইপ ভাব নিয়ে হাতে নাতে ধরতে এসে নিজেই লজ্জিত হতেন। (দেখাদেখি করতাম তবে ভাল ফ্রেন্ডদেরটা ছাড়া দেখতাম না)
একবার আমি মারাত্বক অসুখে পড়ে হসপিটালে ভর্তি হলাম। আমার ফ্রেন্ড স্যারকে সেটা জানিয়ে বলল, স্যার ও খুলনা চলে যাবে!
তখন স্যার খুব কিউরিয়াস হয়ে জানতে চাইল, কে খুলনা যাবে বললেন? উনার আইডি বলেন! আর উনাকে বলবেন আমাকে ফোন দিতে।
আমি ওই সেমিস্টারে ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম খুব খারাপ রেজাল্ট হবে। শুরুতেই চোখের সামনে কাজিন মারা গেল, খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তারপর সেটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আম্মু স্ট্রোক করল সেটাও কিছুটা কাজিনের কথা ভেবে। তারপর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। স্যার আমাকে খুবই অপছন্দ করে। ফোন দিয়ে আর কি হবে, এটা ভেবেও স্যারকে ফোন দিলাম। স্যার অতি সুমিষ্ট ব্যবহার করলেন। আমার চোখ ছলছল করার মত অবস্থা ছিল এত সহানুভূতি পেয়ে
সুস্থ হয়ে আসার পর দেখলাম, স্যার আমার প্রতিটি বিষয়েই ভীষণ পজেটিভ। যেমন একদিন খুব মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। আমার পাশের জন খাতা দেখে লিখছিল। স্যার গম্ভীর স্বরে আমার ক্লাস আইডি ধরে বললেন, আইডি টু সিক্স নাইন সিক্স বি কেয়ারফুল!
আমি আমার আইডি শুনেই ধরমড় করে উঠে দাঁড়ালাম এটা ভেবে কি পাপ হয়ে গেল আবার! স্যার বললেন, আহা আপনি উঠছেন কেন? উঠতে বলিনি তো। কেয়ারফুল থাকেন পাশের জন থেকে
কেউ যদি খাতা দেখে লিখে তাহলে তাকে কেয়ারফুল করেন স্যাররা। কিন্তু আমাকে কেন? এর কারণ হল দেশী মানুষের উপর দরদ!
স্যার খুলনার, আর আমি খুলনার এটা জানার পরেই স্যার আমাকে পছন্দ করতেন
ভার্সিটিতে বিএনসিসি গ্রুপ দেখেছি, বৃহত্তর বরিশাল জোট দেখেছি, কুমিল্লা জোট দেখেছি নোয়াখালি জোট সহ আরো নানান দেখেছি আর ভেবেছি এরা এমন কেন? আমরা সবাই এখানে পড়তে আসছি মানে আমরা সবাই একই! আবার জোট কেন!
যদিও কেউ কেউ মজার্চ্ছলেই এই জোট সেই জোটের লোক বলে ফাজলামি করে। কিন্তু অনেকেই আছে জোটের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস।
খুলনা জোটের কথা কল্পনায় আসেনি জীবনে। কিন্তু স্যারের বিষয়টায় আমার এতই মজা লেগেছে যে বলে বোঝাবার না! এই জোটের বিষয়ের জন্যেই স্যার আমাকে পরবর্তীতে কোন প্যারা দেননি
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২২