তখন বিবিএ এর এ্যাডমিশন টেস্ট এর কোচিং করতাম। একদিন বিকালে রাসেল ভাইয়ার ক্লাসে যেতে আমার দশমিনিট দেরী হলো। ঐদিন আবার ম্যাথের উপর আমাদের একটা পরীক্ষা ছিল। আমি ক্লাসে ঢুকেই দেখি ভাইয়া নাই আর সবাই পরীক্ষা দিচ্ছে। একজন আমাকে বললো টেবিলের উপর থেকে প্রশ্ন নিয়ে বসে পড়তে। আমি ধীরস্থিরভাবে ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিতে সোজা পেছনে চলে গেলাম।
প্রশ্ন হাতে নিয়ে দেখি ভাইয়া অফিশিয়াল জিম্যাট বইটার মাঝখান থেকে হুবুহু ৫০ টা ম্যাথ তুলে দিয়েছেন। এরই মাঝে বান্ধবী অনুসূয়া বললো, এই চানা তুই ওখানে কেন! সামনে আয়!
আমি ছিলাম দোনামনা অবস্থায়। ভাবছিলাম সামনে যাবো কি যাবো না। হঠাত কি মনে করে যেই না সামনে যেতে গেছি তখন ভাইয়া ক্লাসে ঢুকে পড়লেন।
রাসেল ভাইয়া আমাদের অতি পছন্দের একজন টিচার ছিলেন। খুবই হাসিখুশি থাকতেন। খুব মজা করতেন। ক্লাসে ঢুকেই হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, কতদূর?
সবাই গদগদ হয়ে একসাথে গলা মিলিয়ে বললো, ভাইয়া পরীক্ষা শেষ!
(একথা শুনে তখন আমার মনটা দু:খে ভরে উঠলো। মনে মনে কেঁদে উঠে বললাম, আল্লাহ্ আমি এখনও শুরুই করতে পারলাম না ঠিক করে, আর ওরা সব শেষ করে ফেললো! ওরা এতো ফাস্ট! আর আমি এতো স্লো! )
এদিকে ওদের পরীক্ষা শেষ শুনে ভাইয়াও হতভম্ব।
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি করে সম্ভব? আমি ৫০ টা ম্যাথে সময় দিয়েছি ৫০ মিনিট! বলেও দিয়েছি ক্যালকুলেটর ইউজ করা যাবে না! ক্যালকুলেটর ইউজ করোনি তো? ক্যালকুলেটর ইউজ করেও যদি পরীক্ষা দাও তাও তো ৫০টা ম্যাথে ৫০ মিনিট না লাগুক অন্ততপক্ষে ৩০ মিনিট লাগার কথা! আর এখানে এমন সুপার পাওয়ারের কেউ নেই যে ১০ মিনিটে ৫০টা ম্যাথ করতে পারে! আমি তোমাদের ক্যাপাবিলিটি সম্পর্কে জানি। কোয়েশ্চেন পড়তেও তো টাইম লাগে! আমি বাইরে গেছিলাম বলে বই দেখে দেখে টিক দাও নি তো? বই দেখে দেখে টিক দাওনি তো!!
কথা বলতে বলতেই ভাইয়া প্রচন্ড রেগে গেলেন!!
ক্লাসের অসম্ভব চালু একটা ছেলে বললো, ভাইয়া আসলে ব্যাপার হচ্ছে কি যেকোনো ম্যাথ করলেই আমার এ্যানসারটা মনে থেকে যায়। এজন্য ক্যালকুলেশনে আর না যেয়ে সরাসরি ম্যাথ দেখার সাথে সাথেই টিক দিয়েছি!!
একথা তার মুখ থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আরো কয়েকজন তার সাথে গলা মিলাতে মিলাতে বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়!
একজন আবার একটু বেশি পাকনামী করে বললো, ভাইয়া জিম্যাট বইয়ের সবকিছুই আমার খুব ভালো করে করা! ক্রিটিক্যাল রিজনিং বলেন, আর ম্যাথ বলেন! সবই পারি! বইটাই আমার পুরো মুখস্থ!
এরপর ভাইয়া যা করলেন তা অবর্ণনীয়! নিজের বইটা খুললেন। ভাইয়ার জিম্যাটটার আবার কোনো কিছু মার্ক করা ছিল না। কয়েকজনকে বই বের করে এ্যানসার বলতে বললেন। আর এই পরীক্ষায় সবাই ফেল মারলো।
ভাইয়া প্রচন্ড রেগে গিয়ে চিতকার করে বললেন, দেখে দেখে এ্যানসারে টিক দিয়েছো তোমরা! আমাকে ফাঁকি দাও তোমরা! চুরি করেছো তোমরা! বলে দিচ্ছি... একটাও চান্স পাবা না তোমরা!
এরপর এলোমেলোভাবে কয়েকজনকে ঝাড়ি মারতে লাগলেন। উনার ঝাড়ির মারার ধরণটা ছিল হঠাত করে একজনকে দাঁড় করিয়ে সমানে ঝাড়া। সেই ঝাড়া এমন ঝাড়া যে আর বলার মতো না!
ভাইয়ার ঝাড়ির সময় মনে হতো, হে আল্লাহ্ তুমি এখনও কেন আমাকে দুনিয়ায় রেখেছো!
প্রথমেই মূল অপরাধী ছেলেটা ঝাড়ি খেলো। তারপর ভাইয়া আমার বান্ধবী অনু এবং অনিকে কাঁদিয়ে দিলেন। অনি মেয়েটা ছিল বেচারী। সে নিজের চেষ্টাতেই পরীক্ষা দিচ্ছিলো। কিন্তু কেউই একবার একটুও বললো না যে ওর কোনো দোষ নাই!! ওরও আমার মতো ইনকমপ্লিট পরীক্ষা ছিল!!
এরপর ধরলেন আমাকে। আমাকে ধরার সাথে সাথেই মূল অপরাধীরা আমি নির্দোষ ঘোষণা দিয়ে পুরো দোষ স্বীকার করলো যে তারা বই দেখে এ্যানসার টিক দিয়ে ক্লাসের বাকী মানুষগুলোকে বলে দিয়েছিল আর এজন্যই সবার এতো তাড়াতাড়ি পরীক্ষা শেষ ছিল!!
এখনও সেই বিকালটির কথা ভাবলে আমার গা শিউরে ওঠে, আমি আরেকটু আগে আসলে ওদের মতোই দেখে দেখে পরীক্ষা দিতাম!! আর বড় একটা ধরা খেতাম!! আমি তো আর বান্ধবীদের মতো এ্যাঁএ্যাঁ করে কাঁদতে পারতাম না অত লোকজনের মাঝখানে!! হয়ত আমাকে সেদিন চোখ লাল করে বড় বড় নি:শ্বাস ফেলতে ফেলতে বাসায় ফিরতে হতো!!
অনেকদিন হয়ে গেছে। এখনও পরীক্ষার সময় দেখাদেখি করে পরীক্ষা দেওয়ার সময় মনে পড়ে যায় সেই ভয়ংকর বিকালের কথা !!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৩ দুপুর ১:৩৫